সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে বিরামহীনভাবে। রেইনকোটটা গায়ে চাপিয়ে বৃষ্টির মধ্যে জলন্ত সিগারেটটা থেকে ধোয়া উড়াতে উড়াতে প্রেসক্লাব থেকে শাহবাগের দিকে হাঁটছিলাম। উদ্দেশ্য একটা মানুষকে খুজে বের করা যাকে আমি চিনি না। এমনকি নামটা প্রর্যন্ত জানিনা। লোকটার সাথে আজকেই খুব ভোরে আমার দেখা হয়েছিল শাহবাগ মোড়ে। এক পলক দেখছিলাম শুধু। শুধুমাত্র স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করে আবার যাচ্ছি তাকে খুজতে। অবশ্য আমার স্মৃতিশক্তির উপর আমার বিশ্বাস আছে।
দুপুর প্রর্যন্ত ব্যর্থ খোঁজাখুঁজি করেও পেলাম না লোকটাকে। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কেন যে কাজটা করতে গেলাম! নিজের উপরই এখন বিরক্তি লাগছে। অবশ্য আমার দোষটাই বা কি? এখন মানুষের বাইরেটা দেখে ভিতরটা বোঝা যায়না। এই লোকটাই যেমন কত সুন্দর পরিপাটি জামা কাপড় পড়ে অপিসে যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায় দাড়িয়ে ছিল। তার মানিব্যাগটাও যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান মনে হচ্ছিল। যখন তার পকেট থেকে মানিব্যাগটা আমার হাতে চলে আসলো তখন দেখলাম আমার অনুমানটাও ভুল ছিল না। ভেতরে বেশ কতগুলা কড়করে এক হাজার টাকার নোট। অন্যসময় হলে টাকা গুলা নিয়েই মানিব্যাগটা ছুড়ে দিতাম ডাস্টবিনের দিকে। কিন্তু কি মনে করে যেন আজ ভিতরটা খুজলাম। গোটা গোটা হাতে লেখা একটা ছোট চিঠি।
“আব্বু, মা বলে আমি নতুন জামা চেয়েছি বলে তুমি বাড়িতে আসো না। আব্বু আমার নতুন জামার দরকার নেই। আমি তো ঈদের দিন কোথাও যাব না। তুমি তারতারি বাড়িতে চলে আসো।’’
এতটুকু পড়েছি আর পড়তে পারলাম না। চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা ছোট্ট শিশুর মুখ যে কিনা পথ চেয়ে বসে আছে তার বাবার আশায়। ও জানে যতই নিষেধ করুক ওর বাবা ওর জন্য নতুন জামা না নিয়ে আসবে না। ভেসে উঠছে ঘামে ভেজা সেই বাবাটির মুখ যে তার সন্তানের এই চিঠি পড়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে “পাগল ছেলে আমার। তোর জন্য নতুন জামা না নিয়ে কি আমি বাড়ি আসতে পারি?” আর আমি কি করলাম? সেই জামাটা কেনার টাকাটা কেড়ে নিলাম!
সারাদিন অনেক ঘুরলাম। পকেটে আরও দু চারটে মানিব্যাগ এল। কিন্তু সকালের ঐ লোকটা আর তার চিঠিটা মাথা থেকে নামাতে পারছিলাম না। যতবারই ভেবেছি যে আমাদের এত আবেগি হলে চলবে না ততবারই মনে পড়ে যাচ্ছিল।
শেষমেশ সন্ধ্যার পড়ে আবার শাহবাগের মোড়ে গেলাম না পেরে। কোথায় যেন শুনছিলাম বিশেষ মানুষদের মধ্যে নাকি মনের টান থাকে। এই যেমন ধরেন প্রেমিক প্রেমিকা। আমার সাথেও ঐ লোকটার একটা মনের টান বোধহয় ছিল। হয়ত দুইজনেরই মন খারাপ ছিল তাই। কি জানি হয়ত তার বাচ্চাটা আর তার চিঠিটাও হতে পারে। ঠিক আমার মন যেটা বলছিল তাই। লোকটা দাড়িয়ে আছে ওভারব্রিজের উপরে। উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটে যাওয়া ব্যস্ত ট্র্যাফিকগুলোর দিকে। পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম নিঃশব্দে। মন খারাপের সময়ে সম্ভবত খুব সহজেই মানুষের আপন হওয়া যায়।দু চারটে কথাতেই লোকটার অনেক আপন হয়ে গেলাম। গড়গড় করে বলে দিল তার দুঃখের কথাগুলা, সকালে মানিব্যাগের সাথে হারানো তার বেতন আর ঈদ বোনাসের টাকাগুলার কথা। এরপর আজ সারাদিনে পকেটমারের সব টাকা আর তার কাছ থেকে নেয়া সব টাকা তার হাতে তুলে দিলাম। শুধু বললাম আমার তো ফিরে যাওয়ার মত বাড়ি নেই আপনি যান এই টাকাগুলো নিয়ে। এরপর তাকে একটা কথা বলারও সুযোগ না দিয়ে হাটা শুরু করলাম। পিছন ফিরে তাকালে হয়ত দেখতে পেতাম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা একটা চেহারায় ভাসছে কৃতজ্ঞতা, সম্মানবোধ আর ভালবাসা যার কোনটি পাবারই যোগ্যতা আমার নেই। আমার জন্য থাকতে পারে ঘৃণা শুধুই ঘৃণা।