যৌনতা যখন পণ্য, নারীমুক্তি তখন প্রশ্নবিদ্ধ
খেয়াল করেছেন কি, অামরা না চাইলেও গোগ্রাসে অসুস্থ যৌনতা গিলছি? কী চলচ্চিত্রে, কী ম্যাগাজিনে, কী বিজ্ঞাপনে, কী ভিডিও প্লেব্যাকে, কী প্রেজেন্টশনে ! সর্বত্রই যেনো যৌন অাবেদনময়ী লুক থাকা চাই-ই চাই । একদিকে অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতাকামীদের সুড়সুড়ি অার অন্যদিকে কর্পোরেট পৃথিবীর লক্ষ্যমাত্রা মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে ক্রেতাবৃদ্ধির তাগাদা । এই দুই-ই মিলে যৌনতাকে পণ্য বানাতে সাহায্য করেছে । অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতাকামীরা যে কর্পোরেট শ্রেণিটিকে দোষারোপ করে না, তা কিন্তু নয় । সেটা যতোটা না করে তারচেয়ে কয়েকগুণ প্রচেষ্টা করে যাতে মেয়েরা সেদিকেই ঝুঁকে পড়ুক, হোক না একটুখানি কর্পোরেট, তাতে কী? মেয়েরা স্বনির্ভর হতে পারছে, এইতো । কিন্তু নারীরা যে নিজেকে অারো গহীন অন্ধকার সাগরে নিমজ্জিত করছে তা কিন্তু কেউ অাঙ্গুল দিয়ে ঐ নারীদেরকে দেখিয়ে দিচ্ছে না । সমাজের এলিট শ্রেণিটিও এটার বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারছেনা । কারণ উপরোক্ত দুটি শ্রেণিটি তাদের কৃতকর্মের পেছনে প্রচন্ড সবল যুক্তি অাগে থেকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে । ধর্মের কুসংস্কার । অবশ্য এই টার্মটা এভাবে বলতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না । তাই সরাসরি নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় প্রধান প্রতিবন্ধক হিশেবে ধর্ম বিশেষ করে ইসলামকেই দাঁড় করায় । 'নারীর প্রগতির পথে প্রথম বাঁধা ধর্ম' । এইকথা শোনার পর তাদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টু শব্দটি করার সাহস থাকে না সমাজের এলিট শ্রেণিটির । জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণেই হোক অার প্রভাব-প্রতিপত্তি হারানোর ভয়েই হোক তারা কেনো জানি পারেন না ।
মূল কথায় ফিরে যাওয়া যাক । যৌনতার প্রতি অাকর্ষণ মানুষের সহজাত প্রকৃতি । এই অাকর্ষণ এড়ানো সম্পূর্ণ মানব ও সম্পূর্ণা মানবীর ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব । এক অাধ্যত্মিক, ষড়রিপুবিজয়ী ছাড়া মানুষ যতই চেষ্টা করুক এই অাকর্ষণ এড়িয়ে চলতে পারে না । সেই অাকর্ষণের কারণেই মানুষের নজরের একটি খারাপ দিকের অাবির্ভাব । অনেকে সেটাকে কুনজর বা কুদৃষ্টি বলে । এই যৌনতা এমন এক অাকর্ষণ, যার অাকর্ষণে মানুষ হিংস্র হায়েনায় পরিণত হতে পারে । তার উদাহরণ দিয়ে পাঠকমহলকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চাই না । সে যাইহোক, এই যৌন অাকর্ষণকেই পুঁজি রূপে গ্রহণ করেছে বর্তমান কর্পোরেট পৃথিবী ।
যৌনতা যখন বিজ্ঞাপনে মনোযোগের কারণঃ বলাই হয় প্রচারণায় প্রসার । প্রসার বলতে ব্যবসার প্রসার । ব্যবসার প্রসার মানে ক্রেতার প্রসার । ক্রেতার প্রসার মানে মুনাফার প্রসার । অার এটাইতো চায় প্রত্যেক ব্যবসায়ী । ব্যবসার লক্ষ্যে প্রচারণা হবে, বিজ্ঞাপন হবে । এটাই স্বাভাবিক এবং এটি তাদের ব্যবসায়িক অধিকার । অামার বা কারোরই সে ব্যাপারে কোনো অাপত্তি নেই । থাকার কথাও না । তারা প্রচারণা করেই অাসছে । সেটা হোক টেলিভিশনে, রেডিও এফএমে, পত্র-পত্রিকায়, নাটক-সিনেমা বা জনপ্রিয় কোনো অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে । কিন্তু বিজ্ঞাপন অার প্রচারণা এতো বেশি হারে বেড়ে গেছে যেটা দর্শক বা শ্রোতার কাছে যথেষ্ট বিরক্তির কারণ । মানুষ তাই এক দশক অাগে যেভাবে বিজ্ঞাপনের প্রতি অাকৃষ্ট ছিলো এক দশক পরে তার বিপরীত হয়েছে । তাই বাধ্য হয়ে বিজ্ঞাপনে মনোযোগের কারণ হিশেবে যৌনতাকে পুঁজি করা হয়েছে । বিজ্ঞাপনে স্ক্রিপ্ট, মডেল রোলও সেভাবে তৈরি করা হয়েছে । যৌনতার প্রতি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ও অাকর্ষণের কারণে মানুষ বিজ্ঞাপনে অাগের তুলনায় বেশ অাকৃষ্ট হচ্ছে । একটা বিজ্ঞাপন যখন দেখতে দেখতে বিরক্তি হবে তখন পুনরায় অারেকটি বিজ্ঞাপনকে সাজানো হবে নতুন যৌনতার অাঙ্গিকে ।
যৌনতা যখন চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপনে মূল অাকর্ষণঃ অামাকে অন্তত একটা যুক্তি দেখাতে পারবেন যে, একটি মেয়েকে বখাটে ছেলেরা ধর্ষণ করছে । অার এটা দর্শককে বুঝাতে ধর্ষণের পুরো দৃশ্য দেখাতেই হবে, না দেখালে দর্শক বুঝবেই না? চলচ্চিত্রে অনেক পরিচালক পুরো দৃশ্য দেখান অাবার অনেক পরিচালক দেখান না অর্থ্যাৎ রাখেন না । তার মানে পরিচালকরা এটা ইচ্ছে করলেই পারেন । পারার পরেও যখন বেশ অানুষ্ঠানিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখানো হয়, তখন এই দেখানোর পেছনে যে অারেকটি বিশেষ কারণ রয়েছে সেই সন্দেহের উদ্রেক উঠাটি কিন্তু মোটেই অযৌক্তিক নয় । অাপনারাও জেনে থাকবেন । ইন্টারনেটে সার্চ ইঞ্জিনে যে পরিমাণ সেক্সুয়াল শব্দ ব্যবহার করে সার্চ দেয়া হয়, তন্মধ্যে 'র্যাপড' শব্দটি অনেক বেশি থাকে । এটা সারা পৃথিবীতে । কেনো হয়? কারণ, হিংস্র প্রাণি হিংস্রতায় বেশি অানন্দ পায় । কষ্টের অার্তনাদ মাখানো চিৎকার তাদের কাছে খিস্তি-খেউর মনে হয় । তাই তাদের হাত থেকে বাদ যায় না শিশুরা, সে ছেলেই হোক অার মেয়েই হোক । শুধু ধর্ষণই নয়, ব্যবসায়িক চলচ্চিত্রগুলোতে এই যৌনতা জিনিসটি না থাকলে দর্শকদের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায় না । যেভাবেই হোক, যেকোন ফাঁকফোঁকরেই হোক যৌন অাবেদনময়ী দৃশ্য থাকা চাই-ই চাই । এখন অভিনেত্রীকে মিনিস্কার্ট পড়তে হবে নাকি বিকিনি পড়তে নাকি শুধু ব্রা-প্যান্টি পড়তে হবে নাকি পুরোই নগ্ন থাকতে হবে সেটা বিবেচ্য নয় । বিবেচ্য হল, দর্শক সেই দৃশ্য দেখে লালায়িত হয়ে সিনেমা কিংবা টেলিভিশনে চোখ রাখছে কিনা । জনপ্রিয় অভিনেত্রী অমুক চলচ্চিত্রে, অমুক প্লেব্যাকে অমুক ডিজাইনের অমুক ফ্যাশনের ড্রেস অাপ করেছেন । ব্যস, হালনাগাদ ফ্যাশনজগতে সেই ড্রেসের মার্কেট বেড়ে গেলো । ধুমচে বেড়ে গেলো ক্রেতা । ধুমচে বেড়ে গেলো সৌন্দর্য্য প্রদর্শনের নামে যৌনতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা । অার সেটা দেখেই কথিত প্রগতিশীল নারীবাদী ও ফেমিনিষ্টরা অাহ্লাদে অাটখানা । বাহ, নারীরা পর্দার বাইরে বেরিয়ে ব্যক্তি স্বাধীন হতে শিখছে ! কিন্তু কে বলে দিবে যে, তারা নিজেকে কর্পোরেট বাজারে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে । কে বলে দিবে তারা কড়াই থেকে লাফিয়ে অাগুনে ঝাঁপ দিয়েছে । কে বলে দিবে তাদেরকে যে, পোশাক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রে যৌনতা পণ্যটির বিজ্ঞাপনের প্রধান ক্রেতা । কে বলে দিবে, এতে করে একটি শ্রেণির মুনাফা বেড়েই চলেছে অার অারেকটি শ্রেণি তার নিজস্ব সত্ত্বা, সম্মানবোধ, পারিবারিক-সামাজিক-রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা নষ্ট করে দিচ্ছে, নিজের মূল্য নিজেই নির্ধারণ করছে বাজারের মূল্যমানে ।
যৌনতা যখন পণ্যের মোড়কঃ এই ঘটনাটা উন্নত দেশগুলোতে বিশেষ করে প্রযুক্তিতে যেসকল দেশ অনেক এগিয়ে গিয়েছে সেই দেশেই ঘটে । নন-হিউম্যান জিনিসেরও যে সেক্সি লুক থাকে এটা কিছুদিন অাগে জেনেছি একটা ডেস্কটপ থিম ইনস্টল করার সময় । থিমটির কমেন্টবক্সে 'লুকিং সো সেক্সি' এই ধরণের শব্দ চোখে পড়লো । অামি বুঝলাম না, থিমটিতে কোনো সেক্সি মেয়ে তো দূরে থাক, কোনো মেয়ে শব্দই নেই । তাহলে থিমটি কিভাবে সেক্সি হলো ! পরে বুঝলাম, কর্পোরেট সোসাইটির প্রচারণা অাজ কনজ্যুমার শ্রেণিটির মনমগজে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে । একসময়ের যৌনতার মোড়কে অাবদ্ধ পণ্যের কোয়ালিটিতে অারেকটি গুণাগুণ যোগ করতে পেরেছে - সেক্সি লুক । এটা কোথা থেকে এসেছে? ঐ যে, প্রথমে পণ্যের সাথে পণ্য বহির্ভুক্ত অর্থ্যাৎ নারীর সৌন্দর্য্য বিক্রির চেষ্টা । তারপর সেটাও যখন পুরনো হয়ে গেলো, তারপর যৌনতার মোড়কে পণ্যকে ক্রেতার কাছে অারো অাকৃষ্ট করে তোলা । সবচেয়ে ভালো উদাহরণ, দামি দামি গাড়ির সাথে নারী ফ্রী । এমনকি দামি দামি সিক্রেট ও নন-সিক্রেট রেষ্টুরেন্ট ও হোটেলগুলোতে পাকজাত খাবারের সাথে নারীর যৌন অাবেদনময়ী অঙ্গগুলোকে খাদ্য হিশিবে পরিবেশন করা হয় ।
যৌনতা যখন কলারূপে পণ্যঃ শিল্পীদের কাছে যৌনতা একটা অার্ট বা কলা । সেই কলাপ্রিয়দের কলা যদি কলাতেই সীমাবদ্ধ থাকতো, তাহলে কোনো সমস্যা ছিলো না । কিন্তু সেই কলাকে পুঁজি করে পর্নস্টার শব্দটির উদ্ভাবন ও প্রতিষ্ঠা করা হলো কেনো? করতেও পারেন । সেখানেও কোনো সমস্যা নেই । কিন্তু সেই যৌনশিল্পকে শিল্পপ্রেমীদের কাছে সীমাবদ্ধ না রেখে কেনো পেইডসাইট (টাকার বিনিময়ে যে সাইটগুলোতে যৌনতা উপভোগ করা যায়) ও নন-পেইডসাইটের মাধ্যমে জনসম্মুখে উন্মুক্ত করে দেয়া হলো? পাঠকদের সুবিধার্থে বলে রাখি, ননপেইড সাইটগুলো মূলত পেইডসাইটগুলোর ট্রেইলার বা বিজ্ঞাপনের মতো কাজ করে । অনেকটা চেখে (স্বাদ নেয়া) দেখার মতো ।
যাক, অাঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে গেলে অনেক কিছুই দেখিয়ে দেয়া যাবে । অাপাতত এতটুকুন এসে অাশাকরি পাঠকমহলের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না যে নারীমুক্তির নামে নারীকে অাজ যে অবস্থানে অানা হয়েছে এতে নারীদের কতটুকুন সম্মান ও মূল্য প্রতিষ্ঠিত হলো অার কতটুকুন সম্মান ও মূল্য হারালো । একটি শিক্ষিত সমাজে থেকেও অফিস-অাদালতে নারীরা কেনো সন্ধা্যার পর নিরাপদ নয়, অভিনয়-নৃত্য-মডেল শেখার স্বপ্ন পূরণ করতে কেনো নারীরা স্বর্বস্ব খুইয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে, কেনো চাকরির ইন্টারভিউয়ে নারীকে কুপ্রস্তাব পেতে হচ্ছে, কেনো নারীরা বাধ্য হচ্ছে দেহব্যবসায় নিজেকে সঁপে দিতে তার উত্তর পেতে নিশ্চয় অার কষ্ট হবে না ।
তবে ভাববেন না যে, অামি নারীর গৃহবন্দির পক্ষে, নারীর অাপাদমস্তক ঢেকে কিম্ভূতকিমাকার বানিয়ে রাখার পক্ষে । অামি চাই, নারীরা পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখুক, সব সভ্যতা নির্মিতে নেতৃত্ব দিক কিন্তু নিজের গুণাগুণ, গুরুত্ব ও মূল্যবোধ খুইয়ে নয় । নারীমুক্তি সেখানেই সম্ভব যেখানে নারী নিরাপদ, যেখানে দুর্বল নিরাপদ সবলের কাছে, যেখানে সত্য চিরভাস্বর মিথ্যার অন্ধকারে, যেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে । কিন্তু কর্পোরেট পৃথিবী পুরো সত্য সিস্টেমটাকে উল্টিয়ে তার নিজের নির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ডকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে । তাই অামাদের সবাইকে প্রথমে সেই কর্পোরেট পৃথিবীর বিরুদ্ধে যে কর্পোরেট যৌনতাকে ভালোবাসার জায়গা থেকে তুলে খদ্দেরের পণ্যভান্ডারে নিক্ষেপ করেছে, যে কর্পোরেট নারীর শুভ্র প্রেমের নির্যাসকে ক্রেতা অাকর্ষণের পারফিউমে পরিণত করেছে, যে কর্পোরেট মানুষকে মানুষ না বানিয়ে হিংস্র হায়েনায় পরিণত করেছে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে, নারী-পুরুষ সবাইকে হাতে হাত রেখে । তবেই নারীমুক্তির অান্দোলন সফল হবে, নারী পুরুষের কষাঘাত থেকে মুক্তি পাবে, মানবতা পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হবে, পৃথিবী হবে কর্পোরেট থেকে স্বর্গময়, তার অাগে অবশ্যই নয় ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:৪৪