শেষ বিকেলে ফতুল্ললা স্টেডিয়াম থেকে ঘরমুখো জনস্রোত হঠাৎই স্লেলাগানমুখর হয়ে উঠলো। সেই স্লেলাগানের একটাই নাম,একটাই ভাষা,'রফিক,রফিক' আর 'রফিক,রফিক'।
জি্ব না, বৃহষ্পতিবার বিকেলে স্লেলাগানের মাধ্যমে ফতুল্ললার আকাশে বাতাসে যার নাম ছড়িয়ে পড়লো, তিনি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন। যদিও এমনসব লোকদের নামে স্লেলাগান উঠতে দেখেই অভ্যস্ত এদেশের মানুষ। রাজনীতিকদের নামে স্লেলাগান দেয়ার সঙ্গে অবশ্য টাকা পয়সার বিনিময়টাও জড়িত থাকে। যেখানে থাকে না স্বত:স্ফূর্ততা। তবে সেদিন বিকেলে হাজার কয়েক জনতার মন থেকে উঠে আসা ,'রফিক,রফিক' স্লেলাগানের সঙ্গেও বিনিময় হলো একটা কিছুর। সেটা হলো কেনিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জয় নিশ্চিত করা ম্যাচের ম্যাচ উইনিং পারফরম্যান্সের সঙ্গে। হ্যাঁ, বলা হচ্ছে 'আমাদের রফিক'এর কথাই।
কী, কথাটা কারো মুখ থেকে শুনেছেন বলে মনে হচ্ছে না? মনে হওয়ারই কথা। 2004-এর অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে আসে নিউজিল্যান্ড। সঙ্গে নিয়ে আসা বিশ্বসেরা বাহাতি স্পিনার ডেনিয়েল ভেট্টোরিকে কিভাবে সামলাবেন তার ছেলেরা, এজাতীয় প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত ডেভ হোয়াটমোর 'অ্যাগেইনস্ট দ্য স্পিন' বাউন্ডারি মেরেই ছাড় পেয়েছিলেন,'ওদের ভেট্টোরি আছে তো কী হয়েছে? আমাদেরও তো আছে মোহাম্মদ রফিক।'ওভাবে কথা বলার সাহস দেখানোর জন্য কিছু মজুদ থাকা লাগে। বাহাতি স্পিনারের এমন মজুদ তো বিশ্বের খুব বেশী দলের নেই। নিজের আছে বলেই হোয়াটমোর বলতে পেরেছিলেন।'আমাদের রফিক' কনসেপ্টের সূচনাও তখন থেকেই।
তারও অনেক আগে থেকেই মোহাম্মদ রফিক বাংলাদেশের অন্যতম সেরা পারফরমার।নির্দিষ্ট করে বললে,নব্বইয়ের দশক থেকে। যখন আসিফ করিমরা বাংলাদেশের বিপক্ষে মাঠ দাপাতেন।কেনিয়ার সাবেক এই অধিনায়ক বাংলাদেশ-কেনিয়া সিরিজ দেখছেন কমেন্ট্রি বক্স থেকে।ব্যাট হাতে 33 রানের পর 47 রানে 5 উইকেট নিয়ে ক্যারিয়ার সেরা বোলিং, তৎসূত্রে ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার পাওয়ার পর একটু পেছন ফিরে তাকিয়ে রফিকের অতীত আর বর্তমানকে একই সমান্তরালে বইতে দেখছেন আসিফ করিম। তাই বৃহষ্পতিবার শেষ বিকেলের পড়ন্তআলোতেও তার বিনম্র শ্রদ্ধা আরেকবার আলো ছড়ালো রফিকের মুখে,'আমাদের বিপক্ষে যখন খেলতো, তখনো রফিক ছিল বাংলাদেশের অন্যতম সেরা পারফরমার।এখনো তাই আছে।অসাধারণ।'
কিন্তু খুব সাধারণ মানুষ রফিক এতে অসাধারণত্বের কিছু দেখছেন না।বয়স 37 ছুঁয়েছে। অথচ সেটা তার সামর্থে আঁচড় কাটতে পারেনি একটুও।টেস্ট এবং ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশী উইকেট পাওয়া রফিকের কাছে এর রহস্য পাটীগণিতের সরল অংকের মতো জটিল মোটেও নয়,'আমি মানসিকভাবে খুব শক্ত।তাছাড়া আমি পরিশ্রমও করি অনেক বেশী।'তার দীর্ঘদিনের সতীর্থ খালেদ মাসুদের কাছ থেকেও এর সমর্থন মিলছে,'আসলে ও খুব পরিশ্রম করে।আমি তো বলবো একজন তরুণ খেলোয়াড়ের চেয়ে কম তো নয়ই,বরং বেশী শ্রম দেয় রফিক ক্রিকেটের পেছনে।সেজন্যই পারফরমার রফিক আছে আগের মতোই।'
শ্রমনিষ্ঠ শরীরের নীচে বয়স আড়াল করে রাখা মানুষ রফিকও আছেন আগের মতোই।গুছিয়ে কথা বলার অভ্যাসটা যেমন এখনো করে উঠতে পারেননি।কিন্তু তার বোলিং এমনই গোছালো যে, তার শিষ্যত্ব বরণ করে নিতে একটুও দ্বিধা করেননি ডেনিয়েল ভেট্টোরি আর হরভজন সিংয়ের মতো স্পিনাররাও।তার আর্মার এমনই বিষাক্ত হিসেবে প্রমাণিত যে,এখনো মাঝে মাঝে রফিকের মোবাইলে কেউ একজন ফোন করে ওপার থেকে বলেন,'হাই রফিক,ম্যায় হরভজন হুঁ।'বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক ভারতীয় আর পাকিস্তানি ক্রিকেটার খেলেন। তাদের সূত্রে হিন্দি আর উর্দু মোটামুটি জানা রফিকের। হরভজনের সঙ্গে কথোপকথনও চলে অল্পবিস্তর জানা হিন্দিতেই,' আর্মারটা আরো ভালো কিভাবে করা যায়, সেটা ও আমার কাছে একবার জানতে চেয়েছিল।আমি বলেওছিলাম। এখন প্রায়ই ফোন করে জানায়, প্র্যাকটিসে নাকি ওটা ট্রাই করছে। শিখেও নাকি গেছে প্রায়।'
রফিক কিন্তু এখনো ইংরেজি শেখেননি। তাই বৃহষ্পতিবার ম্যাচ সেরার ট্রফি হাতে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের অ্যাংকর আতহার আলীর মুখোমুখি হয়ে ইংরেজী প্রশ্নে উত্তর দিতে শুরু করলেন বাংলায়। কিন্তু কেন? ইংরেজী কি কখনো শিখবেন না? এসব প্রশ্নে নিজের তুণের সেরা অস্ত্র আর্মারের মতোই সোজাসাপটা জবাব রফিকের,'কেন শিখবো ইংরেজী? বাংলা আমার মায়ের ভাষা। আমি সবসময় এভাষাতেই কথা বলবো। আমিতো বাংলাদেশের মানুষ।আমার কথা এই দেশের মানুষ বুঝলেই চলবে।তাছাড়া সারা বিশ্ব তো দেখছে একজন বাংলাতে কথা বলছে।'অর্থাৎ বাংলাদেশের 36-তম স্বাধীনতা দিবসের ঠিক দুদিন আগে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সারা বিশ্বে বাংলা ভাষার বিজ্ঞাপনই যেন করলেন রফিক।বাকী জীবনও তাই করতে চান। অবশ্য ইংরেজী শেখা বিষয়ক প্রশ্নে রফিকের বিরক্তিটাও বোঝা গেল তার পরের কথাতেই,' আর কেউ যদি বাংলা না বুঝে থাকেন,তাহলে বলবো আমার সাথে কথা বলার আগে তারা বাংলা শিখে আসুন।'
এখানেও আরেকজনের কথা না মনে পড়ে পারেই না। ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ইংরেজী নয়, মাতৃভাষা স্প্যানিশেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা এই 'ফুটবল ঈশ্বর' একবার বলেছিলেন,'আমি কখনো ইংরেজীতে কথা বলবো না। আমাকে যাদের প্রয়োজন, তারা যেন স্প্যানিশ শিখে আসে।' ম্যারাডোনার কথা রফিক জানেন না। তবে জানেন,'রোনালদো, রোনালদিনহোরা তো ইংরেজী জানে না। কিন্তু খেলাটাতো সবার সেরা খেলে। ওটা ঠিকমতো খেলতে পারলেই হলো।'
রফিকের শেষ বাক্যটাও একটা স্লেলাগান। যে স্লেলাগানের অনুসারী রফিক সারাজীবন।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



