-আপু চল!
-দাঁড়া, নয়নের একটা মেইল আসার কথা, ওটা নিয়ে নেই।
-নাহ্ বিরক্তিকর অবস্থায় ফেললিতো। সেই দুইটা থেকে এসে বসে আছি। এখন ঘড়িতে সাড়ে তিনটা। তোকে নিয়ে আর পারিনা।
-আর একটু অপেক্ষা করো সোনা।
কী আর করা। বসে বসে ভেরেন্ডা ভাজি। আসলে আপু মানে আমার কাজিন নুসরাত ছোটবেলা থেকেই কাজ পাগল। পুরো নাম নুসরাত জাহান। পেশায় বিএসএমএমইউর ডেন্টাল সার্জন। আজ এক সাথে বই মেলায় যাব বলে কলেজ থেকে বেড়িয়েছি। কিন্তু আপু সকাল থেকে রোগী দেখে দেখে হয়রান। আমি তিন তলার ব্যালকনিতে দাঁড়াই।
-এইতো এসেছে! আপু চেঁচিয়ে ওঠে শিশুর মতো।
-কী রে মেইল দেখে এত্ত খুশী। বিশেষ কোন...?
-নারে, তুই চিনবি না, পাগল একদম লোকটা। কী সব কান্ড যে করে মাঝে মধ্যে?
-কে?
-নয়ন।
-নয়নটা আবার কে?
-পড়ে শুনিস, চল এখন, বেড়োই। সন্ধ্যা নামবে আবার।
বইমেলার দীর্ঘ লাইন ঠেলে এগোই। দুজনে ঘুরে ঘুরে বই কিনেছি অনেক। আমি পাঁচটা, আপু সাতটা। ঢাউস প্যাকেট নিয়ে সাড়ে সাতটা নাগাদ মেলার বাইরে আসি। বসে পড়ি টিএসসির ফুটপাতের বেঞ্চিতে। চটপটি মামাকে তাড়া লাগায় আপু।
-অ্যাই মামা, বেশী ঝাল হবে বুঝেছেন?
-হ, বুঝছি।
-চটপটি খেতে খেতে গল্প শুরু হয়।
-আপু এবার বল।
-ও শুনবি? আচ্ছা শোন...
নয়ন নামের ভদ্রলোকটি আমার এক বন্ধুর ক্লায়েন্ট। ওই যে সাইক্রয়াটিস্ট হীরেন্দ্র সরকার আমার বন্ধু, তার রোগী বলতে পারিস। ওর কাছে প্রথম আমি গল্প শুনি। এক জটিল কেস।
নয়ন প্রথমে আসে বছর দুয়েক আগে। হীরেন ওর সেশন নেয়া শুরু করে। প্রথম দিকে সে রাস্তায় বেরোতে পাড়তো না। সারাক্ষন গৃহবন্দী করে রাখা হতো। রাস্তায় বের হলেই দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠত। ড্রাইভার কিছু বুঝে ওঠার আগেই কিল ঘুষি মারতে শুরু করতো। হই চই করত..
-তোরা আমার পাপড়িকে ছিনিয়ে নিয়েছিস না? এবার মজা দেখ।
যাত্রীরা ওকে শান্ত করতো। কখনো গণ পিটুনি খেত। এর পেছনে ছিলো ওর এক করুণ ইতিহাস-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলো পাপড়ি মানে হ্যাপি। পাপড়ি নামটা নয়নেরই দেয়া। তুখোড় বিতার্কিক ছিলো হ্যাপী। দুই দুইবার আন্তহল বিতর্কে প্রথম হয় সে। এরপর টেলিভিশন বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন হলে আরো তিন শিক্ষার্থীসহ সার্ক বিতর্ক প্রতিযোগীতায় পাঠানো হয়। ওরা চলে যায় দিল্লি। সেটা ২০০২ এর দিকে। একে একে শ্রীলংকা, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান আর মালদ্বীপকে বিতর্কে হারিয়ে ফাইনালে যায় দুটি দেশ। ভারতের পক্ষে নয়ন আর বাংলাদেশের পক্ষে দলনেতা ছিলো হ্যাপি। ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ নিয়ে চলতে থাকে উত্তপ্ত বাক্য হানার খেলা। সকল বিতার্কিক আর মডারেটর ওদের কোয়েশ্চেন-অ্যানসার পর্বে রীতিমতো হতবাক। দুজনেই হয় চ্যম্পিয়ন। এরপর হ্যাপি দেশে ফিরেই চিঠি পায় নয়নের। নয়ন সম্পর্কে অনেক বিষয় জানতে পারে সে। হ্যাপিও পাল্টা উত্তর দেয়। এরপর চলতে থাকে ইমেইলে লেনদেন। বছর গড়িয়ে যায়। ততোদিনে দুজন পরস্পরের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে।
নয়নের জন্ম নাটোরে। বয়স যখন নয় বছর তখন ওর বাবা ইন্ডিয়া পাড়ি জামান। সেই থেকে স্কুল ,কলেজ শেষে পড়তে যায় ব্যাঙালোরে। সেখান থেকেই সার্ক বিতর্কে অংশ নেয়া।
সময় গড়ায়। পড়ালেখা আর মন দেয়া-নেয়ায় কোন ভাটা পড়ে না। কারণ দুজনেই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। এক গ্রীষ্মের ছুটিতে ঢাকায় বেড়াতে আসে নয়ন। ঝাড়া বিশ দিন ক্যাম্পাসে আড্ডা দেয় ওরা। কখনো চারুকলার বকুলতলা, কখনো টিএসসি চত্বর। কখনো রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফুলার রোড। তবে লালবাগ কেল্লার সবুজ ঘাসে ঢাকা লনে পা ডুবিয়ে গল্প করতেই বেশী পছন্দ করতো হ্যাপি। নয়ন ওর ডায়েরীতে এর সবই লিখে রেখেছিল। লাল গোলাপের কলি বড় বেশী ভালোবাসতো হ্যাপি। তাই প্রতিদিন সকালে লাল গোলাপের কলি নিয়ে হাজির হতো নয়ন।
গুনগুন করে গান ধরতো-অঞ্জলী লহো মোর...সংগীতে....।
তবে হ্যাপিও কম যায়নি। খুব ভোরে পাবলিক লাইব্রেরী চত্বর থেকে বকুল ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে দিত নয়নকে। দেখতে দেখতে ছুটি শেষ হয়। আবার ইন্ডিয়া চলে যায় নয়ন। রেখে যায় এক রাশ স্মৃতি।
আরও একটি বছর গড়ায়। বইমেলা শুরু হতে আর খুব বেশী দেরী নেই। নয়নের ভার্সিটি ছুটি। ঢাকায় আসার তারিখ ঠিক করে সে। নয়নের আসার খবর শুনে কাঠ বেলী মালা দিয়ে খোপা করতে চেয়েছিল হ্যাপি। কিন্তু কী এক জরুরী অ্যাসাইনমেন্টের কাজে সে সেগুনবাগিচা গিয়েছেলো। এদিকে দুপুরে এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি করে ক্যাম্পাসের দিকে রওয়ানা দেয় নয়ন। বুকের মধ্যে সকাল থেকেই খাঁ খাঁ শূন্যতা নয়নের। তার পাপড়ির সাথে দেখা করার তর সইছেনা আর। হঠাৎ ট্যাক্সি শাহবাগ মোড়ের আগে থেমে যায়।
-মামা নামেন, ট্যাক্সি আর যাইবনা।
-কেন?
-মনে হয় সামনে অ্যাক্সিডেন্ট হইছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নয়ন গাড়ী থেকে নেমে পড়ে। দুই হাত ভর্তি ব্যাগ। পাপড়ির জন্য উপহারে ঠাসা। মাঝপথে লোকের জটলা। হঠাৎ পা হড়কে পড়ে যায় সে। ভিড়ের মাঝখানে দিয়ে দেখা যায় হলুদ পোষাকের হ্যাপিকে। ওরই কিনে দেয়া। ফুলের দোকানগুলোর উল্টোদিকে পড়ে আছে নিথর দেহ। বাসের চাকায় মাথা পিষ্ট হয়ে মগজ ছড়িয়ে পড়েছে পিচঢালা পথে।
সহ্য করতে পারে না নয়ন। জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিস্কার করে। প্রায় অর্ধ উন্মাদ হয়ে কাটায় দুটি বছর।
এরপর সেশন নেয় হীরেন। অটোসাজেশনে কাজ হয়। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে নয়ন। বুঝতে পারে, পাপড়ি আর নীড়ে ফিরবে না। তার শেষ স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে নিজ হাতে গোলাপের চাষ করে নয়ন। অবসরে ওগুলো নিয়েই সে ব্যস্ত সময় কাটায়। তবে এবার নতুন আইডিয়া নিয়ে হাজির হয়েছে হীরেন। আর এজন্য ও আমার সহায়তা চাইছে।
থেমে একটু দম নেন নুসরাত আপু।
হীরেন একটা কার ড্রাইভিং স্কুল খুলতে বলছে নয়নকে। আগে থেকেই ভালো ড্রাইভিং জানে নয়ন। এবার সেগুলো ছড়িয়ে দেবে সবার মাঝে। নিজকে ব্যস্ত রাখবে কাজের মাঝে। সেই সাথে সমাজ পাবে প্রতি বছর শতাধিক দক্ষ চালক। কি বুঝলি?
প্রশ্নবোধক দুষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকায় আপু।
-শোন তোর এই আপুকে এবার একটু ভালো কাজ করার সুযোগ দে তোরা।
আমার চোখে জিজ্ঞাসা।
-হ্যাঁ, নয়নের পাশে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারলেই আমার নারী জীবন সার্থক হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৮:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




