ক্যাম্পাসের সবুজ চত্বরে বসে আড্ডা দিচ্ছে ওরা চারজন। কায়েস, মৌ, অমিত আর রিতা। ভর দুপুর ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। সেদিকে কারো খেয়াল নেই। সবাই বসে হই হুল্লোর করছে বটে কিন্তু ওদের মধ্যে কথা হচ্ছে একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে। সেটা হচ্ছে আসন্ন গবেষণা প্রস্তাবনা সাবমিশন নিয়ে। কার কী টপিক থাকছে, কে কোন পদ্ধতিতে গবেষণা করছে এসব নিয়ে কথা চলছে। সেই সাথে চলছে দেদারছে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক কথামালা। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কার কি মতামত। এর সাথে থাকছে কে কাকে বেশী নির্জলাভাবে পঁচাতে পারে, তার প্রতিযোগীতা। কিন্তু এ নিয়ে কারো মধ্যে কোন ক্ষোভ নেই। সবাই সবাইকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করবে এটাই যেন এখানকার নিয়ম। আড্ডা মারতে মারতেই এখানকার পড়ালেখা হয়ে যায়। ক্যাম্পাসের মজাটাই এখানে।
ওদের দলে আলো ছয়জন বসে। সবাই ক্লাসমেট। প্রতি দিন ওরা ক্লাস শেষে খোলা লনটায় বসে, আজও বসেছে। মাথার ওপরে রক্ত রঙা কৃষ্ণচূড়া। লনে আরো গাছ আছে। সেগুলোতেও থরে থরে ফুল এসেছ। হলুদ সোনালু, বেগুনী জারুল কিংবা ফিকে থেকে গাঢ় গাঢ়তর মাধবী লতা। কায়েস ওদের আড্ডার মধ্যমণি। দেখতে যেমন, কথায়ও তেমন। লম্বায় ছ’ফুট। এক হারা গড়ন। ফর্সা গোল গাল মুখ। ব্যাকব্রাস করা ঘন কালো চুল। নাকের ডগায় একটা চকোলেট রঙা ফ্রেমের চশমা বসানো। এই চশমাটাই ওর মধ্যে একটা আঁতেল আঁতেল ভাব নিয়ে এসেছে।
মৌয়ের এর পুরো নাম মৌমিতা হক। আদর করে সবাই মৌ বলে ডাকে। আজ দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছে কায়েস। গবেষণা কীভাবে করতে হয়। সবাই শুনছে আবার মাঝে মাঝে টিপ্পনি কাটছে। ওদের গবেষণার বিষয়গুলোও অনেক মজার।
রিতা দরদমাখা গলায় বলে ওঠে আমার গবেষণার বিষয় ‘তরুন প্রজন্মের মাঝে এফ এম রেডিও শোনার প্রবণতা’।
সাথে সাথে সমস্বরে সকলেই- মারহাবা, মারহাবা।
এবার অমিত বল তোর গবেষণার বিষয় কী?
অমিত গাল চুলকে উত্তর দেয় তা এই ধর ‘টিভি বিজ্ঞাপন দেখে মেয়েদের ফ্যাশন সচেতন হবার প্রবণতা।’
আবার সকলে চেঁচিয়ে ওঠে। তা কেন? আরে আজব তো শুধু মেয়েরাই ফ্যাশন করে? বাদ বাদ, হয় নাই।
মৌ বলে ওঠে, অমিত হয় তুই ছেলেদের সাথে অ্যাড কর নইলে গবেষণার টপিক বদল কর।
অমিত মাথা দোলায়, আমি করবই, পারলে ঠেকাস, যা যা।
কায়েস ওদের থামায়, আরে আরে বাদ দে।
আবার শুরু করে ‘ডিটারমিনেশন অব টপিক রেলিভেন্স।’ এটা হচ্ছে টপিক বাছাইয়ের কনসেপ্ট। এভাবেই চলতে থাকে। মৌ পড়া শুনছে। মাঝে মাঝে কায়েসের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। কায়েস সেটা বুঝতে পরছে কিন্তু সরাসরি মৌয়ের চোখে চোখ ফেলছে না। সে বিষয়টাকে উপভোগ করছে। মৌয়ের মনটা এমনিতেই ভালো নেই আজ। ওর আপুর সাথে ফোনে ঝগড়া হয়েছে সকালে। ওর আপু একটা প্রায়ভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। রাতে ফোন দিয়ে অনেকক্ষণ ওকে বিজি পায় ওর আপু। তাই নিয়ে সকালে অনেক ঝাড়ি এবং দু’বোনের অনেকক্ষণ ঝগড়া। যা হোক, অন্যদিন অনেক হাসি খুসি থাকে মৌ। আজ কিছুটা চুপচাপ। অনেকক্ষণ পর খাতার ভাজ থেকে একটা বের করে। সবাইকে দেখায় এটা হচ্ছে আমার টপিক। সবার মাথাগুলো এক জায়গায় জড়ো হয়। ঝুকে পড়ে মৌয়ের টপিক দেখে। গোটা গোটা হাতের লেখা। কিন্তু টপিক এত লম্বা চওড়া যে পড়তে পড়তে অসলে কোনটা যে রিসার্চ ফাইন্ডিংস সেইটাই বোঝা যায়না। সবাই চুপ হয়ে যায়। কেউ আসলে বিষয়টা বুঝতে পারেনি। এবার কায়েসের পালা। এতক্ষণ যে কায়েস ধৈর্য ধারণ করে সবাইকে পড়া শোনাচ্ছে। সে হঠাৎ করেই অধৈর্য হয়ে পড়ে।
বলে ওঠে, কিচ্ছু হয়নি! এটা কোন টপিক হলো?
ব্যাস আর কোন কথা নেই দুমদাম কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে মৌ। মুখের অবয়ব পুরো চেঞ্জ হয়ে যায়। চোখের কোণা ভিজে ওঠে। অপমান আর কষ্টের দমকে ঠোঁটদুটো ফুলে ফুলে ওঠে। ব্যাগ গুছিয়ে, চুল নাড়িয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ে। হন হন করে ছুটে চলে মাঠ বরাবর, ঘাসে ঢাকা মাঠের মাঝখান দিয়ে সরু পায়ে চলা পথ বেয়ে। সবাই ওকে থামাতে চায়। আরে আরে মৌ, কী হলো, ওই যাস কই। মৌ কারো কথা শোনেনা। কায়েস কোন রিকোয়েস্ট করেনা। জানে থামাতে চাইলেও থামবেনা। অনেক বেশী একরোখা মেয়ে। এখন হয়ত মন খারাপ, তাই অমন করছে। আবার বিকেলে মন ভালো হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। সেদিন আর বেশিক্ষণ জমেনা। উঠে যে যার মতো কেউ গাড়ী ধরে সোজা বাড়ী নয়ত হলের দিকে পা বাড়ায়।
পরদিন যথারীতি ক্লাসে এসেছে সবাই। কায়েস আজ কালো জিনসের সাথে ক্রিম রঙা ফতুয়া পড়ে এসেছে। দেখতে একেবারে বলিউডের পর্দা কাঁপানো হিরোর মতোই লাগছে। ক্লাসে টিচার তখনো আসেনি। সবাই হই হুল্লোর করছে রীতিমতো। কায়েস মৌয়ের দিকে তাকায়। আঁতকে ওঠে। মৌকে আজ অন্য রকম লাগছে। চেনা যাচ্ছেনা। অসম্ভব সুন্দরী লাগছে। হাল্কা গোলাপী ড্রেসে ওকে মানিয়েছে বেশ। হাতে কাঠের মোটা বালা। কানেও ম্যাচ করা কাঠের পুতির অলঙ্কার। চুলগুলো খুলে রেখেছে। ভিজা, সম্ভবত মাত্র গোসল সেরে এসেছে। ‘বন্ডেজ’ বডি স্প্রের উগ্র স্মেল ছড়াচ্ছে চারিদিক। পদ্ম পাপড়ীর মতো ঠোঁট জোড়ায় মেখেছে হাল্কা গোলাপী লিপিস্টিক। সেই সাথে দুই ভ্রুর মাঝখানে রেখেছে ম্যাচ করা রঙের ছোট্ট একটা টিপ। এতোটাই ছোট, ঠিক যেন ইন্ডিয়ান মসুর ডালের দানা। মসুর ডালের কথা মনে পড়তেই কায়েস আপন মনে হেসে ওঠে। মৌ ওর চোখের দিকে তাকায়, ওর মুখে হাসি দেখে কটমটে চোখে ওর দিকে তাকায়। তাকিয়েই অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। ঠোঁটে অবশ্য হাসির রেখা ফুটে ওঠে। কায়েসের দৃষ্টি সেটা এড়ায়না। কায়েস এগিয়ে যায় মৌয়ের দিকে।
জিজ্ঞেস করে, কী রাগ পড়েনি না? শোন তোমার একটা চিঠি আছে। এই নাও।
হলুদ একটা খাম এগিয়ে দেয় কায়েস। খামের ওপরে লেখা মৌমিতা হক। মৌ চেঁচিয়ে ওঠে আমার চিঠি কই দেখি দেখি। একরকম ছোঁ মেরে সেটা নিয়ে নেয় কায়েসের হাত থেকে। মূহুর্তেই ওর রাগ পড়ে যায়। ক্লাস শেষে তরিঘরি হলে চলে যায় মৌ। লাঞ্চ সেরে চিঠিটা খুলে ফেলে। যা আন্দাজ করেছিল ঠিক তাই। নিশ্চয় কাল খুব দুঃচিন্তা করেছিল, বেচারা। তাই হলে গিয়ে সাথে সাথেই মনের কথাগুলো লিখে ফেলেছে। শিরোনামের নিচে লেখা সন্ধ্যা সাতটা। তার মানে ঠিক গতকাল সন্ধ্যায় লেখা। লেখায় কোথাও কোন রাগ,দ্বেষ, ইর্ষার লেশমাত্র নেই। পুরোটাই বৈচিত্রে ভরপুর। একবার, দু’বার, তিনবার পড়ে। তারপর রাতে পড়ালেখা শেষে খেয়ে দেয়ে ঘুমোবার আগে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কোল বালিশটা বুকে জড়িয়ে ধরে আবার পড়তে শুরু করে আগা গোড়া লেখাটি----------------------------
ভেনাম নয় ডিউ
সন্ধ্যা ৭.০০
আমি কি তোমার পথ চেয়ে
চেয়ে থাকব বসে?
নাকি তুমিই এসে পড়বে আমার কুশল!
জানো, কষ্ট আমি চাইনি দিতে
তোমায়, এই স্বরসতীর দিব্যি কাটছি।
শুধু চেয়েছিলাম বোঝাতে
টপিক কেমন হয়, কীভাবে
তা সিলেক্ট করে আর কিছু নয়।
কিন্তু তুমি যা দেখালে আমায় কাল
ভুলতে পেরেছি আমি
ভোলেনি মহাকাল।
আমি তো থোড়াই কেয়ার করি
ওই চেঁপা গলির মতো কালকে।
যা শুধু পথ ভুলো করে দিতেই জানে।
মনে করে দেখ ভিক্টর হুগোর কথা
সেও পারেনি ফাঁদ গলাতে মহাকালের।
মুচমুচে চানাচুরের ঠোঙা করে
ছুঁড়ে দিলে তুমি কাগজটি
আমি তাকালাম তোমার চোখে
তোমার আইবল ঘন ঘন নড়ছে।
নিন্দুকেরা যতই বলুক,
তোমার চোখে ছিল মালেকা
খানমের তীক্ষ্ণ, তীব্র বিষ।
কিন্তু না, আমি জানি-
সেটা ছিল শুধু ভোরের ঘাসে
চুইয়ে পড়া দু’ফোটা নির্মল শিশির।
বিশ্বাসের হাতে কুঠারাঘাত
কোরনা, প্রয়োজনে কর-
রোজের মতো জ্যাকের হাতে
বিনাশিতে শৃংখল।।
ইতি-
ইমরুল কায়েস।
ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০০৮।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১১ রাত ১০:৪৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




