হেমন্তের রিনিঝিনি বাতাস বয়ে চলা হিমহিম বিকেল। সারা বাড়ি জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে দু’টি বেল গাছ । তাতে ফুল এসেছে। বেল ফুলের কড়া মিষ্টি গন্ধে মৌ মৌ করছে। বেল গাছে বাসা বেঁধেছে মৌমাছি । সেখানে মৌচাকের রানী মৌমাছিটি তার রাজাদের টেক্কা দিয়েছে। এখন সে নিজেই সম্রাজ্ঞী সেজে বসে আছে বেল গাছের মগডালে। হিন্দুস্থানের মানচিত্র আকৃতির বিশাল মৌচাক। ঝাঁকে ঝাঁকে কর্মী মৌমাছি ব্যস্ত সন্ত্রস্ত। বেল ফুল আর বাতাবী লেবু ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করছে। সর্ন্তোপনে সেগুলো জমা দিচ্ছে চাক পাহারায় থাকা অন্য কর্মীদের হেফাজতে। এখন নতুন ধান কাটা চলছে চারদিকে। সোনালী পাকা ধান মাড়াই চলছে উঠোনে। সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে উৎসবের আমেজ । সে দিন ক্রিকেট খেলা শেষ করেছি। সবে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে বাড়ী ফিরছি। সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। দূর দিগন্তে সূর্যটা ঈষৎ লালচে আবীর মেখেছে। পাটে নেমে যাবার পাঁয়তারা করছে। মাঠের ধান কাটা কর্মজীবি লোকগুলো বাড়ীর পথ ধরেছে। কেউ কেউ আর নিজ বাড়ীতে ফিরে যাবে না। কাটা ধানগুলো মাড়াই করার কাজে মেতে উঠবে। রাত অবধি চলবে তাদের ধুম-ধাম শব্দে আঁটি বাঁধা শীষ হতে ধান ছাড়ানোর কাজ। তাঁত শিল্পীরাও নিজেদের তাঁতগুলো বন্ধ করে, কাপড় ভাঁজ করে মহাজনের নিকট জমা দিচ্ছে। তারপর একে একে বাড়ীর পানে রওয়ানা করছে।
হঠাৎ শাহেদদের বাসায় শোরগোল শোনা যায়। ধীরে ধীরে তা স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর হতে থাকে। প্রথমে কানাকানি, তারপর উচ্চকিত গালাগাল। এর পর ক্রমেই বাড়তে থাকে সেটা। লাঠিপেটা, গালাগাল, মিহি স্বরে কান্না, আর্তনাদ, বিলাপ, প্রার্থনা, টুংটাং, ধুপধাপ, গুঞ্জন সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আমি সচকিত হই, আমার ভাই-বোনেরাও উঁকি-ঝুঁকি মারতে শুরু করে। বোঝা যায়না কী হচ্ছে পাশের বাড়ীতে। আস্তে ধীরে গ্রামের অনেক লোক আসে। তারা শাহেদদের উঠোনে ভিড় করে। সবার মুখে একই কথা। একি হলো; কী হলো? কী হবার ছিলো, কী হয়ে গেল! মূহুর্তেই সারাটা গ্রাম রাষ্ট্র হয়ে যায়। বাকী লোকজনও নিজ নিজ কাজ ফেলে তামাসা দেখতে ছুটে আসে।
ঘটনা খুব অস্বাভাবিক নয়, তবে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশী। আমাদের শাহেদ বিয়ে করেছে!?। যা, বাবা একেবারে বিয়ে করে ফেললো? পড়শীরা এসে মায়ের নিকট গল্প জুড়ে দিলো। তাতে ঘটনা যা বোঝা গেল সেটা ছিলো ঠিক এরকম- শাহেদের সাথে তার সহপাঠী রুমার প্রেমের গুঞ্জন ছিলো। সেটা বাস্তব। দু’জনেই দু’জনকে মনো-প্রাণ সঁপে দিয়েছিলো। সেই ক্লাস নাইনে থাকতে শুরু। আর তাতেই বুঝি বিদ্যার দেবী বেশ রূষ্ট হয়েছিলেন, তাদের দু’জনার প্রতিই। দু’জনের একজনও মেট্রিকে উতরে যেতে পারেনি। তাই বলে তাদের প্রণয়ে ভাটা পড়বে, মোটেও তেমনটা হয়নি। বরং বাঁধ ভাঙা বেনো জলের মতোই প্রবল বেগে দু’কূল ছাপিয়ে চলেছে সমুখ পানে। তাদের এমন মরণ-পণ অবস্থা বুঝতে পারেন রুমার মধ্যবিত্ত বাবা। তিনি গ্রামের আরো দু’চার জনের সাথে সলা পরামর্শ করেন। এরপর দিন ক্ষণ দেখে তাদের পাকাপাকি বিয়ের বন্দোবস্ত করেন। নইলে যে আর গাঁয়ে মুখ দেখাতে পারা যায়না। মেয়ের ঘর বলে কথা। শেষ কালে কিনা আবার মেয়েটা কুলটা বদনাম কুড়ায়। আর সারা জীবনের জন্য বাপের ঘাড়ে বসে অন্ন ধ্বংস করতে লাগে।
অন্যদিকে শাহেদদের অবস্থা বেশ সচ্ছল। তাদের অর্থ-বিত্ত, জনবল সব রমরমা। শাহেদ দেখতেও রীতিমতো ফিল্মি হিরো। কিন্তু হলে কী হবে, তার বড় রয়েছে আরো পিঠেপিঠি তিন তিনটি ভাই। যারা এখনো বিয়ে-শাদী করেনি। পালোয়ানের মতো বিশাল শরীর একেক জনার। নতুন লুঙ্গীর কোচা হাতের মুঠোয় ধরে হুমহাম করে গ্রামময় ঘুরে বেড়ায় তারা। এমন তিনটি বড় ভাই রেখে শাহেদ কী করে তার সম্পর্কের কথা প্রকাশ করবে? কী করে তার মনের অতৃপ্ত হাতছানির কথা মাকে জানাবে! সে পারেনি। এদিকে সদ্য চির বিদায় নিয়েছেন শাহেদের বাবা। সেই আঙ্কেলের কথা মনে হলে দু’চোখে জল এসে যায়। এইতো সেদিন হজ্জ থেকে দেশে ফিরে এলেন। এক দুপুরে আমাদের বাসায় মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে আপুদের সাথে গল্পগুজবে মন দিলেন। এক এক করে চেনালেন, মক্কা, মদিনা, জিদ্দা, মুজদালিফা। শোনালেন আগুন ঝড়া মরুর বুকে তীর্থ যাত্রার অকৃত্রিম প্রশান্তিভরা কাহিনী। সেই মানুষটি মাস ছয়েক পার হতে দেননা। কিডনি নষ্ট হবার অজুহাত দেখিয়ে বিদায় নেন। একেবারে চিরতরে। এরপর থেকে সংসারের পুরো হাল ধরে থাকেন তিন ব্যক্তি। শাহেদের মা, বড় ভাই এবং ছেলেবেলা থেকে বোনের আঁচল তলে থাকা সদ্য বিবাহিত মামা। সবে মাত্র শাহেদের বড় ভাই বিয়ে করলেন। এখন মেঝ ভাইয়ের পালা। ঘটকেরা বারবার দিকে দিকে ছুটে বেড়াচ্ছেন। আর কপালের ঘাম মুছে চলেছেন। শাহেদের এহেন বিয়ের খবর শুনে, তাদের কপালেও দুটো করে ভাঁজ পড়ে। আহ-হারে বেচারা, গেলতো একটা ক্লায়েন্ট হাত ফসকে।
শাহেদের শ্বশুর নিজ দায়িত্বে তাদের বিয়ে করিয়ে দেন। এরপর গাড়ী হাঁকিয়ে দেন শাহেদদের বাড়ী পাঠিয়ে। আজ সন্ধ্যায় শাহেদ নববধূসহ বাড়ীতে পা রাখা মাত্রই তুলকালাম বেঁধে যায় চারিদিকে। শাহেদের মা বুক চাপড়ান। তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে যায় বউটি। শেষেমেষ কষে মারা এক লাথিতেই ভূমিশয্যা নেয় সে। মোটা এক কাঠের বাটাম হাতে ছুটে আসেন শাহেদের মা জননী। এসেই শাহেদকে বেদম মারতে থাকেন। তাকে মারের হাত থেকে বাঁচাতে যায়। গিয়ে দু’চার ঘা খেয়ে কালশিরে পড়া মুখটা দ্রুত আঁচলে লুকিয়ে ফেলে সদ্য কনে সাজা আদম সন্তানটি। বাড়ী ভর্তি এক হাট মানুষের মাঝে সে কি লজ্জা। কারো মুখে রা নেই। মামা, দুলাভাই, বড়ভাই সবাই নির্বিকার। মা এবার দ্রুত হাতে নম্বর নেন। গ্রামীন ফোনের ডায়াল চেপে রুমার মাকে পেয়ে যান। এরপর এমনতর অশ্রাব্য গালি গালাজ শুরু করেন যে, সেদিন শ্যাওড়াতলা, হিজলতলা, বটতলার সকল ভূত-পেতœী পর্যন্ত পাশের গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আর কাহাতক সহ্য করা যায়। কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। শাহেদের মা এবার গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন,‘তাদের এ বাড়ীতে কোন স্থান নেই’। সোজা যেন বাড়ী হতে বেরিয়ে যায় তারা। কী আর করা। মুখে লম্বা ঘোমটা টেনে গলার মধ্যে কষ্টের একটি ডেলাসমেত শাহেদের হাত ধরে বউটি। এরপর নিরেুদ্দেশের পথ পা বাড়ায় দু’জন। দু’চোখ হতে প্রবাহমান নোনা জলের ধারা, নিরবে বয়ে চলে কড়া মেকআপের মাঝখান বরাবর।
শাহেদের অবস্থা হয় রীতিমতো দেখার মতো। তার চোখে নেই কোন শঙ্কা, দ্বিধা কিংবা ভয়। একেবারে ভাবলেশহীন। কান্নার ছিটেফোঁটা নেই কোথাও। রীতিমতো আগুন জ্বলছে ধকধক করে। মনে হয় নিমিষেই জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দেবে এ জগৎ সংসার। কোন মূল্য নেই এ সমাজের, এ সমাজের বিধান মানা মানুষগুলোর। যারা মানুষের মন বোঝেনা, মানুষের ভালোবাসা নিয়ে পুতুল খেলে। তাদের এ পৃথিবীর বুকে না থাকাই মঙ্গলজনক। ভাবতে থাকে এমন আরো অনেক কিছুই। সে ফুঁসে ওঠা বিদ্রোহী সৈনিকের ন্যায় রাস্তার দিকে পা বাড়ায়। জানেনা কোন দিকে যাবে। শুধু জানে তাকে বাঁচতে হবে। তার ভালোবাসার জন্যই তাকে বাঁচতে হবে। ভালোবাসার জন্য সে তার বাবা-মা, ভাই-বোন সব ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। সে হার মানার মতো পুরুষ নয়। তাকে যে জিততেই হবে। এখনতো সে আর সেই ছোট্ট খোকাটি নেই। এক এক করে সে ১৫টি বসন্ত পেরিয়ে এসেছে। তারপর সে পেয়েছে রুমাকে। এখন তার বয়স টেনেটুনে ১৯, রুমার ১৭। এ বয়সেই দু’জনকে নিতে হচ্ছে জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্ত। যা হবার কথা ছিলো অতি সহজে, তা আজ হচ্ছে অতি বেদনার্ত আর তীব্র শ্লেষমাখা নিষ্ঠুর বাস্তবতার মিশেলে। কী অন্যায় ছিলো তাদের? শুধুইতো ভালোবাসা। এটা কি অন্যায়? তবে স্রষ্ঠা কেন নারী-পুরুষের মাঝে এমন আকর্ষণ তৈরি করে দিলেন? এটাই কি তবে পরীক্ষা!
আর ভাবতে পারেনা তারা। দু’জোড়া পা আড়ষ্ট হয়ে আসে। মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। ঠোঁট আর গলার ভেতরটা শুকিয়ে গ্রীষ্মের দুপুরের মতো কাঠফাটা হয়ে যায়। চোখে অন্ধকার দেখতে থাকে। ধীর পদক্ষেপে তারা চলতে থাকে অনির্দিষ্ট গন্তব্যের পথে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১১ রাত ১:৪৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




