তিথির মুখটা আজ বেশ শুকনো লাগছে। কী খাটুনিটাইনা খেটেছে। সারা দিন মন দিয়ে সে কাজ করেছে। ঘর ঝাড়– দেওয়া, নতুন বিছানা-বালিশ গুছানো, তোষক-তক্তপোষ থেকে শুরু করে বাটনা বাটা, রান্না-বান্না, মেহমানদের খাওয়ানো। সব একা হাতে গুছিয়েছে। নিজের স্বামীর বিয়ে বলে কথা। ক’জনার ভাগ্যে জোটে এমনটা!
বিয়ে করেছিল সেই আটাশি তে। ভরা বান চারদিকে। ছোট ভাইটাকে কোল থেকে নামিয়ে সেই যে নৌকায় চেপে বসল। আর বছরে দু’একবার ছাড়া কখনো বাড়ীমুখো হয়নি সে। হতে দেয়নি তার স্বামী বাদল। ভালোবাসার চূড়ান্ত স্পর্শ দিয়ে তাকে সারাক্ষণ আগলে রেখেছে। কোন অভাব অভিযোগ তাকে বুঝতে দেয়নি বাদল। নিজে কম খেয়ে তিথিকে খাইয়েছে। বুঝতে দেয়নি তার পেটে এখনো ছুচোর নাচন রয়েই গেছে। মা আর ফুটফুটে বউ তিথি কে নিয়ে বাদলের ছোট্ট সংসার। কওমী জুট মিলে সে শ্রমিকের কাজ করে। মাস গেলে হাজার দশেক টাকা। গোনা পয়সার ঝনঝনানিতে সারাটা মাস পার হতে চায়না। তবু তার মুখে হাসি সারাক্ষণ লেগেই থাকে। এই হাসিমাখা মুখটাকে নিয়েই এই তেইশটা বছর পার করেছে তিথি।
তবে অভাব শুধু একটাই। অনেক চেষ্টা করেও তিথির মা ডাক শোনা হয়নি। বাবা ডাক শোনা হয়নি বাদলেরও। কবিরাজ থেকে শুরু করে ওঝা, পূজা, হোমিও, ইউনানী, এলোপ্যাথিক কিছুতেই কাজ হয়নি। সব শেষে এনায়েতপুরে খাজা ইউনুস আলী মেমোরিয়াল হসপিটাল। সবাই বলেছে এই হসপিটালে ইন্ডিয়ার মতো বড় বড় চিকিৎসা হয়। দুজনেই দেখিয়েছে ডাক্তারকে। কোন রোগ পাওয়া যায়নি। মুখ ভার করে ফিরে এসেছে তিথি। ইদানিং সে শাশুরিকে মুখ দেখাতে লজ্জা পায়।
সেদিন ফুফু শাশুরি একটা মেয়ের সন্ধান এনেছে। খুব সুন্দরী মেয়েটা। বাবা নেই, তাই এই অনাথিনীকে গছিয়ে দিতে চান। প্রথমে রাজী হয়নি বাদল। পরে আত্মীয় আর প্রতিবেশীদের কথা ফেলতে পারেনি। তিথিকে প্রশ্ন করেছিল কী করবে সে? তিথি একবাক্যে সম্মতি দিয়েছে। সে স্বামীর সোহাগের বিনিময়ে তাকে আটকুড়ে করে রাখতে চায়নি। আজ তাই বিয়ে বাদলের। কনের বয়স কম। নাম সুইটি। সারাক্ষণ হেসে হেসে কথা কয়। আলতা পায়ে, গহনা আরা টিপ পড়ে সেজেছে মেয়েটা। অতিথিরা একে একে বিদায় হল। এবার নিজ হাতে বাসর ঘর গুছিয়ে শেষ বারের মতো চারপাশটা দেখে নেয় তিথি। কোন কষ্ট যেন না হয় বাদলের। পাশের ঘরে এবার ডাকতে যায় বর-বধূকে। গিয়ে বলে,‘নেও তোমরা এহন আইস।’ বলতেই মাথার চারপাশটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠে। চোখের সামনে আঁধার হয়ে পৃথিবীটা। পা টলমল করে ওঠে। ধুপ করে পড়ে যায় তিথি। দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে বাদল। কোলে করে নিয়ে যায় কলতলায়। মাথায় পানি দিতে থাকে। বাদলের চোখের কোনা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। মেয়েটা কী করবে ভেবে পায় না। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




