২ তারিখ। বান্দরবানে আমাদের চতুর্থ দিন। দলের প্রায় সবাই মানসিক এবং শারীরিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছি। তবে গত দুই দিনে সারভাইভ করার ভয় প্রায় পুরোটাই কেটে গেছে। এখন চিন্তা সবার যার যার বাসার। বলে আসা হয়েছিল ২ দিন নেটওয়ার্ক থাকবে না। ৩ দিনেও নেটওয়ার্ক পাওয়ার কোন নামগন্ধ নেই।
যাই হোক সকাল ৭ টার মাঝেই নয়াচরন পাড়া থেকে রওনা হয়ে গেলাম। নামার গতি এখন আগের চেয়ে বেশি। আধা ঘণ্টার মাঝেই হাজরাই পাড়ায় পৌঁছে গেলাম। সেখান থেকে কামরুল আর রাশেদ ভাই সাদেক ভাই এর সাথে চলে গেল সাকাহাফং জয় করতে, বাকিরা রইলাম হাজরাইতেই। আমাদের তেল শেষ। সাকাহাফং বাংলাদেশের আনফিশিয়াল হাইস্ট পিক, বাংলাদেশ ও মায়ানমারের বর্ডার এ অবস্থিত। ভবিষ্যতে আশা করি মিস হবে না ওটা। ভবিষ্যতে যারা যাবেন তাদের জন্য বলে রাখি হাজরাই পাড়ায় না থাকাই ভাল। লোকজন একটু ধান্দাবাজ কিসিমের আর খুবই অপরিচ্ছন্ন। এই একটা দিনই মনে হয় একটু আরামে কেটেছে, মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা হাঁটতে হয়েছিল। ওদের সাকাহাফং উঠে আসার ফাকে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখলাম, আড্ডা মারলাম, ছবি তুললাম। এসব করেই মোটামুটি সময় কেটে গেল।
হাজরাই পাড়ায় আমাদের কিছু মুহূর্ত
ওরা তিন জন ১.১৫ এর দিকে সাকাহাফং থেকে ফিরে আসল। সবার চেহারা হয়েছিল দেখার মত। কামরুল কুঁড়েতে ঢুকেই বলল ২ ঘণ্টা ৫৫ মিনিটে সাকাহাফং উঠেছে। বলার পর দেখলাম কামরুল নাই, সে বারান্দায় উদ্ভ্রান্তের মত বসে আছে। এরপর ঢুকল সাদেক ভাই। তার অবস্থাও ভাল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে বিস্কিট খুঁজল। বিস্কিট শেষ শুনে বিড়বিড় করে বলল বিস্কিট নাই জানলে জীবনেও সেদিন সাকাহাফং এ উঠত না। রাশেদ ভাই ঢুকল সবার শেষে। তার মুখে কোন আওয়াজ নেই, এদিক ওদিক কি জানি খুঁজল মনে হল, তারপরেই ধপাস করে শুয়ে পড়ল।
ওরা রেস্ট নেয়ার জন্য বেশি টাইম পায়নি। আধা ঘণ্টার মাঝেই রওনা হয়ে গেলাম। আজকে মোটামুটি রিলাক্স মুডেই হাঁটলাম। তাড়া ছিল না তেমন, সন্ধ্যার মাঝে দোলাচান পাড়ায় পৌঁছাতে পারলেই চলবে। সাদেক ভাই বলেছে আনুমানিক তিন ঘণ্টার মাঝে পৌঁছে যাব। বিকালে শুধু ছোট্ট একটা হাইক থাকবে।
৪.১৫ এর দিকেই পৌঁছে গেলাম দোলাচান পাড়ায়। আগের সব পাড়া থেকে এটা কিছুটা আধুনিক এবং সব থেকে বড়। এখানে দোকান আছে, কিছু কিছু শিক্ষিত পরিবার ও আছে। পৌঁছে সবাই যেটা করলাম দোকানের উপর এক রকম ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তিন দিন আগের কেনা বিস্কিট তো কখন শেষ হয়ে গিয়েছে, সারাদিন না খেয়ে খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে।
দোকানের জিনিস পত্রের দাম সব দিগুণ। কিন্তু এসব আনতে ওদের কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয় আগামি পর্ব পড়লেই জানতে পারবেন এবং এই দিগুণ দাম দিতে আপনার একফোঁটাও খারাপ লাগবে না। দোকানের বড় বিস্কিটের প্যাকেট যা ছিল আমরাই শেষ করে দিলাম, সাথে চানাচুর ও। এরপর হামলা চালালাম ২ টাকার বিস্কিটের দিকে। যে যেই কয় প্যাকেট পারি কিনে রাখলাম।
পেট ঠাণ্ডা করতে করতে ৫ টা বেজে গেল। সাদেক ভাই থাকার জন্য কুঁড়ে ঠিক করতে গেল, সাথে কামরুল। একটু পর দেখি দুজনের কোন পাত্তা নেই। পাড়াটা বেশ বড়, পাড়ার আরেক মাথায় গিয়েও ওদের আর পাইনা, কি বিপদ। রাশেদ ভাই আর মারুফ গেল ওদের খুঁজতে। অনেকক্ষণ পর সাদেক ভাই এর গলার আওয়াজ কানে মধু ঢালল। সেও আমাদের খুঁজতে বেরিয়েছে। কিছুক্ষনের মাঝেই আমরা সেই পাড়ার কারবারির বাসায় আশ্রয় নিলাম। এখানকার ঘর গুলো অনেক বড় বড় এবং মজবুত, ঠাণ্ডাও কম লাগে।
উনাদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এটা একটা মুরং পারা। তাদের নিজস্ব ধর্ম আছে, ধর্মের নাম ক্রামা। এটা পৃথিবীর সব চেয়ে নবীন ধর্ম, তাদের ধর্ম প্রচারক এখনও জীবিত। ওদের নিজস্ব বর্ণমালা ও আছে। অনেক দিন পর চা খাওয়ার সৌভাগ্য হল। দুধ চা নাই স্বাভাবিক ভাবেই, কিন্তু এতদিন পর চা পেয়ে মনে হল অমৃত।
সাদেক ভাই দুইটা মুরগি জোগাড় করে রান্না করতে বসে গেল। আমরা হালকা গল্প গুজব করলাম। ভাত রান্না হতেই খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে গেলাম। পরদিন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে বান্দরবান ট্যুর এর সবচেয়ে লম্বা হাইক।
আগামি পর্বে আপনাদের জন্য থাকছে কেওক্রাডং জয়ের গল্প।
প্রথম পর্বের লিঙ্ক ঃ Click This Link
দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক ঃ Click This Link
তৃতীয় পর্বের লিঙ্ক ঃ Click This Link