somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: প্রতিশোধ - শেষ পর্ব

২৩ শে অক্টোবর, ২০১০ সকাল ১০:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পর্ব - ১
পর্ব - ২

শুরমা বিবির মৃত্যুর পর সখিনা অনেক বেশী চুপ হয়ে গিয়েছিল। সুরহাব ব্যস্ত ছিল মাইকের ব্যবসায়। বাড়ি ফিরে তিক্ত মেজাজে থাকতো। কোন কোন দিন দেখা হতো, বোবা হয়ে চলতো, একটা কথাও হতো না দু'জনের মধ্যে। সখিনাও তাই। শুধু একদিন ভোরে সখিনা সুরহাবকে নিজে থেকে নরম কণ্ঠে বলেছিল
-আইজ আপনের কামে না গেলে হয়না?

উত্তর পাড়ায় ওয়াজের মাহফিল হবে। সুরহাব খুব ব্যস্ত। সে অপ্রত্যাশিত আবদারে জিজ্ঞেস করেছিল
-কেন? তোর আবার কি হইছে?
-শরমের একটা খবর আছে। (একটু থেমে )আপনার ঘরে আল্লা মেমান পাডাইতাসে
সুরহাব ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। সে যেন ধরেই নিয়েছিল তার ঘর খালি থাকবে। তারপর বিস্ময়ের চোখে সখিনাকে বলেছিল,
-আমগো সন্তান!! তুই কি হাছা কইতাসস?
-জ্বি, হাছা। হেই পাড়ার হাসুবুজান আইছিলো। দেইখা কইছে সাবধানে চলাফিরা করতে। ভারী কাম না করতে।
সুরহাবের ইচ্ছে হয় খুশীতে বিরাট একটা চিৎকার দেয়। বহু কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে মোনাজাতের ভঙ্গীতে বলে,
-আলহামদুলিল্লাহ । আল্লাহ তা'লা আমগোর দিকে মুখ তুইলা চাইছে। আইকার দিনে আম্মাজান যদি বাইচ্চা থাকতো উনি যে কত্ত যে খুশী হইতো। শুরমা বিবির কথাটা শোনার পর সখিনার মুখ বদলে যায় । এই আনন্দের মুহুর্ত থেকে নিমেষে পাপবোধে ডুবে যায়।

সুরহাব তাকে দিন দুপুরে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরে আছে। কেউ ঘরে ঢুকলে লজ্জার কান্ড হবে। সখিনা সুরহাবকে এমন আবেগী পেয়েছিল অনেক আগে, বিবাহের রাত্রিতে। সুরহাব আস্তে বলে,
-সখিনা, আইজ থন তোর বেবাক কাজ কাম বন্ধ। সুলমানরে কমু তার ছোড বউ যেন তোরে দুই বেলা রাইন্ধা দেয়। তুই খালি হুইত্যা থাকবি।

লোকটার কি যেনো হয়। পরদিন থেকে জলদি বাড়ি আসে। সখিনার খোঁজ খবর নেয়। বাড়ি থেকে বের হলেও আবার ঘুরে আসে।

এদিকে সখিনার শরীর শুরু থেকে খুব দুর্বল। তিন চার মাস পর্যন্ত সে কিছুই খেতে পারতো না। মাছে বমি হতো। সবাই বলতো এটা স্বাভাবিক। প্রথম পোয়াতির কষ্ট হবেই। ৬/৭ মাস থেকে শরীর অতিরিক্ত ভারী হয়ে গেল। হাঁটাচলা করতে কষ্ট ,হাতে পায়ে পানি। মুখ ফুলে গেছে। পাড়া প্রতিবেশীরা বললো, লক্ষণডা ভাল না।

হেকিমের কাছে গেল সুরহাব। উন্নতি হলো কিন্তু খুব সামান্য। উসমানের দাদী অভিজ্ঞ ধাত্রী। সে কালিজিরার রস খেতে বললো। সে চিকিৎসাতে ফল আসলো না। সখিনার চেহারায় ছোপ ছোপ দাগ বসে। দেখলে মনে হয় মধ্যবয়সী ভারী চেহারার কেউ। সখিনা আয়না দেখে ডুকরে কাঁদে। একি তার পাপের প্রায়শ্চিত্য? স্বপ্নে দেখে শুরমা বিবি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, আয়, আয়, একবার আমার কাছে আয়। মাঝরাতে বউকে কাঁদতে দেখে সুরহাব সান্ত্বনা দেয়। সখিনা নিরুত্তাপভাবে বলে, শুনেন, আমারে একটু তওবা পড়ান, আমি মন হয় আর বাচমু না।


বর্ষাকাল, প্রচন্ড বৃষ্টিতে গ্রাম ভেসে যায়। এর মধ্যে সখিনার প্রসববেদনা শুরু হয়। উসমানের দাদীকে নিয়ে আসা হয়। সখিনাকে শোওয়ানো হয় তার শাশুড়ীর কক্ষে। মুহর্মুহু বিদ্যুৎ চমকের মধ্যে সুরহাব যখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, তখন দাই নিরানন্দ ভাবে সুরহাবকে কন্যা সন্তানের সুখবর দেয় আর বলে, জলদি আহেন, সখিনা সমানে খিঁচতাছে।

খোদার পরীক্ষা। একদিনে চিৎকার করে কাঁদছে নবজাতক -অন্যদিকে সখিনার তীব্র খিঁচুনী । থর থর করে কাটা মাছের মতো কাঁপছে সে, গোঙাতে থাকে সে। প্রলাপ বকে, আম্মাজান গো আমারে মাফ কইরা দেন।

সখিনার খিঁচুনীটা একটু কমে, একটা পর্যায়ে এসে কষ্টে হু হু করে কাঁদতে থাকে। সুরহাবের হাত মুঠো করে ধরে সে বললো, আল্লা আমারে শাস্তি দেউক, এই আমিই আম্মাজানরে মারছি। তার অষুধ সরাইয়া ক্ষেতের অষুধ রাখছিলাম। আইজ পাপের শোধ হউক। সুরহাব বুঝতে পারে এ সখিনার প্রলাপ। এসব কথা ভাবার অবস্থা তার ছিল না। সে অসহায় ভাবে বলছিল, সখিনা, তুই এইডা কি কস, তুই কই যাবি। এই সংসার রাইখা তুই কই জাবি। তোর মাইয়ার দিকে চাইয়া ভাল হ।
-আমার একটা কথা রাখবেন?
-কি?
-মাইয়াডার নাম রাখবেন আম্মাজানের নামে
বলতে বলতে সিনেমার কাহিনীরমতো সখিনা শেষ কলমা পড়ে চোখ বুঁজে ফেলেছিল।


সমস্ত ঝড়ের রাত একসময় শেষ হয়। পৃথিবী থেমে থাকে না।

সখিনার মৃত্যুতে সুরহাব যেন ভেঙে পড়ে। সুরহাবকে দেখলে এখন আর চেনা যায় না। মাইকের দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। লম্বা দাঁড়ি রেখেছে। মাথায় টুপি, হাতে তসবি। প্রায় দিনই মসজিদে পড়ে থাকে। বৈশাখে সখিনার নামে একটা মক্তব দিয়েছে জমির উপরে। সখিনার কবর দিয়েছে পুকুরের পাড়ে। সেখানে একটা শিউলীফুল নুয়ে আছে। ফুলে ফুলে ভরে থাকে জায়গাটা। সুরহাবের বিয়ের ইচ্ছা ছিল না। তবে তার মেয়ের দেখাশোনার জন্য সে বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে।

দ্বিতীয় স্ত্রী ফুলবানু, সেই দু:সম্পর্কের বোন। ফুলবানু দীর্ঘদিনের পরিচিত মানুষ। শিশুকন্যা শুরমার যত্ন নেয়। নিজের সন্তানহীনতায় শিশু শুরমাকে সন্তান ভাবে। সুরহাবেরও অন্ধের যষ্টি তার কন্যা।

ভালমন্দ মিলে সময় বয়ে যায়। শুক্রবার বাদজুম্মা রাস্তাঘাট খালি হলে, ফুলবানুর উসমানের দাদীর কাছে গিয়েছিল। তার শরীরের কী একটা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে। ফুলবানু সেখানে সখিনার মৃত্যুকালীন স্বীকারোক্তিটা জানতে পারে। অবাক হয়। সে মনে করে একটা কথা সুরহাবকে জানানো দরকার। ফুলবানু বলে,
-এই যে একটা কথা শুনেন,
-ক, ফুলবানু
-সখিনাবুজান আর আম্মাজানের ঘটনা শুনলাম। বুজান কিন্তুক নির্দুষ। কারণ আমি উনারে রাইতে কুন অষুধই খাইতে দেইনাই।
-কি কস?
-হ। হেইদিন অষুধের বোতল খুলছি, দেহি পচা ঘেরান। খেতের অষুধের ঘেরান। অষুধ নষ্ট দেইখা আর দেই নাই। উনি বুক ধরফড় করতে করতে মারা গেছেন।

সুরহাব শোনে, ভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর বলে
-আইচ্ছা আইজ থাউক এইসব,
তারপর মৃত্যুর কষ্টটা এড়ানোর জন্য বলতে থাকে, তা তুমার শইল দেইখা উসমানের দাদী কী কইলো?

(শেষ)
--------------------------------------------
ড্রাফট ১.৫/
পাঠের সুবিধার্থে ৩ পর্বে প্রকাশিত হলো
বানান ও বিন্যাসের ত্রুটি সহ প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১০ সকাল ৮:১৪
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×