কিস্তি-৪
পত্রিকা পড়ছেন জাফর সাহেব। অফিস থেকে বাসায় ফিরে এছাড়া কোন কাজ নেই। অলস সময় কাটে। এ সময়টা তিনি কাটান পত্রিকা পড়ে। হাত-মুখ ধুয়ে হাল্কা কিছু খান তিনি। এরপর দৈনিক পত্রিকা খুলে বসেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার অভ্যাস নেই। পুরো নিউজ পড়েন না। যদিও পুরো পত্রিকার একটি বিষয়ও বাদ দেন না। হেডিং পড়ে কোন নিউজ মনে ধরলে শুধু ওইটি পড়েন। তবে কোনভাবেই পুরো খবরটি পড়েন না। বড় জোর পাঁচ-সাত লাইন।
জাফর সাহেবের ধারণা পত্রিকায় এত বড় বড় খবর ছাপানোর কোন মানে হয় না। ফাও প্যাচাল। সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা বেশ ক’বার লিখে গল্প ফাঁদেন। যত্তসব। বিরক্তিকর।
জাফর সাহেবের মাথা যেন একটি রেকর্ডার। প্রতিদিনের পত্রিকায় তিনি যা পড়েন তা মনে থাকে অনত্মত ছয় মাস। বহুবার এর প্রমাণ পাওয়া গেছে অফিস কিংবা বাসায়। গত পরশু সহকর্মী আশরাফ সাহেব জানতে চাইলেন গত তিন মাসে কোন শেয়ারের দাম সবচেয়ে বেড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে জাফর সাহেব বলে দিলেন। শুধু তাই নয়, কোনদিন কত টাকা বেড়েছে তাও বলে দিলেন গড়গড় করে।
গতকাল সামি এসে জানতে চাইলো- বাবা, কত সালে উপকূলে ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল, তারিখটা যেন কত?
জাফর সাহেব বললেন- ২৯শে এপ্রিল, ১৯৯১। ওই ঝড়ে লাখের ওপরে লোক নিহত হয়েছিল।
থ্যাঙ্ক ইউ বাবা।
চলে যাচ্ছিল সামি। জাফর সাহেব তাকে ডাকলেন। ফিরে এসে সামি বললো- জ্বি বাবা, কিছু বলবে?
হ্যাঁ, নলেজ বানানটি বলো।
আমি পারি বাবা।
তবুও বলো। গত পরীক্ষায় তুমি পাঁচটি বানান ভুল করছো।
গত আড়াই মাসে এ জন্য তুমি প্রতিদিন এ পাঁচটি শব্দ আমারে ধরছো। প্রতিবারই আমি শুদ্ধ বানান বলছি। শুধু তাই না, প্রতিটি শব্দ প্রতিদিন পাঁচবার করে লিখে তোমারে দেখাইছি।
আজকে লিখছো?
হ্যাঁ, লিখছি।
খাতা নিয়ে আসো। আমারে দেখাও।
খাতা নিয়ে এসে জাফর সাহেবকে দেখালো সামি।
জাফর বললেন, ঠিক আছে যাও।
পাশের রুমে অহনার সেল ফোন বাজছে। মা জানতে চাইলেন, অহনা কোথায়? ফোন ধরছে না কেন? সামিকে ডেকে ফোনটা ধরতে বললেন। সামি বললো- বাবা বলেছে একজনের ফোন অন্যজন ধরা ঠিক না মা। ছেলের কথায় বিরক্ত হলেন রাবেয়া খাতুন। এই বয়সেই পেকে যাচ্ছে সামি। তিনি এসে ফোনটা ধরলেন।
হ্যালো।
অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো- কি করছো ডার্লিং?
রাবেয়া খাতুন বুঝতে পারলেন কিনা বোঝা গেল না। তিনি বললেন-
রানতাছি। কে আপনি?
এতদিন ধরে তোমার সঙ্গে গেজাচ্ছি, অথচ আজ প্রশ্ন করছো কে আমি? ব্যাপার কি বলো তো? হঠাৎ তোমার পরিবর্তন!
আপনের কথা আমি বুঝতাছি না!
যা বাবা! সকালে আমাকে উল্টে দিলে, টিপে টিপে মারলে, আর এখন আমার কথাই বুঝছো না? চলে এসো না ডার্লিং ধানমন্ডি লেকে অথবা বসুন্ধরায়- ফুচকা খেতে খেতে চুটিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে।
আপনের কথার আগামাথা আমি কিছুই বুঝতাছি না। আমি অহনা না, অহনার মা।
অপর পাশ থেকে লাইনটা কেটে গেল।
জাফর সাহেব জানতে চাইলেন- কি হইছে? কে, পারভেজ ফোন করছে?
না।
তাহলে?
কোন পাগল কে জানে!
কি বলে?
ফুচকা খাইতে বসুন্ধরায় যাইতে কয়।
ভালই তো। যাও না, ঘুইরা আসো। তবুও তোমার শিক্ষা হয় না! কতদিন বলছি একজনের ফোন অন্যজন ধরা উচিত না।
আমার কি দোষ। ভাবলাম যদি পারভেজ ফোন করে থাকে।
তোমার মাথায় সারাক্ষণ পারভেজ আর পারভেজ। ও-ই তো তোমার মাথাটা খাইলো।
জাফর সাহেবের ফুরফুরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। চেয়ারের ওপর পত্রিকা রেখে তিনি ওঠে দাঁড়ালেন। শার্টটা গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কোথায় যাচ্ছেন রাবেয়া খাতুন জানতে চাইলেন। তিনি কোন উত্তর দিলেন না। চা খেয়ে যেতে বললেও জাফর সাহেব বেরিয়ে গেলেন। যেন তিনি কিছুই শোনেন নি। অফিস আর বাজার ছাড়া সহসা তিনি ঘর থেকে বের হন না।
সূর্য ডুবতে তখনও ঢের বাকি। তবুও চারদিক আবছা অন্ধকার হয়ে এসেছে। মেঘে ঢাকা পড়ে সূর্যের তেজ ম্লান। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো জ্বলে উঠেছে। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। মনে হচ্ছে ল্যাম্পপোস্টের বাতি চুঁইয়ে আলো পড়ছে। তা দেখে মনটা ভাল হয়ে গেল জাফর সাহেবের। তিনি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার মুখে ঈষৎ হাসির বলিরেখা। একসময় অস্পষ্ট উচ্চারণ- চমৎকার, ভারি সুন্দর!
পাশ থেকে কে একজন নিচু স্বরে বলে উঠলো- এই সুন্দরই আমার কাল হয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে আবার ভলিউম বাড়িয়ে- এই তোমার আসার সময় হলো বাবা! সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। চলো চলো, তাড়াতাড়ি চলো।
ফিরে তাকালেন জাফর সাহেব। ততক্ষণে হালকা-পাতলা গড়নের একটি মেয়ে তার হাত ধরে টানছে।
জাফর সাহেবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেয়েটির তাড়া- কই বাবা, এসো। ইশ ভিজে কি দশা হয়েছে তোমার। এই বৃষ্টিতে না এলেও পারতে। আমি একাই চলে যেতে পারতাম। তোমার তো আবার ঠাণ্ডা সহ্য হয় না। টানটা বাড়ে। এই রিকশা দাঁড়াও। নাও বাবা উঠো। তাড়াতাড়ি উঠো।
স্তম্ভিত জাফর সাহেব। কিছুই বুঝতে পারছেন না। মেয়েটি তাকে কিছু বলার সুযোগও দিচ্ছে না। সেই কখন থেকে একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে। এরপর একরকম জোর করেই জাফর সাহেবকে রিকশায় উঠালো মেয়েটি। রিকশা চলতো শুরু করলো। মেয়েটি বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিচ্ছে তাড়াতাড়ি যেতে।
মেয়েটিকে দেখে এবং তার ব্যবহারে মুগ্ধ হলেন জাফর সাহেব। মনে হচ্ছে এ চিরচেনা। আসলেই তার মেয়ে- অহনা।
এতক্ষণে ঘটনার কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন তিনি। প্রথমদিকে কথা বলতে ইচ্ছে করলেও এখন করছে না।
কিছুদূর যাওয়ার পর মনে হলো মেয়েটি দুশ্চিন্তামুক্ত হলো। বললো- আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্য দুঃখিত। এছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না।
জাফর সাহেব বললেন- তোমার বাসা কোথায়।
সামনে ডানে গলির ভেতর। এই রিকশা রাখো। আমি নেমে যাচ্ছি। বাকিটুকু হেঁটেই যেতে হবে। গলির ভেতরে রিকশা ঢুকবে না। আপনি এই রিকশা নিয়েই চলে যান। ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি।
মেয়েটি নামলো রিকশা থেকে। নামলেন জাফর সাহেবও। বললেন-হাঁটো, আমি তোমার বাসায় যাবো।
মেয়েটি আমতা আমতা করে বললো- কিন্তু...।
কোন অসুবিধা নেই। চলো।
সত্যিই যাবেন?
চুপচাপ হাঁটো। নিশ্চিন্ত হওয়ার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি। ছেলে দু’টো এখনও পিছু হটেনি। ওই যে দেখ তারা আমাদের রিকশার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
অসুবিধা নেই। এখানে আসার সাহস ওরা করবে না। তাছাড়া আপনি একেবারে ভিজে গেছেন। যদি কোন...।
এতদূর এসে খালি হাতে ফিরে যাবো ভাবছো? নেভার, ইমপসিবল। চলো, বাসায় চলো।
জাফর সাহেবের এ কথা শুনে মেয়েটি একটু ভড়কে গেল। একি বলছে লোকটা! শেষে খাল কেটে কুমির আনলো না তো ঘরে! কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবলো মেয়েটি। এরপর বললো- ঠিক আছে চলেন।
ডান-বাম করে গলির আঁকাবাঁকা পাক, নর্দমা, ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল, নারকেলের পচা খোসা এবং পলিথিনে আটকে যাওয়া ড্রেনের পানিতে হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়ে যখন বাড়ির গেট পার হলেন ততক্ষণে জাফর সাহেবের উদ্দীপনা ও কৌতূহল ম্লান হয়ে এসেছে। গলা শুকিয়ে আসে তার।
ঘরে ঢুকে মেয়েটি বললো- আপনি এখানে একটু বসুন। আমি আসছি।
জাফর সাহেব ধমকের সুরে বললেন- এই মেয়ে বেয়াদবি আমি একদম পছন্দ করি না। চুপচাপ বসো এখানে। খুব তো বাবা বাবা করছিলে- অথচ কখন থেকে আপনি আপনি করছো, বলি এই বেয়াদবির মানে কি?
মেয়েটির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বললো- দুঃখিত বাবা। আমার ভুল হয়ে গেছে।
সে একটি তোয়ালে নিয়ে এলো। এরপর খুব ভাল করে মুছিয়ে দিলেন জাফর সাহেবের পুরো শরীর। বললো- বাবা, আপনি বসুন আমি একটু চা করে নিয়ে আসি।
না আজ চা খাবো না। এটা পাওনা থাকলো। পরে একদিন এসে খেয়ে যাবো। এখন এক গ্লাস পানি দেও মা। ভাল কথা তোমার নামটাই তো জানা হলো না।
আমার নাম আঁকা।
পানি পান করে জাফর সাহেব বললেন- তুমি কি করো।
আমি মাস্টার্স করছি। আর পার্টটাইম একটি বেসরকারি ফার্মে চাকরি করি।
আর কাউকে দেখছি না। তুমি একা?
মা আছেন। তিনি চোখে দেখেন না। ছানি পড়েছে।
আজ তাহলে আসি মা।
মায়ের সঙ্গে পরিচিত হবেন না?
কোথায় তোমার মা?
নামাজ পড়ছেন। আপনি একটু বসুন।
আজ নয়। তোমার কথা সত্যি। আমার ঠাণ্ডা সহ্য হয় না। কাপড় পরিবর্তন করা জরুরি। অন্য একদিন এসে তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলবো। তাকে আমার সালাম দিও।
জাফর সাহেব বেরিয়ে গেলেন।
চলবে
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-৩
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-২
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-১