somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আগা নষ্টালজিক গোড়া নষ্টালজিক [চার]

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৯:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অনেক অনেক কাল আগের কথা। সেই সময়ের কথা বলছি যখন পরিষ্কার নীল আকাশের দখন নিয়ে কাড়াকাড়ি করত পাখি আর রঙ-বেরঙ এর ঘুড়ি। অবাক হয়ে ভাবতাম কিভাবে উড়ায় তারা ফিনফিনে কাগজের এই জিনিস টাকে?? কতই না কারুকাজ, কত নকশা। নাটাই, বাহারী সুতো, মাঞ্জা, গোত্তা, ঘুন্নির এক আশ্চর্য মন্ত্রজাল। তখন আমি ভাইয়াদের লাউজ্ঞা (হেল্পার/এসিসটেন্ট) হিসেবে বেগার খাটতাম। সিনিওরিটির নির্মম অত্যাচারের ক্ষোভ অসহায় আত্মসমার্পন করত ঘুড়ি উড়ানোর কলা-কৌশলের মুগ্ধতায়। আমার চেয়েও লম্বা, আমার চেয়েও ভারী নাটাই টা একটু ছুঁয়ে দেখার নিঃশব্দ আকুতি করেই যেত ছলছলে দুটো চোখ। শুনেছি খবিশদের মনেও খানিক টা দয়া মায়া থাকে, এটা প্রমান করতেই বুঝি তারা কয়েক মুহুর্তের জন্য সেই মহার্ঘ্য নাটাই টি কে স্পর্শ করতে দিত। আলগাতে পারতাম না, আঙুল দিয়ে গ্রিব-ই করতে পারতান না আর ঘুরানো তো অনেক পরের কথা। ভাইয়ারা ধক দিয়ে উঠত, হায় হায় গেল গেল বলে ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিত হাতের নাটাই। কিন্তু সেই মুহুর্তে মন হত যেন আমি হাতে স্বর্গের টূকরো ধরে আছি। সেই ক্ষনিকের মুগ্ধতাই আমাকে গোলাম বানিয়ে দিল...

ভাইয়া এইবার মাঞ্জা দিবা না?
দিব তো।
কবে দিবা?
বৃষ্টি কমুক। এখন মাঞ্জা দিলে তো শুকাবে না।
আবার দুদিন যেতে না যেতেই প্রশ্ন করে বসতাম। ভাইয়া মাঞ্জা দিবা না? এইবার উত্তরের সাথে সুদ হিসেবে ঠুয়া ও জুটে যেত- কানের সামনে ঘ্যান ঘ্যান করিস না তো। দিলে তো জানতেই পারবি, যা ফুট।
বিমর্ষ মনে আবার ও অপেক্ষায় বসে থাকতাম। কবে বর্ষাকাল শেষ হবে আর কবে মাঞ্জা দিব।

...সালেহীন তাড়াতাড়ি ছাদে আয়, এক সন্ধ্যায় ডাক পরে আমার। হুড়মুড় করে ছাদে গিয়ে দেখি ৪-৫ টা নতুন নাটাই, অনেক অনেক রিল সুতো, ঠোঙায় মাঞ্জার মশলা কাগজের রিম আর বাঁশের কাইমের স্থুপের চারপাশে ভাইয়ারা বসে আছে। এইবার কিভাবে মাঞ্জা দেয়া হবে তারই মাষ্টার প্ল্যান বানানো হচ্ছে।
তর উপর-ই এখন ভরসা। তুই না পারলে এটা করতে পারবে না। কিরে পারবি না?
এই প্ল্যানের আমিই সুপার হিরো, এই কথা চিন্তা করেই বুক ২ ইঞ্চির মত চওড়া হয়ে গেল। কিভাবে প্ল্যান টা সাকসেসফুল করব, কিভাবে ভাইয়া দের আশা-ভরসা রক্ষা করব সেই চিন্তাতেই সারারাত চিন্তায় টগবগ করতে থাকি।
ইশশ তখন যদি বুঝতাম যদি জানতাম আমাকে ছাড়া ভাইয়াদের মাঞ্জা দেয়া সম্ভব না তাহলে নিশ্চয়ই ধান্দাবাজী করে কিছু বাগিয়ে নিতে পারতাম। এখন ভাবি আগে কত নিঃপাপ ছিলাম। নাকি বেক্কল ছিলাম?? হিসাব মিলাতে পারি না। শুধু আফসোস হয়, আফসোস।

পরদিন বিকেলে খেলার সময় দাদুর ঘরের দুটো জানালার কাঁচ আর উঠানের একটা টিউব লাইট মুখ থুবড়ে মাটিতে পরার বিকট আওয়াজ হল। দাদুর ক্যাটক্যাটানির ঝাঁজ কাঁচের ঝনঝন শব্দের তীব্রতায় চাপা পরে গেল। এই ফাঁকে আমি এক দৌড়ে ছাদে।
পরের এসাইনমেন্টঃ অপরেশন ডিম চুরি।

মাঞ্জার সিজন চলে আসলে আমাদের সাথে সাথে কিভাবে যেন আমাদের মা-চাচিরা ও টের পেয়ে যেত। ডিম মাঞ্জা দিতে ডিমের দরকার। আর ডিম পাওয়া যায় আমাদের ফ্রিজে। তো সেই ফ্রিজ সারা বছর আমরা কেউ ছুঁইয়ে ও দেখি না। যেই মাঞ্জা দেয়ার নাম নিব সাথে সাথেই সেই ভাঙা ফ্রিজে কে বা কাহারা তালা দিয়ে দিত। তালা দেয়া সেই ফ্রিজ থেকে ডিম চুরি করে আনার গুরু দায়িত্বতাও নিজের কাঁধে তুলে নিতাম। ফ্রিজের চাবি থাকত আবার দাদুর মাথার বালিশের নীচে। অনেক অনেক দিন পর দাদুর প্রতি আমার মায়া-মমতা আবার বেড়ে যেত এক অদ্ভুত কারনে। তার সাথে দুপুরের ঘুমানোর অন্যায় আর ন্যাকা জিদ ধরতাম। ঘুম একটু গভীর হলেই আমার কচি হাত দিয়ে চাবি বের করে ডিম ছাদে পাচার করে দিতাম। কচি হাত আবার ও চাবি জায়গা মত রেখে দিত।

কাজ গুলো যতটা সহজে হয়ে যেত তার পরের ফলাফল হত তেমনই কঠিন। বাবা-চাচা আর মা-চাচির হাতে ধোলাই খাওয়ার কাহিনী গুলো ইচ্ছে করেই আর লিখলাম না।

এর পর শুরু হয়ে যেত এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। সবার প্রথমে নানা জায়গা থেকে জোগাড় করা ভাঙা আর আস্ত কাঁচের টুকরা গুলোকে মিহি করে গুড়ো করা হত। আগের দিনে এক ধরনের সবুজ কাঁচের আধিক্য দেখা যেত, এখনকার মত এক স্বচ্ছ হত না আগের গ্লাস গুলো। তাই গুঁড়ো করার পর সবুজ বর্ণের পাউডার পাওয়া যেত। তারপর ছাদে আগুন জ্বালিয়ে রান্না ঘরের চুরি করা পাতিলে সাগু দানা, শিরিষ, ডিম, আটা-ময়দা-সুজি, ভাতের ফ্যান দিয়ে লেই বানাতাম।
সুতোর রিল গুলো একটা নাটাই এ পেঁচিয়ে সুতোর মাথা লেই এ ভালভাবে ডুবানো হত। লেই এ ভেজা সুতোয় কাঁচের পাউডার মাখানো হত। তারপর সেই মাথা একটু দূরে আরেক টি নাটাই এ প্যাঁচানো হত। খড়খড়া তেজী রোদে এই কাজ টা করতে হত যেন আঠা ভালভাবে শুকিয়ে যায়। কতবার যে নাটাই এর চিপায় আঙুল চাপ খেয়ে নখে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে আর মাঞ্জা দেয়া সুতোয় হাত কেটে গেছে সেই হিসাব আজ করতে যাওয়া টাই বোকামি।

কিভাবে ঘুড়ি বানাতে হয়। কোন ঘুড়ি টা কোন মাপে বাঁয়াতে হয়। কার বিশেষত্ব কি সবই ভাইয়া দের দেখে দেখেই আমি শিখেছি। ছুরি দিয়ে কাইম চাঁছার সময় বাঁশের পাতলা আঁশ হাতে ঢুকে যেত। সেই ভোতা ব্যাথা বেমালুম ভুলে যেতাম আনন্দের সাথে। অবাক হয়ে দেখতাম বাক্স ঘুড়ি বানানোর নিয়ম। লাল নীল হলুদ সবুজ কাগজ জোড়া দিয়ে বানানো হরেক রকম লেজ। কোন টা ছোট আবার কোনটা বিশাল।

এরপর কেটে গেছে কতগুলো বছর। মাঝে কয়েক বছর হোস্টেলে থাকার সুবাদে ঘুড়ি উড়াতে না পেরে মন খারাপ হয়ে যেত। ছুটিতে বাসায় আসলেই আবার ঘুড়ি নিয়ে মেতে উঠতাম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আকাশে মুক্ত মনে উড়াল দিয়ে আসতাম। গোত্তা, ঘুন্নি, মাঞ্জা নাটাই নিয়ে কেটে যেত সময় গুলো। হঠাৎ করে কবে যেন বড় হয়ে গেলাম। এখন আর ঘুড়ি উড়াই না। মন ও আর টানে না। ছোট বেলার মত এখন আর আকাশে মুক্ত মনে উড়ে বেড়ানোর সুযোগ ও আর নাই। মাঝে মাঝে বড় হবার বায়না ধরার জন্য, স্রষ্টার কাছে মিনতী জানানোর জন্য নিজেকেই অপদস্ত করতে ইচ্ছা জাগে।

ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে অনেক কিছুই শিখেছি। একটি শিল্প, কারু কর্ম আর কিছু জীবন জ্ঞান আর দর্শন। জীবনের অনেক অধ্যায়ের সাথেই ঘুড়ির অনেক মিল আছে। অনেক প্রিয় জিনিসের মতই মাঝে মাঝে ঘুড়ি উড়ানোর সময় সুতোয় অনেক ঢিল দিতে হয়। নাটাই এর অধিকাংশ সুতোকে ছেড়ে দিতে আপাত বিলাসিতার কষ্ট, ঘুড়িকে অন্তরীক্ষে পাঠানোর গুপ্ত জেদের কাছে একদম ই পাত্তা পায় না। ভর দুপুরের কড়া রোদের মধ্যে সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মিকে উপেক্ষা করে বেশীক্ষন আর সেই রঙিন বিন্দুকে অনুসরন করা সম্ভব হয় না। চোখ জোড়া টন টন করে তাদের অক্ষমতাকে জানান দেয় মনের এই কিম্ভুত একাগ্রতার আধিক্যতায়। এক সময় নিজেই নাটাই এর সুতো টান দিয়ে ছইড়ে ফেলে চরম আক্রোশে। তারপর ছায়ায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে বিন্দুকে লক্ষ করে যায়। সব স্বপ্ন-আশার বার্তা নিয়ে হারিয়ে যায় সেই কাঙ্খিত অন্তরীক্ষে অথবা প্রকৃতির খেয়ালে... ঠিক যেন আমাদের কিছু প্রিয় মানুষ বা মৃতপ্রায় স্মৃতির মতই। ঘুড়ি থেকে আমি শিখেছি প্রিয় কোন কিছুকেই ধরে রাখতে নেই। সব সুতো ছেড়ে দিতে হয়, মিলিয়ে দিতে হয় আকাশে। প্রকৃতিও যেন উল্লাস করে উঠে- ভোকাট্টা লোট লোট...
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×