কাল উড়ে এসেছি পুণা। এমন বিতিকিচ্ছিরিভাবে কখনও আমি কোথাও যাইনি। ফোনের চার্জার ভুলেছি, পেন ড্রাইভ ভুলেছি, মায় কলমটাও ভুলেছি। প্রথম দুটো না হলেও কোলকাতায় থাকলেও কলমটি আমার সাথে থাকে সর্বদাই। কবিতা বা লেখা মাথায় ধাক্কা মারলেই লেখা অভ্যেস যে আমার। আমি তো আর লিখব বলে বসে লিখতে পারি না। সেই কলমটাও আমার ভুল হল? মানসিক অবস্থা যে কোথায়, এতেই টের পাওয়া যায়। গত ক’দিন নয়, গত ক’মাস ধরে আমার ওপর দিয়ে ঝড় বইছে। আজ সকালে আমার ঘুম ভেঙেছে ছ’টায়, যেমন রোজ ভাঙে। এখানে এসে উঠেছি সম্পর্কে এক ভাগ্নের বাড়ি। ও আবার দু’দিন হল বাড়ি পরিবর্তন করেছে। জুলাই মাসে বিয়ে করবে। ওর হবু বৌ-ও এখানে কর্মরতা। পরিকল্পনা মাফিক, এই ফ্ল্যাটটা ওরা আগে ভাগেই নিয়েছে, কিছু সুবিধে পেয়েছে বলে। পাঁচ তলার ব্যালকনিতে দাঁড়ালে সন্ধ্যের পর হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে তো যায়ই, সামনের দৃশ্যও অসাধারণ। কম্পাউন্ডে লন, শিশু উদ্যান তো আছেই, আর প্যারাবোলার মত ঘিরে আছে, চকলেট বারের মত বাড়িগুলো। একশ আশি ডিগ্রি চোখ ঘোরালে কেবল জানালা আর ঝুল বারান্দা। এসব পেরিয়ে কম্পাউন্ডের মূল গেটের ওপারেই হাইওয়ে। সর্বক্ষণ অবিরত গাড়ির আনাগোনা। তারও দূরে আবছা পাহাড়ের রেখা। এই মূল গেটটি আমাদের বাড়ি থেকে অন্তত আধ কিলোমিটার দূরে। যেহেতু রাস্তাটি সরলরেখায়, তাই চোখে কোন বাধা আসে না।
সকালে আমি যখন উঠেছি, বাড়ির কারো ঘুম ভাঙেনি। আমি এসে ঝুল বারান্দায় দাঁড়ালাম। সকালের স্নিগ্ধতা চারপাশে। গোল হয়ে ঘিরে থাকা ফ্ল্যাটগুলোর মাঝখানের অংশ দিয়ে দেখা আকাশটুকু ঢেকে রেখেছে, অজস্র উড়ন্ত পায়রা। একটা ক্যামেরার অভাব যে সব সময় অনুভব করি।
এমন দৃশ্যের মানে এই সার সার জানলার সম্মুখিন আমি আগেও হয়েছি। প্রতিবার-ই হিচ্ককের রিয়র উইন্ডো ছবিটার কথা মনে পড়ে যায়। এক এক জানলায় এক এক গল্প। কেউ ঝুল বারান্দায় এসে সূর্য প্রণাম করছেন। কেউ স্নান সেরে তোয়ালে পরে তুলসী গাছে পেতলের ঘটি করে জল দিচ্ছেন। এক তরুণী এসে তার অন্তর্বাস মেলে দিল দড়িতে। এক মা বোঝাই যাচ্ছে কাজ করতে করতে এসে খাইয়ে যাচ্ছেন তাঁর শিশুকে। শিশুটি বারান্দার রেলিং ধরে নিজের মনে খেলা করছে। একটি জানালার যে পাশটি দেখা যাচ্ছে না, সেখানে একটি আয়না আছে বোঝা যাচ্ছে। তিন চারটি চাকুরে মেয়ে সেখানে থাকে বোঝা গেল। সকালে সবার তৈরী হবার ব্যাস্ততা। ঐ খানটাতে এসেই, কেউ চুল বাঁধছে, কেউ পোষাক ঠিক আছে কি না দেখছে। একজন তো ওখানে দাঁড়িয়ে কসরৎ করে চোখে লেন্স পরল। সকলের চলনে বেরোবার তাড়া বোঝা যায়। এক মা, তাঁর সন্তান খুবই ছোট বোঝা যায় জামার মাপ দেখে, খুব যত্ন সহকারে তিনি সন্তানের ছোট্ট ছোট্ট ন্যাপিগুলো একটা একটা করে দড়িতে ঝুলিয়ে ক্লিপ লাগিয়ে দিচ্ছেন।
ভোর থেকে তো নীচের পার্কে দৌড়, হাঁটা এসব চলছেই। এক দল আসছে, চলে যাচ্ছে। আবার নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। ঘেমে নেয়ে কেউ জিরোচ্ছে। আমি পাখীর দৃষ্টিকোণে সব দেখে চলেছি নীরবে। পার্কের মাঝখানে পাঁচ ফুট বাই তিন ফুট তক্তার একটা দোলনা আছে। সেখানে দেখি তিন বয়স্কা বসে গল্প করছেন। একটু দূরে দুই মধ্য বয়স্ক মানুষ সিমেন্টের প্রাচীরের ওপর বসে। তাঁরাও গল্প করছেন। কিছুক্ষণ পর মহিলারা উঠে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে দেখি এই পুরুষ মানুষ দুটিও উঠে ওঁদের অনুসরণ করতে শুরু করেন। আমি বোঝার চেষ্টা করছি, এঁরা কি একই বাড়ির? একই সাথে ফিরে যাবেন অথবা . . . । ও মা, তারপর দেখি, মহিলারা উঠে যাওয়ায় ঐ দোলনাটাই পুরুষদের টার্গেট। প্রায় দৌড়ে গিয়ে সেটা দখল করেন তাঁরা। আমার খুব হাসি পেল।
এই দোলনা নিয়ে একটু পরে আরো একটা মজার ব্যাপার হল। এক মহিলা খালি পায়ে ঘাসের ওপর অনেকক্ষণ হাঁটছিলেন। এবার গিয়ে বসলেন সেই দোলনায়। জিরোবেন নিশ্চয়ই। মাটিতে পায়ের চাপ দিয়ে দুলতেও শুরু করলেন। এবার এদিক ওদিক সন্তর্পনে দেখতে লাগলেন, কেউ দেখছে না তো? তিনি যে কিশোরী হয়ে গেছেন সেই মূহুর্তে।