somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রুশ দেশে রবির আলো

০৮ ই মে, ২০২৩ বিকাল ৪:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



রাশিয়ার জনগণের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহান সাহিত্যিক , ঔপনিবেশিক পীড়ন ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে অক্লান্ত সংগ্রামী , জাতিগত মৈত্রী ও শান্তির সোৎসাহী প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের বই রাশিয়াতে ছাপা হয়েছে প্রায় ৫০ লক্ষ কপিরো ওপরে এবং অনুবাদ হয়েছে রুশ ছাড়াও রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ যেমন ইউক্রেন , উজবেকিস্তান , আর্মেনিয়া ইত্যাদি সহ আঠারোটি জাতীয় ভাষায় । তাঁর নাটক রাশিয়ার রঙ্গমঞ্চে সাফল্যের সাথে অভিনীত হয় ।


প্রাক-বিপ্লব রাশিয়ায় , রুশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের রচনার প্রথম অনুবাদের কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন বিখ্যাত রুশ সাংবাদিক ও সমালোচক ভিক্তর শক্লোভস্কি (I. V . Shklovsky) । “গীতাঞ্জলি” র জন্য রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির বহু আগেই শক্লোভস্কি ইংরেজি “গীতাঞ্জলি” র অন্তর্গত প্রায় সব কবিতা রুশ ভাষায় অনুবাদ করে ফেলেন যা পর্যায়ক্রমে ১৯১৩ সালের ৬ই জুন পর্যন্ত স্বনামধন্য রুশ সাহিত্য পত্রিকা “রুশ সমাচার” (Russkie Vedomosti) এ প্রকাশিত হয় । রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনা রুশ দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। মস্কোর বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা “ নিভা “ (Niva) তে ডিসেম্বর ১৯১৩ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে করা হয়েছিল প্রছদ নিবন্ধ । এই সংখ্যায় ভিক্তর শক্লোভস্কি লেখেন “ রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে নিঃসন্দেহে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে সে দেশে রেনেসাঁসের এক নব অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে । এই “গীতাঞ্জলি” তে সমগ্র জনমানসের এবং সামগ্রিক ভাবে একটি সভ্যতার প্রতিফলন ঘটেছে”।


১৯১৩ থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে রুশদেশে “গীতাঞ্জলি” র ছয়টি অনুবাদ প্রকাশিত হয় । এর মধ্যে অন্যতম , বিখ্যাত লেখক ইভান বুনিন (Ivan Bunin) যিনি পরে নোবেল পুরস্কার পান , তাঁর অনূদিত ও সম্পাদিত সংকলনটি । ১৯১৪ ও ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক বক্তৃতাবলী সাধনা এবং নাটক চিত্রাঙ্গদা , রাজা ও ডাকঘর এর অনুবাদ প্রকাশিত হয় । সর্বাপেক্ষা বৃহদায়তনের যে রবীন্দ্র রচনা সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯১৫ সালে সেটি ছিল “Glimpses of Bengal Life” নামে ইংরেজি ভাষায় রজনীরঞ্জন সেন অনূদিত রবীন্দ্রনাথের ১৩ টি ছোটগল্পের রুশ অনুবাদ । রবীন্দ্রনাথের এই ছোট গল্প গুলো সেদিন রুশ পাঠক মহলে বিপুল চাঞ্চল্য সঞ্চার করেছিল । এই সংকলনটির সম্পাদনা করেছিলেন প্রতিকবাদী কবি জিনাইদা ভেনগেরভা । অর্থাৎ প্রাক-বিপ্লব রাশিয়ায় শুধু কবি হিসেবে নয় , এই স্বল্প সময়ের মধ্যে কথাশিল্পী , নাট্যকার এবং দার্শনিক হিসেবেও রবীন্দ্রনাথ রুশ দেশের পাঠকমহলে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন ।


সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সোভিয়েত শাসনক্ষমতার প্রথম আমলে রবীন্দ্র রচনার গবেষণা ও প্রচারের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় । এই সময় সোভিয়েত পাঠক মহলে রবীন্দ্রনাথকে এক মহান জাতীয় শিল্পী , অগ্নিগর্ভ দেশপ্রেমী ও মানবতাবাদী রূপে তুলে ধরা হয় । রবীন্দ্রনাথের “সাধনা” র অন্তর্ভুক্ত দার্শনিক রচনাগুলি ছাড়াও এই সময় তাঁর শিক্ষা সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক ইংরেজি রচনা ও বক্তৃতাগুলি সে দেশের বিদগ্ধ মহলের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল । লেনিন রবীন্দ্রনাথের Nationalism অর্ডার দিয়ে কোলকাতা থেকে আনিয়েছিলেন । ক্রেমলিনে লেনিনের ব্যাক্তিগত গ্রন্থাগারে রবীন্দ্রনাথের “ গীতাঞ্জলি ” , “ঘরে ভাইরে” এর রুশ অনুবাদ ও Nationalism এর জার্মান অনুবাদ পাওয়া গেছে । জার্মান সংস্করণের প্রায় প্রতিটি পাতার মার্জিনে লেনিনের নিজের হাতে লেখা মন্তব্য আছে । লেনিনের সহধর্মিণী ক্রুপস্কায়া একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা বিষয়ক লেখা সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করতেন । তাঁর “বিশ্বশিক্ষাব্যাবস্থা” গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তার সপ্রশংস উল্লেখ আছে ।


সরাসরি বাংলা থেকে রবীন্দ্র রচনা প্রথম রুশ ভাষায় অনুবাদের কৃতিত্ব , রাশিয়ায় বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে বাংলা ভাষা চর্চার পথিকৃৎ তুবিয়ানস্কি এবং সে দেশে দাউদ আলি ছদ্দনামে পরিচিত ভারতীয় বিপ্লবী প্রমথনাথ দত্ত । বিশেষত প্রমথনাথ দত্তই প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়নে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা ভাষা শিক্ষার গোড়াপত্তন করেন । বিশের দশকে “মস্কোর রাষ্ট্রীয় ললিত সাহিত্য প্রকাশনালয়” এর মতো রাষ্ট্রীয় ও বড় প্রকাশনালয় থেকে রবীন্দ্রনাথের রচনা ১৫ থেকে ৩০ হাজার কপিতে প্রকাশ হতে থাকে ।



রবীন্দ্রনাথ যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন তখন সে দেশের সুধীমহলে তো বটেই , সাধারন পাঠক মহলেও তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে । ১৯৩০ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বর বার্লিন থেকে এক বিশেষ ট্রেনে অতিথিরা মস্কোয় পৌঁছলেন । এ সময় কবির অন্যতম সফরসঙ্গী ছিলেন বিজ্ঞানিী আইনস্টাইনের কন্যা মারগারিতা আইনস্টাইন। রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া সফর বলাই বাহুল্য তাঁর সঙ্গে রাশিয়ার জনমানসের আরো নিবিড় সংযোগ গড়ে তোলে । রবীন্দ্রনাথের সত্তর বছররের জন্মতিথিতে সে দেশের বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের সাগ্রহ অংশগ্রহণের মধ্যে প্রকাশিত হয় The Golden Book of Tagore । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৪৪ সালে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা Modern Review তে সোভিয়েত কবি নিকলাই তিখনভ (Nikolai Tikhnov) লিখলেন “রাশিয়ার কাছে যেমন লেভ তলস্তোয় , ভারতের কাছে রবীন্দ্রনাথও তাই । ভারতে আমাদের কোটি কোটি বন্ধু আছে বটে , কিন্তু তাদের মধ্যে যে মানুষটি তাঁর দেশের নিগূড় জগৎকে বাঙময় করে তুলেছেন , সমগ্র বিশ্বকে নিজের দেশের বানী পৌঁছে দিয়েছেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – কবি , নাট্যকার , ঔপন্যাসিক ও দার্শনিক” ।


রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে সোভিয়েত ও ভারতের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের রচনায় সুসমৃদ্ধ একটি সুবৃহৎ সংকলন প্রকাশিত হয় । ১৯৬১ সালে সংকলনটি প্রকাশ করে সোভিয়েত বিজ্ঞান আকাদেমি । ভারতবর্ষের যে সব লেখক এই সংকলনটিকে অলংকৃত করেছেন তাদের নামের তালিকা থেকে গ্রন্থটির ব্যাপ্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা করা যেতে পারে – বিষ্ণু দে , শান্তিদেব ঘোষ , গোপাল হালদার , প্রশান্তকুমার মহলানবিশ , সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় , মেঘনাথ সাহা , সৈয়দ মুজতবা আলী । ভারতীয় লেখকদের লেখা সংকলনটির জন্য রুশ ভাষায় অণুবাদ করেন সোভিয়েত কবি নিকলাই তিখনভ ।


রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে ১৯৬১ সালে মস্কোর রাষ্ট্রীয় ললিত সাহিত্য প্রকাশনালয় থেকে রুশ ভাষায় ১২ খণ্ডের রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশিত হয় এবং ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভাঙ্গার আগ পর্যন্ত এর মুদ্রণ সংখ্যা ৪০ লক্ষ ছাড়িয়ে যায় । এই সোভিয়েত আমলেই তাঁর রচনা সে দেশের ২৩টি জাতীয় ভাষা যেমন উজবেক , তাজিক , আর্মেনীয় ইত্যাদি ভাষায় দেড় শতাধিক বার প্রকাশিত হয়েছে , যার মুদ্রণ সংখ্যা ৬০ লক্ষেরও বেশি । আজ এক শতাব্দীর বেশি কাল ধরে রাশিয়ায় রবীন্দ্র সাহিত্যের গবেষণা , চর্চা ও অনুবাদের কাজ চলছে ।

রুশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের সর্বাধিক অনূদিত কাব্যগ্রন্থ “ গীতাঞ্জলি” , সর্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাস “ নৌকাডুবি” , “ ঘরে বাইরে” ও “গোরা” এবং সর্বাধিক পরিচিত নাটক “ডাকঘর” ।

সাম্য ও ন্যায় এর প্রতীক মহান মানবপ্রেমিক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর সৃষ্টিগুলো রাশিয়ার জনগণের কাছে এখনো একান্ত শ্রদ্ধেয় ।

Reference List

1. Savodnik , Sbornik Lirika Lyubi I zhizni ( প্রেম ও জীবনের গল্প) , Moscow 1915

2. Prodarzhanie Rabindranta tagora , ( রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে) ১৯১৩ , মস্কো

3. সোভিয়েত ইউনিয়নে রবীন্দ্রচর্চাঃ অধ্যাপক ঈভগেনিয়া চেলিসেভ , কোলকাতার রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বার্তা বিভাগ থেকে প্রকাশিত 1981 , কোলকাতা

4. Tagore , India and Soviet Union A.P Ganatyuk Danil chok Moscow 1986
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০২৩ বিকাল ৪:৩৯
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

×