"মা" এতো ছোট একটা শব্দ অথচ মাকে নিয়ে কিছু একটা লিখবো চিন্তা করতেই মনের মধ্যে হাজারটা গল্প আসতে শুরু করলো। কিভাবে শুরু করবো লেখাটা , কি কি লিখবো চিন্তায় পড়ে গেলাম। ছোটবেলায় দুই ভাইবোন মার হাতে ভীষন মার খেতাম। এমন কোন জিনিস নেই যা দিয়ে না মারতো। আম্মুর ধৈর্য অনেক কম। পান থেকে চুন খসলেই রেগে যেত। তারপর শুরু করতো টেস্ট ম্যাচ। প্রথম ইনিংস এ ফলোঅনে পড়তো , এরপর শুরু করতো দ্বিতীয় ইনিংস। দোষ যদি যেকোন একজনের থাকতো , মা ভাইবোন দুজনকেই একসাথে পেটাতে শুরু করতো। শুভ ( আমার ছোটভাই ) আম্মুর কাছে বেশি মার খেত। আমাকে মারতে আসলেই আগেই কান্না জুড়ে দিতাম যে বাড়িশুদ্ধ মানুষ জড়ো হয়ে যেত। যৌথ পরিবারে থাকার এইটা একটা সুবিধা। আম্মু মারতে শুরু করলে ফুপু-চাচা-চাচী বাঁচাতে চলে আসতো। কিন্তু তবুও শেষরক্ষা হইতো না। তারা সামনে আসলেই মা বলতো "দেখো শাসন করার সময় কেউ আসবা না , এইটা আমার পছন্দ না"। ব্যাস সবাই যার-যার মতো চলে যেত।
হঠাৎ করেই যেন মার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম। সে আর আগের মতো কথায় কথায় রেগে যায় না। আমার যতদূর মনে পড়ে আমি ক্লাস সেভেনে ওঠার পর আর মার খাই নি। আমরা একটু বড়ো হতে শুরু করলাম , আর আম্মু আমাদের কাছে হয়ে গেল সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। এমন বন্ধু যার সাথে সারাদিনের সব মজার মজার ঘটনা শেয়ার করতে শুরু করলাম। স্কুল , কোচিং বা রাস্তায় মজার কিছু দেখলে সবকিছু আম্মুর সাথে শেয়ার করতাম। কোনদিন যদি কিছু না বলতাম , আম্মু নিজেই জানতে চাইতো "আজকে বলার মতো মজার কোন ঘটনা ঘটে নাই ?"আম্মু আমাদের দুই ভাইবোনের এত যত্ন নিত , মাঝে মাঝে অবাক লাগত । কিভাবে পারত সে সংসার এর সব কাজ আর রাজনীতিতে নিজের অবস্থান ঠিক রেখে আমাদের জন্য এতটা সময় বের করতে !! ছোট-খাট সব ব্যাপারে খেয়াল রাখতে !! মোবাইল ফোন ব্যবহার শুরু করার পর আম্মুর কিছু সুবিধা হয়েছে .... কখন কি করছি তা জানার জন্য সারাদিন অপেক্ষা করতে হয়না কিছুক্ষন পরপর আমাদের দুই ভাইবোনের খোঁজ নেয় । সময়মত খেলাম কিনা , এখন কোথায় আছি , বাসায় কখন আসব । প্রতি ঘন্টার সংবাদের মত আমরা ভাইবোন আম্মু আব্বুকে আমাদের খবর জানাতে থাকি ।
ভার্সিটিতে যখন ভর্তি হই একটু পরপর আম্মু ফোন করে খোঁজ নিত , বন্ধুদের দেখতাম এইটা নিয়ে অনেক হাসাহাসি করত । প্রায়ই ওরা বলত কিরে আজকে ফিডার নিয়ে আসছ নাই ... আল্লাহ্ এত ছোট বেবি , তুই কিভাবে ফিডার ছাড়া সারাদিন থাকবি !! আন্টি নিশ্চয়ই তোর জন্য বাসায় কান্নাকাটি করছে । রাগে আমার গা জ্বলে যেত কিন্তু বন্ধুদের সামনে কিছু প্রকাশ করতাম না । একদিন মেজাজ এত খারাপ হল বাসায় এসে আম্মুকে বললাম তোমার এই অতিরিক্ত কেয়ার নেয়া নিয়ে আমার ফ্রেন্ডরা হাসাহাসি করে , আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে ... তুমি কাল থেকে আমাকে আর এতবার কল করবা না । আম্মু একটু হেসে কাধেঁ হাত রেখে বলল আচ্ছা যাও কাল থেকে আর কল করব না ।
আমরা ভাইবোন এতবড় হয়ে গেছি তারপরও আম্মুর হাতে ভাত খাই । আমি মাঝে মাঝে নিজের হাতে খেলেও শুভ সবসময়ই আম্মুর হাতে ভাত খায় । শুভ অফিসে দুপুরের খাবার কিভাবে খায় , সময়মত খায় কিনা এইসব টেনশন করতে থাকে । ও বাসায় আসামাত্র হাজার প্রশ্ন , কি খেলে , কিভাবে খেলে ,তুমিতো এই সবজি খাও না , তুমিতো ওই মাছ খাও না । তাহলে মনেহয় আজকে দুপুরের খাবার ঠিকভাবে খাওয়া হয়নাই । ছোটবেলায় কোথাও বেড়াতে গেলে আগে আমাদেরকে খাওয়াত তারপর নিজে খেত , এমনকি কলেজে যখন পড়ি তখনো এমন করত । নানু প্রায়ই আম্মুকে বকাঝকা করতেন , ওদেরকে নিজের হাতে খেতে দে .... বড় হচ্ছে , নিজের কাজ নিজেই করুক আস্তে আস্তে সব কিছু শিখতে হবে না ! কতদিন আর এইভাবে তুলুতুলু করে পালবি । নানু মারা গেছেন ২০০৭ সালে এখন ২০১২ । আমরা এখনও মার হাতেই ভাত খাই ।
মা তোমার এত ভালবাসা পাবার পরও মাঝে মাঝে তোমার সাথে অনেক বাজে ব্যবহার করি , ভেতরে ভেতরে কষ্টও পাই । কাছে গিয়ে সরি বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু বলতে পারিনা । মা অনেক ভালবাসি তোমাকে কিন্তু আমি আমার ভালবাসা প্রকাশ করতে পারিনা । সবার ভালবাসা প্রকাশের ধরন এক হয়না , আমি শুভর মত তোমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাইনা । ভালবাসি কথাটা একবারও বলি না তার মানে এই না যে আমি তোমাকে ভালবাসি না ... আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালবাসি মা । তোমার অবাধ্য যখন হই প্রায়ই আমাকে একটা কথা বল - " মা তো হও নাই , মা যখন হবা তখন বুঝবা আমি তোমাদেরকে নিয়ে এত চিন্তা কেন করি " মনে মনে ভাবি আমি যখন মা হব আমার মনে হয়না আমার সন্তানকে নিঃস্বার্থ ভাবে এতটা ভালবাসতে পাবর যতটা তুমি আমাদেরকে ভালবাস ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১২ রাত ১২:০৬