বলা হয়ে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞানার্জনের জন্য সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ । এখানে রয়েছে জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার । প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার গন্ডিসীমা পেরিয়ে মুক্ত জ্ঞানার্জনের উপযুক্ত ক্ষেত্র হলো বিশ্ববিদ্যালয় । বর্তমান সেমিষ্টার পাঠদান পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রেক্ষিতে উপরোক্ত কথাগুলো কতটুকুন যৌক্তিক ও বাস্তব তা কেবল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাই ভালো করে বলতে পারবেন ।
সেমিস্টার পদ্ধতিতে যে পাঠদান ব্যবস্থা অামাদের দেশে নেয়া হয়েছে এটা শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে নয়, একটা সার্টিফিকেটের জন্য । কারণ কর্পোরেট চাকুরীর বাজারে সোনার হরিণ পেতে হলে ভালো সিজিপিএ লাগবে । এটা সাধারণ শর্ত, অানুষঙ্গিক শর্তসমূহ তো অাছেই ।
সেমিষ্টার ! বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে এক অাতঙ্কের শব্দ । পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৬ মাসে ১ সেমিষ্টার । অনার্স করতে মোট ৮ টি সেমিষ্টার পেরুতে হয় । অার একেকটা সেমিষ্টারে প্রতি বিষয়ভিত্তিক মোট ১০০ নম্বরকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেয়া হয় । তাই যেখানে বর্ষভিত্তিক পাঠদানে একটি বিষয়ে মাত্র একবারেই ১০০ নম্বরের পরীক্ষা দেয়া লাগতো সেখানে সেমিষ্টার পদ্ধতিতে মোট কতবার পরীক্ষা দেয়া লাগে তা নির্ভর করে ক্লাস শিক্ষক মোট কতটি ইনকোর্স বা ক্লাসটেস্ট নিলো । তার উপর মিডটার্ম, অ্যাটেনডেন্স, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন তো অাছেই (বিজ্ঞান বা প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীদের ল্যাব অাছে) । এ পর্যন্ত যতগুলো বলা হলো এগুলো সব মিলে মাত্র ৫০ নম্বর এবং এই ৫০ নম্বরে কে কত পেলো তা ফাইনালে যোগ হবে । এই ৫০ নম্বরের পরীক্ষা যদি একদিনে হতো তবু একটা কথা ছিলো । অারো থাকে বাকি ৫০ নম্বর । এই ৫০ নম্বরের পরীক্ষা একটাই হয় । একেকটা পরীক্ষা একেক দিনে হয় । এভাবে প্রতিটা বিষয় । তাই একটা ছাত্র সেমিষ্টার পদ্ধতিতে একাডেমিক পড়াশুনাই শেষ করতে পারেনা । পাঁচ মার্কসের হোক, দশ মার্কসের হোক সব পরীক্ষাই ফাইনাল । পুরো সেমিষ্টারই ব্যস্ত থাকতে হয় পরীক্ষা নিয়ে, অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে । এভাবে দেখতে দেখতে ৮ সেমিষ্টার পেরিয়ে যায় । শিক্ষার্থীর হাতে স্নাতক একটি সার্টিফিকেট ধরিয়ে দেয়া হয় ।
এভাবেই প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয় সার্টিফিকেটধারী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী । তাহলে মাঝখানে কী প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানার্জনের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ? বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকে কেনো বলা হয় জ্ঞানার্জনের জন্য মুক্তাঙ্গন? কী দরকার এই সাংঘর্ষিক কথাবার্তা বলার? বরং এটা বললেই তো হয়, বিশ্ববিদ্যালয় হলো প্রেসার কুকার, যেখানে চাকুরী উপযোগী রক্তে-মাংসে গড়া সার্টিফিকেটধারী গড়ে তোলা হয় । তারপর কিন্তু থেকেই যায়, এই ৮ সেমিষ্টারে শিক্ষার্থী দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়া এর বেশি কী শিখলো? বা শেখার কতটুকুন সময় পেলো? বা তাকে শেখার জন্য কতটুকুন সময় দেয়া হলো? এই যে সেমিষ্টার পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর উপর প্রেসার প্রয়োগ করা হচ্ছে, এতে অামাদের নিজের এবং রাষ্ট্রের কতটুকুন লাভ হলো বা হচ্ছে?
চাপ প্রয়োগে কর্পোরেট ব্যবসার মুনাফা বাড়ানো যায় কিন্তু শিক্ষা নয় । কারণ, শিক্ষা স্বেচ্ছায় অর্জনের বিষয় । জোর করে তোতাপাখিকেও বুলি অাওরানো শেখানো যায় কিন্তু কথা নয় ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে অাসার যে শিক্ষার্থীরা রয়েছে তাদের বুঝার যথেষ্ট বয়স হয়েছে । এই লেকচার খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই প্রথম ক্লাসে বলে থাকেন । এখন প্রশ্ন হলো - যারা এতো সমঝদার তাদেরকে কেনো সেমিষ্টার পাঠদান পদ্ধতিতে ছোট ছেলেমেয়েদের মতো জোর করা হচ্ছে নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকার জন্য, নিয়মিত পড়াশুনা করার জন্য ক্লাসটেস্ট - মিডটার্মের ব্যবস্থা করা, নির্দিষ্ট পরিমাণ সেমিষ্টার জিপিএ সাপেক্ষে পরবর্তী সেমিষ্টারে উর্ত্তীণ করা ইত্যাদির ন্যায় বাধাধরা নিয়ম মেনে চলতে?
সেমিষ্টার পদ্ধতিতে অারেকটি অমানবিক নিয়ম হলো - মোট ক্লাসের নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্লাসে শিক্ষার্থীকে উপস্থিত থাকতেই হবে, নচেৎ তার ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া যাবেনা । এটা কতটা বর্বর তার বাস্তব অভিজ্ঞতা অামার রয়েছে । হঠাৎ করেই সেমিষ্টারের মাঝখানে জটিল অসুস্থতায় পড়ার কারণে প্রায় দু'মাস ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারিনি । ডাক্তার দু'মাস ফুল রেস্ট নেয়ার কথা বললে অামি ডিপার্টমেন্ট চেয়ারম্যান বরাবর ছুটিও চেয়েছিলাম, ক্লাসের অনেক জন মিলে অনুরোধ করেছিলাম । কিন্তু দেয়া হয় নি । পরে দু'মাস পর যে ক্লাসেই ক্লাস করতে যাই সব ক্লাস শিক্ষকই বলে, অামার পরীক্ষা দেয়া হবেনা । দেয়া হবেনা, হবেনা । ব্যস ! স্যারের মুখের উপর কোনো কথা বলা যাবেনা । অামি অার বলিও নি । এর জন্য পুরো একটা সেমিষ্টার নয়, একটা বছর নষ্ট হয়ে গেলো । ঠিক ঐ সময়টাতে মনে হয়েছিলো হার্বার্ট স্পেন্সারের মতবাদ সেমিষ্টার পাঠদান পদ্ধতি ঠিকই মেনে চলে । "Survival of the fittest" । কেবলমাত্র যোগ্যরাই এই প্রতিযোগীময় পৃথিবীতে টিকে থাকবে, অসুস্থ ও রোগাগ্রস্থ মানুষ নয় । পরবর্তী বছরে দেখি অামার অারেকটা বন্ধু ও সহপাঠীও একই কেসের শিকার । অামাদের মতো অসংখ্য শিক্ষার্থী এই অমানবিক নীতির শিকার । অামার মনে হয় না অামি পুরোপুরি ৮ সেমিষ্টার পার করতে পারবো । তার অাগেই হয়তো ড্রপ অাউট হয়ে বের হয়ে যেতে হবে ।
সেমিষ্টার বিষানলে সবচেয়ে বেশি পতিত হয়েছে সৃজনশীল ও বাস্তবিক প্রয়োগ সম্পর্কিত বিষয়ে যারা পড়াশুনা করছে তারা । যেমন- কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অন্যান্য প্রকৌশল, স্থাপত্য, কলা ইত্যাদি বিষয় । অামি কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশুনা করছি তাই এটা পদে পদে উপলব্ধি করতে পারছি । সেমিষ্টার পদ্ধতির পরিবর্তে যদি বর্ষ পদ্ধতি থাকতো তাহলে অারো অনেক ভালো করতে পারতাম, প্রোগ্রামিং জগতে অারো সময় দিতে পারতাম । কিন্তু সেটা হয়ে উঠছেনা ।
অনেকে হয়তো বলতে পারেন, সেমিষ্টারে একটা বিশাল সুবিধা হলো সেশন জ্যাম হয় না । এটা সম্পূর্ণ ডাহা মিথ্যা । পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায়, যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়েই সেশনজ্যাম হতে পারে । সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ।
যাইহোক, বললে অনেক কিছু বলা যায় । এতো কথা বাড়িয়ে কী লাভ? সমস্যায় যারা পতিত হয়েছে তারা ঠিকই বুঝতে পারছে, কোনটা অামাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ভালো অার কোনটা ভালো নয় । এখন সেমিষ্টারের যুগ । তাই অামার সেমিষ্টার বিরোধী এই লেখা অনেকের কাছে চক্ষুশূলে পরিণত হতে পারে । তাই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি । তবুও শিক্ষাবিদদের প্রতি অনুরোধ, যদি অারেকবার ভাবতেন !
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:০১