বাঙালি মধ্যবিত্তে পরিবারে জন্ম, মিশেছিও মূলত এই শ্রেণীর মানুষের সাথেই সবচেয়ে বেশি, তাই এই শ্রেণীটাকেই চিনি অন্য যে-কোনো শ্রেণীর চেয়ে ভালোভাবে। ইনসাইডার হিসেবেই এই লেখাটা লিখলাম, নায়কগিরিতে বিশ্বাসী নই, তাই এই লেখা যে লিখেছে তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তথাপি মাঝে মাঝে নির্মোহভাবে দাঁড়াতে হয় আয়নার সামনে, তাতে নিজের মিথ্যে ইগোর অন্তঃসারশূন্যতা ও হাস্যকরতার মুখোমুখি হওয়া যায়, সেই তাড়না থেকেই এই লেখার জন্ম।
১ রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের ভেতরে এক ধরণের আলগা সেন্টিমেন্ট কাজ করে। এটা হয় এসব সম্পর্কে তার ভেতরে কোনো গভীর ইমোশন না থাকার কারণেই। তাই একটু রাজনীতি, একটু সংস্কৃতি, একটু ধর্ম করে করেই সে কবরে যায়/চিতায় ওঠে; এসবের কোনোটার ক্ষেত্রেই সে এমন কোনো বোধ অর্জন করতে পারে না যা তাকে প্ররোচিত করতে পারে সমাজের কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের সংগ্রামে শামিল হতে, আর যদিও বা সে শামিল হয় খুব দ্রুতই তার ধৈর্য ফুরিয়ে যায়।
২ বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের আদর্শ গণ্ডার। এটা সে জানে, খুব ভালোই জানে, কিন্তু স্বীকার তো করেই না বরং নিজের শ্রেণীর বা অন্য শ্রেণীর কাউকে খুব ক্ষীণকণ্ঠেও যদি সে এটা বলতে দ্যাখে তাহলে সেই বক্তার ওপর সে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্র ও অবোধ জন্তুর মতো। বাঙালি মধ্যবিত্ত সবচেয়ে ভয় পায় নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে, কারণ তাতে তার আস্তিত্বিক অর্থহীনতা তার কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়বে, সে দুনিয়ার সবাইকেই দ্যাখে শুধু নিজেকে না দেখে।
৩ বাঙালি মধ্যবিত্তের এক বিরাট বিকারের নামঃ শ্লীলতা। শ্লীলতার মানবিক সীমাকে সীমাহীনভাবে প্রসারিত করে বাঙালি মধ্যবিত্ত একে পরিণত করেছে এক অসুস্থ বিকারে। নারীপুরুষের স্বাভাবিক কামবাসনা বাঙালি মধ্যবিত্ত সহ্য করতে পারে না, অথচ ধর্ষণকে সে সহ্য করে যায় আশ্চর্য সহনশীলতার সাথে, এই হচ্ছে বাঙালি মধ্যবিত্তের শ্লীলতাধারণা।
৪ বাঙালি মধ্যবিত্ত রুটলেস, স্বেচ্ছায়ই, কারণ সামান্য অর্থনৈতিক সচ্ছলতার মুখ দেখলেই বিস্মৃত হয় তার শেকড়। সে অধিকাংশ সময়ই উঠে আসে গ্রাম থেকে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে কালো চামড়া শাদা মুখোশ হবার 'শিক্ষা' অর্জন করার পর সে সবার আগে ঘেন্না করতে শেখে তার গ্রামকে। বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে 'খ্যাত' একটা গালি, যা দিয়ে সে নির্দেশ করে স্মার্টনেসের অভাব, যেই কৃষকের রক্ত-পানি-করা শ্রমের ফসল খেয়ে সে বেঁচে থাকে তার প্রতি এই অসুস্থ অবজ্ঞাতেই প্রকাশ পায় বাঙালি মধ্যবিত্তের শেকড়হীনতা।
৫ বাঙালি মধ্যবিত্ত বীর খুঁজতে পছন্দ করে। সে বিশ্বাসী নয় সাংগঠনিকতায় ও সংঘশক্তিতে। অন্ধ-অনুসরণ বাঙালি মধ্যবিত্তের প্রিয় আদর্শ।
৬ বাঙালি মধ্যবিত্ত উদ্যোগ নিতে ভয় পায়। সে দাসের মতো কেরানিগিরি করে জীবনযাপন করতে পছন্দ করে একটা চরম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায়, তার সন্তানের ভেতরেও বপন করে এই ধারণা যে কেরানি হওয়াই হচ্ছে জীবনের স্বার্থকতা, এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই তৈরি করেছে পৃথিবীর সবচেয়ে 'ঐতিহাসিক' কেরানিশ্রেণীকে। তাই বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে একজন লেখক, বিজ্ঞানী বা শিল্প-উদ্যোক্তা কখনোই আইকন হয় না।
৭ বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে গম্ভীর থাকাই পার্সোনালিটি। প্রাণখুলে হাসতে ভয় পায় সে, যেন ক্ষতি হয়ে যাবে তাতে, বা হাসির সাথে ব্যক্তিত্বের বিরোধ রয়েছে। সে প্রাণখোলা হাসি সহ্য করতে পারে না, মেপে মেপে হাসে, এবং কাউকে প্রাণখুলে হাসতে দেখলে ভীষণ বিরক্ত হয়।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১৩ রাত ১০:৪৬