চকচকে স্টিলের গোল তালাটায় চাবি প্রবেশ করাই। ডানে মোচড় দিতেই ক্লিক করে খুলে যায়। ভেজানো কাঠের দরজাটা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করি। ভ্যাপসা গরম বাতাস চোখে-মুখে লাগে। দরজা-জানালা বন্ধ ছিল সকাল অবধি। একটা গুমোট আবহাওয়া তৈরি হয়েছে। তাড়াতাড়ি চার ফুট লম্বা ছাই রঙা জানালাটা খুলে দেই। দোতলা হতে বাইরে তাকাই একটু বাতাসের আশায়, বৈদ্যুতিক পাখার হাওয়ায় আশ মেটেনা , চাই প্রকৃতির আদর মাখা শীতল হাওয়া। কিন্তু বাইরে তাকিয়ে ও মা, সর্বনাশ! ঈশান কোনের পুরোটাই ফিকে ছাই রঙ মাখানো। ফাঁকে ফাঁকে সাদা-হলুদের ছোপ ছোপ দাগ। একটা শৈল্পিক রূপ নিয়ে কাল বৈশাখি হানা দিতে আসছে এই ভর দুপুরে। আন্দাজ করতে কষ্ট হয়না। দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা, বাবার থেকে পাওয়া। কিছুটা জেনেটিক্যাল বাকীটা প্র্যাকটিক্যাল। প্রকৃতি চেনার অভূতপূর্ব কিছূ সিম্পটম।
এখনতো আর ক্লাস নেই, পরীক্ষা চলছে। নো টেনশান, মূহুর্তেই ডিসিশান নিয়ে ফেলি। কী আছে কুল-কপালে, আজ বৃষ্টিতে ভিজবোই। কে আমায় করবে বারণ? কেউনা। কেউনা।। অনেক দিন কেটে গেছে বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি। ইদানিং ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। এতে সব ইচ্ছে ঘুড়ির লাটাই ঘুরিয়ে সূতা গুটিয়ে রেখে দিয়েছি। কোন খায়েশেই আর পুরণ হতে দেইনি। আজ ঘুড়ির লাটাই সূতো দিলাম ছেড়ে। যেথায় খুশি, যাকনা চলে দিগি¦দিক।
টপস খুলে উদাম গায়ে বেড়িয়ে পড়ি। মনে পড়ে গত হপ্তায় বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই ‘ক্যাটস এন্ড ডগস’ শুরু হয়ে যায়। সবাই পড়িমড়ি করে যাত্রী ছাউনীর ভেতরে গিয়ে দাঁড়াই। অনাকাঙ্খিত এই বর্ষনে রাস্তা প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। ঠিক তখনই এক তন্বী। কিশোরী নয় আবার তরুনীও নয়। দুয়ের মাঝামাঝি বয়স হবে। রিক্সার হুডতোলা ছিলো। শুধু মুখটা বাইরে বার করে, চোখ দুটো আকাশের দিকে আধবোজা রেখে, চিবুক খানা মেলে ধরে। পরম আনন্দে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছিল। দেখে আমার মনের মধ্যে আকুপাকু করতে থাকে। ইশ! যদি আমি এখনই ওর মতো ভিজতে পারতাম। ইচ্ছাটাকে গলা টিপে থামাতে হয়। সেদিনের সেই বাসী ইচ্ছেটা আজ আমার ভেতরে দানা বাঁধতে থাকে। সাত-পাঁচ না ভেবে টাওয়েল-বালতি রেডি রেখে দরজায় তালা লাগাই। ততক্ষনে শুরু হয়ে গেছে ঝড়ের তান্ডব। জানালার ওপাশটায় এক চিলতে মাঠ মতো, তাতে সবজী বাগান। মাঝখান দিয়ে কয়েকটি শাল, গজারি, তেলশূর, আর আমের গাছ। একটা কলাগাছ হাওয়ায় দুলছে। পাতাগুলো মাতাল ঝড়ো হাওয়ায় থিরথির করে কাঁপছে। পাশের তালগাছটি তার পাখনার চামড় দুলিয়ে আকাশের দিকে মুখিয়ে আছে। যেন এখনই রওয়ানা হয়ে যাবে চন্দ্রলোকের দেশে। গাছের সারির ওপাশটায় মামাদের সার বাঁধা প্রাইমারি স্কুলের ঢঙে সাজানো ঘর। সাদাটে চুনকাম করা ছোট ছোট কক্ষ। তাতে বউ-বাচ্চা নিয়ে গাদাগাদি করা সংসার। সেখানে বাস করে হরেক কিসিমের মামা। ফুল মামা, চাবি মামা, ঝাড়– মামা, আগুন মামা, পানি মামা, বিদ্যুৎ মামা, জুতো মামা, আয়রন মামা, সিক মামা, কাঠ মামা থেকে থেকে শুরু করে প্রায় চব্বিশ রকম মামা। সবাই অবশ্য বাসা ভাগে পায়নি। যারা পায়নি তারা ব্যাচেলর কোর্য়াটারে থাকে। মামাদের ওদিকটায় ঝড়ের তোড়ে মড়মড় করে গাছ ভেঙে পড়ার মতো আওয়াজ হতে থাকে। আমি তখন নির্ভয়ে করিডর ধরে হেঁটে চলেছি। দু’এক জনের সাথে দেখা হয়। তাদের বৃষ্টি ভেজার পয়গাম জানাই। কেউ না করেনা, তবে তখনই কেউ তৈরিও হয়না। আস্তে আস্তে দোতলার করিডর পেরিয়ে নিচতলায় চলে যাই। এবারও কিছু লোককে দাওয়াত দিতে হয়। একেই হয়ত বলা হয় সৌজন্যতাবোধ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকি, কখন বৃষ্টি হয়। দেখতে দেখতে বাতাসের বেগ কমে আসে। এবার ঝুপঝাপ বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। তড়িৎ গতিতে চশমা আর চাবির ব্যাগটা নিচতলার এক ছোট ভাইয়ের নিকট জমা রাখি। এবং সবুজ বিশলাকার মাঠের মাঝেখানে গিয়ে দাঁড়াই। নিমিষেই হিমশীতল জলের তোড়ে সব ক্লান্তি দূরে-বহু দূরে চলে যায়। কী এক অজানা আশঙ্কায় বুকে কাঁপন শুরু হয়। এর কারণটা বুঝতে দেরি হয়না । ছেলেবেলায় বৃষ্টিতে ভিজলে বাবার লাঠি আর মায়ের বারণ দুটিতে মিলেমিশে এক হয়ে সব বাঁধনহীন আনন্দকে মাটি করে দিত। কিন্তু আজ আর বাঁধা দেবার কেউ নেই। এতেই বুকের মাঝে কষ্ট জমাট হয়। বাবাতো ২০০২ থেকে না ফেরার দেশে, তিনি আর কখনো বাঁধা দেননা। মা বাঁধা দেন তবে তিনি এখন রয়েছেন প্রায় ৫৪ কি.মি দূরে। এই বারনহীন ভেজাটা আর উপভোগ্য থাকেনা বেশিক্ষণ। মনে পড়ে ছেলে বেলায় ভাই-বোনের সাথে বাদল দিনে বানের জলে লুকোচুরি খেলার স্মৃতি। আজ তো কোন সঙ্গী নেই। নতুন সঙ্গী তৈরি হলে তার সাথেই ভেজা হবে হয়ত। এমন কল্পনাও মনে আসে।
পশ্চিম দিক থেকে দমকা বাতাসের সাথে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বরফ কুচির মতো মুখে এসে বিঁধতে থাকে। নিমিষেই ঠান্ডায় হি হি ধরে যায়। হয়ত এটাই হল লাইফের শেষ বৃষ্টি ভেজা! বন্ধু সাগর এসে কখন যে করিডরে এসে দাঁড়িয়েছে, ধোঁয়ার মতো বৃষ্টির ছাঁট ভেদ করে দেখা সম্ভব হয়নি। হাইইইইই... বলে চেঁচিয়ে উঠে দূর থেকে। এবার পেয়েছি এক মোক্ষম সুযোগ। দৌড়ে গিয়ে হাত ধরে ওকে সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠে নামিয়ে আনি। ও কিছুতেই নামতে চায়না। আমি জোড়াজুড়ি করতেই থাকি। শেষে আমারই জয় হয়। কেয়া, কামিনী আর হাসনা হেনার ঝোপের পাশ ঘেঁষে আমরা ভিজতে থাকি।
আর মাত্র ক’দিন। তাহলেই বিদায় ঘন্টা বেজে যাবে। ‘যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।’ কথাগুলো বেশ কমন। কিন্তু মেনে নেয়াটা বড় কঠিন, বৈকি! স¤প্রতি আমার এই ঐতিহ্যবাহী হলটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অর্ন্তভূক্ত হয়েছে। শুনছি বছর কয়েক বাদে হয়ত পুরাতাত্মিক জাদুঘর হয়ে যাবে। সেটা পরের কথা কিন্তু ছেড়ে যাবার কথা মনে এলে আমার এখনই কান্না পায়। পাকাপোক্তভাবে থাকার একটা বন্দোবস্তও করা যায় অবশ্য। ‘জ্বালোরে জ্বালো, আগুন জ্বালো’ স্লোগানের সাথে গলা মিলিয়ে। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি, একটু আলাদা ঠেকে। অনেকটা মাদুলি দিয়ে প্রেয়সিকে বশ করে রাখার মতো। মাদুলিই যদি দিলেম, তবে সে আবার প্রেয়সী হলো কী করে? সে তো নিজের অনুভূতি থেকে আমায় ভালো বাসছে না। সে তো এক কলের পুতুল। তাঁরে কি আমি পেলুম আপন করে?
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১১ রাত ১:১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




