সেদিনের সেই ঘোর অমানিশার রাতে দেবদূতের মতো সাহায্যের হাত বাড়ান যে মানুষটি, তিনি শাহেদের ছোট মামা। নতুন বর-কনেকে জোর করে নিয়ে নিজ বাড়ীতে আশ্রয় দেন। তাদের সাহস দেন, ভরসা দেন বাস্তবতাকে মেনে নেবার। পরে শুনেছিলাম শাহেদের মামা প্রতি সপ্তাহে এসে শাহেদের মা, দুলাভাই সবার সাথে নিয়মিত আলোচনায় বসে বিষয়টি ফায়সালায় মনোযোগ দিয়েছিলেন। শাহেদের পরিবার এক্ষেত্রে কঠোর হতে পারেনি দুটো কারণে। এক. শাহেদের শ্বশুর ৫ লাখ টাকা মোহরানা দিয়ে তাদের বিয়ে দিয়েছিলেন, ফলে তালাক দিলে মোহর পুরোটাই ফেরত দিতে হবে। দুই. শাহেদ দৃঢ়তার সাথে এই বিয়েকে সর্মথন করেছিলো, এতে কোন প্রকার মামলা করার সাহস করেনি তার পরিবার।
এসময় উচ্চ শিক্ষার্থে আমি রাজধানীতে চলে আসি। শাহেদদের কোন প্রকার খোঁজ আমি রাখতে পারিনি। এরপর প্রথম ঈদুল আযহায় বাড়ী গেলাম। নামাজ শেষে ঈদগাহ থেকে ফেরার পথে শাহেদের সাথে দেখা। অনেক বদলে গেছে সে। বদলে গেছি আমি নিজেও। কারণ শত ব্যস্ততার মাঝে শাহেদের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। প্রতিবার ঈদে নামাজ পড়তে যাবার সময় ওর সাথে দেখা হত। আজ দেখা হলো নামাজ শেষে। কারণ সে আর তাদের বাড়ীতে থাকেনা। শাহেদ কুশল বিনিময় করলো। তার চোখে আগের মতোই দীপ্তি খেলা করছে। কোন হার নয়। জেতার লক্ষ্যেই মাঠে নামা। এটা ওকে দেখলেই কেবল শেখা যায়। ওর বর্তমান জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হয়। বাড়ী ফিরে আসি।
বিকেলে তরুর নিকট সব খবর নেই। তরু শাহেদের প্রতিবেশী। উত্তর পাড়ায় থাকে। সেদিনের পর থেকে শাহেদকে বাড়ীতে তোলা হয়নি। তাকে তাদের পুরনো বাড়ীতে থাকতে বলা হয়েছে। সেখানে টিনের দুটো ঘর। রোজগারের সম্বল হিসেবে দেয়া হয়েছে ছয়টি হাতে চালানো তাঁত। সেগুলোতে শাহেদ শাড়ী তৈরি করে। সকল পরিশ্রম শাহেদের একার। শাড়ী বোনার আগে তাঁতের তেনা তোলা, শানা, ব গুছিয়ে দেয়া। সব কাজ শাহেদ করে। শ্রমিকরা সারাদিন কাপড় বোনে। সেগুলো হাটে বিক্রিও করে সে একাই। বউটা সুতো পাড়ী করা, পাকানো, নলি সিদ্ধ করা সব করে। কাপড় ভাঁজ করতেও সাহায্য করে। বিরতিহীন কাজ। তবু দুজনের মুখে সারাদিন হাসি লেগেই থাকে। প্রথম প্রথম এই পোড়ো বাড়ীতে থাকতে বউটার খুব ভয় ভয় করতো। পরে কোল জুড়ে এল একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান। এবার তাকে নিয়েই সময় পার হয়ে যায়। কখনো বিদ্যুৎ চলে যায়। ঘুটঘুটে আঁধার হয়ে যায় চারিদিক। শাহেদ সে সময় বাড়ী না থাকলে খুব ভয় হয় ওর।
শুনলাম এবার ঈদে খাসী কোরবানী করছে। দেখতে দেখতে বেশ সচ্ছল হয়ে উঠছে তারা। পরের বছর আবার ঈদে বাড়ী গেলাম। এবার দেখলাম শাহেদের কোলে একটি নয় দুটো কন্যা সন্তান। বেশ সুখী সুখী চেহারা হয়েছে শাহেদের। শরীরটাও বেশ খোলতাই হয়েছে। ভারী আনন্দ হয় আমার। জিজ্ঞেস করি ভাবীসাব কেমন আছে? চিরাচরিত সেই হাসিমাখা উত্তর, হ্যাঁ অনেক ভালো। কেমন পেশাদারি একটা ভাব চলে এসেছে তার মধ্যে। কিংবা বলা যায় সংসারের কঠিন বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে সে।
এভাবে কেটে যায় আরো একটি বছর। পরের বছর দেখি দুই কোলে দুটো মেয়ে শিশু, আরো একটি মেয়ে বাবার লুঙ্গীর কোনা ধরে হাঁটছে। কী মজা, আমাদের শাহেদ এখন তিনটি কন্যা সন্তানের গর্বিত জনক। আর রুমা তিন কন্যা সন্তানের জননী। এই কন্যাদের সুবাদে শাহেদের উপার্জনেও এলো বেশ পসার। ফলে গ্রামের লোকেরা বলাবলি করতে লাগলো শাহেদের মেয়েগুলো কপাল নিয়ে জন্মেছে। তাই তাদের এত টাকা হচ্ছে। সেবার শুনলাম, শাহেদ ইয়া বড় এক ষাঁড় কোরবানী করছে। শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। শুনেই শান্তি। বিপদের দিনে আমি শাহেদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। আজ অন্তত দিল থেকে খুশী হয়ে পাপটা মোচন করি।
*** আগামী পর্বে সমাপ্ত করার আশা রেখে এখানেই মাউস রাখছি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




