somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তগদ্য: মৌনতা এবং আহত টেবিল-মাছি

১৯ শে নভেম্বর, ২০১১ দুপুর ২:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গভীর ঘুম থেকে জেগে নীল সমুদ্রের গর্জন শোনা গেছে । মেয়েটি সঙ্গীহীন, হুইল চেয়ার ফোল্ড করা, ক্র্যাচে ভর দিয়ে উঠেছে সিঁড়িতে, হেঁটে হেঁটে এঘর থেকে ওঘর গেছে । কেউ কিচেনে মসলা কেচে নিচ্ছে, পাখা টানছে, ফুল বুনছে পরিশ্রান্ত। ছায়ারা সরে যায়। তীর্থ জাহাজ থেকে নেমে আসে বংশধর। অরণ্যে হরিণের কান খাড়া করে, যাবতীয় দু:খ পিষে লাল ঝরিয়ে একদল ষাঁড় তাড়া করছে। আতঙ্কিতরা ছুটতে ছুটতে পালালে মেয়েটি পথে দাঁড়িয়েছিল নির্বিকার । ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে বর্তমান আসে। প্রতিক্ষা করতে বলল কেউ। কথামত মেয়েটি গাছের নিচে ভিজছিল । চেয়ে দেখছিল শান্ত কোকুন রেশম বুনে গেছে। তুতের মিষ্টি হাতরুটি খেয়ে পুষ্ট হয় । তারপর কীটসমূহ ডানা মেলে নিরুদ্দিষ্ট । অন্যরা যদি ধীরে হাটতো তাদের সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটত সে। থামত। ভালবাসত। পাথরে পা ভিজিয়ে সহস্নান পেলে একান্ত হয়ে বসত ফাউন্টেন তলায়। মেঘ নামছে। হার্মনি-কোরাস-অর্কেস্ট্রা বাজছিল দ্বৈতসুরে । শিল্পীদের বিশ্বাস নেই। সে দেখেছে ঘুণের শিল্পীরা পিতৃপুরুষের সখের পিয়ানো খেয়ে নিচ্ছে প্রতিদিন। ভাল লাগায় আচ্ছন্ন করে বহুদিনের বাড়ির পলেস্তার কেটে নিচ্ছে নুনের করাত।

জেগেই দেখছে পৃথিবীর এই প্রান্ত বড় খালি। বন্ধুরা উঠে যাচ্ছে মই বেয়ে। রমণীরা জলকেলি সেরে এটেল কাদায় হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়ে খেলছে শিশুদের নিয়ে ।প্রেম এবং জননাঙ্গের কাঁটায় রক্ত ওঠতেই প্রত্যাবর্তনে উড়ে যাচ্ছে উড়াল হাস। হয়তো ডুবে যাচ্ছে শহুরে শাপলায় যে জানলায় পর্দায় আবছা দেখা যায় সুখীদের। দেখা হওয়া পথের বহুমুখ। একটি মুখে দাঁড় করিয়ে অন্য মুখে চলে গেছে। কারো কারো মুখে ঘুমক্ষত, পাখিদের প্রসাধনী বিলের দর্পণে শুকিয়ে সাদা পানির দাগ। দীঘির চারপাশে বাঁধানো ছবির ফ্রেম কেবলই সাজানো ছবি; জড় এবং অচেতন।

অসূর্যস্পর্শ্যা সে । ঘর থেকে বের হয়নি কখনো। নির্জন ধ্যানরত মঠ-সন্ন্যাসীদেরও জীবন থাকে। জীবন জানান দেয় ধানের কীট, ডুবুরী কৈ মাছ, এবং হাওড়ের ভেজা সারস। মেঘেরা ক্রমাগত এঁকেছে সমুদ্রের ঢেউ। সেই ছবি শেখা হল না তার ব্যস্ততায়। চঞ্চুতে পালক খুঁটে পাখি যায়। ফিন ফিনে কষ্ট সরিয়ে। বস্তুত: বেদনা ও একাকীত্ব বরাবরই সমার্থক। আর্কিমিডিসের চৌবাচ্চায় শুভসংবাদের জলে উপচে যায়। অন্যদিকে আয়নায় পুড়ছে শব্দসৈনিক। পাইক মাঠে পিঠ তুলে জানিয়ে দেয় বাস্তবিকই তা মিথ্যে। এছাড়া শত আবিষ্কারেও মহাজাগতিক সিঙ্গুলারিটিতে থেকে বিস্তৃতি আসেনি গ্রহাণুর। দেবীদের প্রার্থনায় কালপুরুষ। হাতে উল্কার ধনুক নিয়ে, যদিও পেশী ছিঁড়ে গেছে, শ্যেন দৃষ্টি, শশকের মত শ্রুতি এবং মৌমাছির ঘ্রাণ; কড়া আয়োজনে।

মেয়েটি বড় একা। অণুজীবের মত ছিঁড়ে দুই খণ্ড হয় তার অহং। বিভাজনে যুগল হয়, স্বগতোক্তি হয়, সচল হয়। শতরঞ্জি বোর্ড ঘুরিয়ে সঙ্গীহীন খেলোয়াড় বড়ে দিয়ে বড়ে কাটে। আড়াই ঘোড়া লাফিয়ে পড়ে অতীতের মাঠে, স্কুলের বেঞ্চিতে, জাম-রঙের বাল্যজিহ্বায় । নির্জনতায় শীষ দেয় খাঁচা-বন্ধ পাখি। সে একদিন দোলচেয়ারে দুলেছিল। রাতে। তারপর পোড়ামাটির সড়কে দুইশত সত্তর ডিগ্রী ঘুরে থামল মেয়েটি এক পরিত্যক্ত কোঠায়। দুরন্ত মৌসুমি হাওয়ায় চাল মুচড়ে নিচ্ছে সেই বৈশাখে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ কাচ ভেঙে পড়েছিল আলোর স্পন্দনে। শাখা কাঁপছিল। হয়তো সন্ত্রস্ত সে দেখেছিল - কাটা লোমশ হাতটি ঢুকে গেছে কাঁথায়। কোন অশরীরী যেন দেয়ালঘড়ির রূপালী জিহ্বা টেনে খুলে আনছিল। তারপর বীভৎস হুঙ্কারে নষ্ট চঞ্চলতা রেখে স্থিরতাকে তুলে নিয়ে চলে গেল। ফিরবে বলে সে ফিরছিল না।

অবশ্য আমি দেখেছি জেলেদের জাল শুকানো। তাবিজের সৌভাগ্যে মাছ খুলে বায়োস্কোপ হয়। ছবি নড়ে। কুলায় ধানের তুষ ওড়ে, চুলায় সেদ্ধ সোনা। তারপর নদীর ভাঙন এলে মেজারিং টেপের স্বয়ংক্রিয় গুলতির মত সুড়ুত করে সমস্ত দৃশ্য ঢুকে যায় আদিম শূন্যতায়। শুনেছি নীল আগুন অপেক্ষাকে জ্বালা ধার দেয়। গন গনে যে আগুনে মস্কোর ঘণ্টার গলে যায়। তরল ধাতু পারদের মত বেয়ে বেয়ে নদী হয়ে যায়। আর ঘুম থেকে জেগেই মেয়েটি শুনেছিল উলুধ্বনি। সমুদ্রের গ্রাম থেকে ভেসে আসছে মিলনসংকেত। দূর সাইপ্রাসে সমুদ্র মুঠো মুঠো বালি ফেলছিল উপকূলে। ঝড়ের ভয়ে অনেকবারই লুকোনোর ইচ্ছে হয়েছিল। পাতাল কক্ষে গুমরে ভেসে আসছিল হরিণের কান্না। কফির সাদা পেয়ালা এমনই। শ্বেত-গ্রন্থি থেকে মুক্তো ঝরে গিয়েছে। উপরে উঠে যাওয়া ক্ষণস্থায়ী। যেমন আকাশ ঘুড়ি নিয়ে শিশুদের মত খেলে। সুতোয় সুতোয় মন কষাকষি। একদিন ছিঁড়ে যাওয়া লেজ অসময়ে গাছের কোটরে ঢুকে যায়।

সংবাদ এসেছে। মাটি খুঁজে পাওয়া গেছে একটি পোড়ো বাড়ি। জড়ো হল উৎসুক জনতা। ফটকে অঙ্কিত বন-ময়ূর, কাঁটাতারের বেষ্টনী। এখানে একাকীত্ব আবিষ্কৃত হল মাটি খুঁজে। বাতাসের কঙ্কালে পাওয়া গেছে বহুযুগ আগের রোদ। আলোকচিত্রী ঢুকল। ঢুকে যাচ্ছে দীর্ঘ তামায় বয়ে যাওয়া ইলেকট্রনে। প্যান করে যাচ্ছিল সে বিধাতার দূত শোবার ঘরে। শুকিয়ে যাওয়া পাম-রোজ।সে থামল। দেখল বিস্ত্রস্ত করিডোর। রেফ্রিজারেটর খুলতেই একটা ক্ষীণ বাতি জ্বলে ওঠেছে। বাতাস পেয়ে ফ্রোজেন চামচিকা উত্তাপে কিচ কিচ উড়ে গেছে। অপেক্ষায় জমে গেছে কফির ধূম্র বাষ্প। কফি, কলম, চুলের বো পম্পেইয়ের লাভার মত সবই জমাট বাঁধা। সরে যাবে সে উপায় নেই বলে আছে। কাচের পিপা ভেঙে গেছে বালি-ঘড়ির। সুজির দানার মত বালি ছড়িয়েছে। তারপর সব শুন শান। নির্জনতার নিয়মকে কে ভাঙতে চায়? সবাই দেখছিল গ্র্যাণ্ডফাদার ঘড়ি থেকে কোকিল বের হয় নি, অথচ ভোর সমাগত। ধূসর সিলিং থেকে সুতো নামছে । আবারও সমুদ্রের শব্দ আসে। জীবন্ত শিশুদের কলরোলে ঢেকে যায়। কত বহুবিধ কথা, তন্তুতে পাক খেয়ে দুলছে তো দুলছে একটি আহত টেবিল-মাছি।

--
ড্রাফট ১.২
ত্রাতুলের ব্লগে কমেন্টকৃত
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১১ সকাল ১০:৫৫
৩০টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×