স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতকে আর কখনো এতটা বিপদে পড়তে হয়নি। অন্যভাবে বলা যায় সব সময় তারা সুবিধা পেয়েছে। বিশেষ করে সরকারি প্রশাসনের। এই সুবিধা নিয়েই বেড়ে উঠেছে জামায়াত।
জামায়াতের বেড়ে ওঠা, সাংগঠনিক দক্ষতাকে অনেকেই সমীহের চোখে দেখেন। এই সমীহের আর একটি বড় কারণ জামায়াত বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক। টাকার অঙ্কে জামায়াত ঠিক কত হাজার কোটি টাকার মালিক, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ব্যাংক, বীমা, ক্লিনিকসহ জামায়াতের দৃশ্যমান সম্পদের পরিমাণই বিপুল। অদৃশ্য সম্পদও তাদের রয়েছে বলে জানা যায়। মধ্যপ্রাচ্যসহ আরো কয়েকটি দেশে থাকা জামায়াতের সম্পদের পরিমাণও কম নয়।
গরিব দেশের ধনী একটি রাজনৈতিক দল জামায়াত!
সেই জামায়াতের অবস্থা এখন করুণ। বড় নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুরু হয়ে গেছে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া। যা তারা করেছিল ’৭১-এ।
২.
এই জামায়াত নেতারা সবসময় জোর গলায় বলে এসেছে তারা যুদ্ধাপরাধ করেনি। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। এই কথাগুলো বলতে গিয়ে তারা ভয়ঙ্কর রকমের দাম্ভিকতার পরিচয় দিয়েছে বিভিন্ন সময়। মুক্তিযুদ্ধকে তারা বলেছে ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই’, ‘মুক্তিযুদ্ধ নয়, ভারতে গিয়েছে সুন্দরী নারীর লোভে’ ইত্যাদি অরুচিকর এবং দাম্ভিকতাপূর্ণ বক্তব্য তারা ইতোপূর্বে দিয়েছে। এবং তারা বোঝাতে চেয়েছে বাংলাদেশের কোনো সরকারের ক্ষমতা নেই তাদের বিচার করার, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার। সৌদি আরব, পাকিস্তান, আমেরিকা তাদের পক্ষে, আকারে-ইঙ্গিতে সব সময়ই তারা এমনটা বোঝাতে চেয়েছে। বলেছে, জামায়াতের গায়ে কেউ টোকা দিতে পারবে না। এমন কিছু করা হলে দেশ অচল করে দেয়া হবেÑ ইত্যাদি।
জামায়াতের গায়ে টোকা দেয়া শুরু হয়েছে, নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বিচারিক প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু মাঠে জামায়াতের সাড়াশব্দ নেই বললেই চলে। দেশ অচল করে দেয়া তো দূরের কথা, পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে একটি মিছিল পর্যন্ত তারা করতে পারছে না। সাংগঠনিক শক্তির কোনো প্রমাণ দেখা যাচ্ছে না জামায়াতের রাজনীতিতে। এত শক্তিশালী হিসেবে প্রচার করা শিবিরকে এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি কঠোর নীতির কারণে অধিকাংশ শিবির নেতা-ক্যাডার পলাতক। পলাতক জামায়াতেরও কোনো কোনো নেতা। আরো অনেক জামায়াত-শিবির নেতা অল্প সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার হবেন, এটাও নিশ্চিত। জামায়াত ঘরোয়া সভা করে এর বিরুদ্ধে মৃদু প্রতিবাদ করছে। পূর্বের হুমকি-দাম্ভিকতার সঙ্গে যার কোনো সামঞ্জস্য নেই।
এর কারণ কী? জামায়াত-শিবির কেন এতটা নমনীয়? এটা কি তাদের রাজনৈতিক কৌশল না অক্ষমতা? এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য একটু পেছনে ফিরতে হবে।
’৭১-এর অপকর্মের কারণে গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদদের বাংলাদেশের মানুষ শুধু অপছন্দ করে না, ঘৃণা করে। ধর্ম নিয়ে তারা ব্যবসা করছে সেটা বুঝে গেছে দেশের মানুষ। এত প্রতিকূল অবস্থায় জামায়াতের জন্য দেশে রাজনীতি করা শুধু কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভব। এ কারণেই জামায়াত রাজনীতির চেয়ে ব্যবসার দিকে বেশি মনোযোগী হয়েছে। গরিব মানুষের কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ এনেছে। সেটা দিয়ে ব্যবসা করে তারা অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছে। তাদের এই অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়ার পেছনে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-ও একটি ভূমিকা রেখেছে।
জামায়াতের সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক কিছুসংখ্যক নেতা। তারা হঠাৎ করে শিল্পপতি হয়ে গেছে। জীবনযাপন বদলে গেছে। অন্য রাজনৈতিক নেতাদের মতো তারা কোটি টাকা দামের গাড়িতে চড়ে। বিলাসী জীবনযাপন করে। শিবিরসহ অধিকাংশ কর্মীকে তারা দলে টেনেছে অর্থের লোভ দেখিয়ে। বিষয়টি এমন যে জামায়াত বা শিবিরের সদস্য হলে তার ‘চাকরি’ নিশ্চিত। আদর্শ বা ধর্ম নয়। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা দলে এসেছে অর্থনৈতিক লাভের আশায়।
অর্থনৈতিক লোভে যে দলে এসেছিল, বিপদের দিনে সে হয় গা-ঢাকা দিয়েছে অথবা চুপচাপ আছে। রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার জন্য যে আদর্শিক শক্তি প্রয়োজন হয়, তা তার নেই। জামায়াতের আদর্শকে তো সে কখনো বিশ্বাসই করেনি। সে কেন রাস্তায় নেমে পুলিশের মার খাবে, জীবন দেবে?
এ তো গেল কর্মীদের কথা। নেতাদের অবস্থা কী? নেতারা যারা বিত্তবান হয়েছেন তারা কী করছেন?
তারা এখন যে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, সেখান থেকে আর কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। তারা এখন ব্যস্ত অর্জিত সম্পদ টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে। এর জন্য যাকে যেভাবে হাত করা দরকার, তাকে সেভাবেই হাত করছেন, করার চেষ্টা করছেন। এর জন্য তারা এখন অনেক অর্থ-সম্পদ ব্যয় করছেন। উপরের দিকের কয়েক নেতার জেল-ফাঁসি যাই হোক না কেন, এটা নিয়ে তারা খুব একটা চিন্তিত নয়। উল্টো এদের জেল-ফাঁসির মধ্য দিয়ে যদি তাদের অর্থ-সম্পদ রক্ষা পায় তাতেই তারা খুশি।
৩.
জামায়াত সব সময়ই ‘ভুল’ রাজনীতি করে এসেছে। প্রশাসনের সহযোগিতায় তারা নিজেদের শক্তিশালী ভেবেছে। সিভিল, সামরিক আমলাতন্ত্রে নিজেদের ক্যাডার তৈরি করতে চেয়েছে। পেরেছিলও অনেকটা। কিন্তু ১/১১-এর পর সেটাও ব্যর্থ হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে যাদের তৈরি করা হয়েছিল তাদের প্রায় সবাই এখন চাকরিচ্যুত। বিশেষ করে উপরের দিকে যারা ছিল। এই আমলাতন্ত্রের দাপটে বিএনপিকেও তারা বিভিন্ন সময়ে কোণঠাসা করে রাখতে চেয়েছে। বিশেষ করে ১/১১-এর সময়ে জামায়াতের দাপট ছিল দেখার মতো। প্রকাশ্যে তারা বিএনপির সমালোচনা করেছে। বলেছে, বিএনপির দুর্নীতির দায় জামায়াত নেবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যখন সব রাজনৈতিক নেতাদের করুণ অবস্থা, তখনো জামায়াত বিচরণ করেছে দাপটের সঙ্গে। সেই সময় তারা চূড়ান্তভাবে সরকারি প্লট বুঝে নিয়েছে, বনানী-উত্তরায় বাড়ি করেছে নিজামী-মুজাহিদ। সেই প্লট নেয়ার ক্ষেত্রেও তারা অনিয়ম করেছে। বিএনপি ক্ষমতায় না থাকলে যে প্রশাসনে তাদের সমর্থনও থাকবে না, এটা তারা একবারও হিসেব করেনি। মনে করেছে বিএনপির চেয়ে তারা শক্তিশালী হয়ে গেছে।
বদলে যাওয়া বিশ্ব প্রেক্ষাপটও জামায়াত মাথায় রাখেনি। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা এখন যে সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর পক্ষে সম্ভব নয়, সেটা জামায়াত হিসেবে রাখেনি। যুদ্ধাপরাধ, জঙ্গিবাদ ইস্যুতে আমেরিকার অবস্থান যে তাদের বিপক্ষে চলে যাবে, এটাও জামায়াত বুঝতে পারেনি। ভারত যেভাবে চাইবে আমেরিকা যে সেভাবেই এই অঞ্চলে কাজ করবে, এই মেরুকরণও জামায়াত বুঝে উঠতে পারেনি। পাকিস্তান নয়, ভারত যে এই অঞ্চলের রাজনীতি-অর্থনীতি-সামরিক নীতির চালকের আসনে থাকবে, এটা বুঝতে না পারাটাও জামায়াতের করুণ অবস্থার অন্যতম কারণ।
৪.
অর্থ-সম্পদ তাদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে। তাদের এই অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়াটাও আর একবার ‘ভুল’ হিসেবে প্রমাণ হলো। অর্থ-সম্পদ নয়, রাজনীতির প্রধান শক্তি জনসমর্থন। জামায়াত কখনো জনগণের কাছে যেতে পারেনি। জনগণ তাদেরকে বিশ্বাস করতে পারেনি, আস্থা রাখতে পারেনি তাদের ওপর। তারা জনগণকে ‘লোভ’ দেখিয়ে দলে টানতে চেয়েছে। যারা এসেছে ‘লোভে’ এসেছে, আদর্শ বিশ্বাস করে আসেনি। তাই এখন মিছিল করার কর্মী-ক্যাডারও তাদের নেই। সম্পদ মানুষকে বিপ্লবী, সংগ্রামী করে না। মানুষকে আপোসকামী করে। আর জামায়াতের সম্পদের মালিক তো তাদের নেতারাই। সেই নেতারা এখন ‘আপোস’ করছেন।
দৃশ্যমান এত সম্পদ রেখে আন্দোলনে গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, তাদের দুর্বল করা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ। সম্পদ অর্জন করার জন্য যে অপকর্ম করেছে তার জন্য রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে সহজেই ব্যবস্থা নিতে পারে। সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার অধিকার তো রাষ্ট্রের হাতে সবসময় থাকেই। অর্থ-সম্পদের মালিক জামায়াত নেতারা অর্জিত সম্পদ হাতছাড়া হতে পারেÑ কোনোভাবেই এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছেন না।
নেতাদের মুক্তির দাবিতে লোক দেখানো কিছু কর্মসূচি তারা নেবেন, নেয়ার চেষ্টা করবেন। অর্থের বিনিময়ে কিছু নাশকতাও হয়ত করাতে চাইবেন কোনো কোনো জামায়াত নেতা। তবে বর্তমানে যারা জামায়াত পরিচালনা করছেন, অর্থ-সম্পদের মালিক এই মীর কাশেম আলীরা সরকারকে বেশি বিরক্ত করতে চাইবেন না। সরকারের বিরাগভাজন হতে চাইবেন না। ম্যানেজ করতে চাইবেন কর্তাব্যক্তিদের কাউকে কাউকে। পারবেনও হয়ত কিছুটা। এই ‘ম্যানেজ’ করতে পারবেন বলেই জামায়াতের বিপদ এক সময় কেটেও যাবে। যদি আমাদের প্রগতিশীল রাজনীতিকদের কাউকে কাউকে ম্যানেজ করতে না পারত, তবে এই ধাক্কায় ধ্বংস হয়ে যেত জামায়াত।
জামায়াতের অস্তিত্ব টিকে থাকলেও বড় কোনো শক্তি হয়ে উঠতে পারবে না। তার এই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যও প্রয়োজন হবে বিএনপির সহযোগিতা। অতীতের মতো বিএনপি যদি জামায়াতকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়, তবে জামায়াত বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে।
অর্জিত অর্থ-সম্পদ জামায়াতের রাজনীতিতে কোনো উপকারে লাগবে না। দলীয় সম্পদ ভোগ করবে কিছু সংখ্যক নেতা। এই নেতাদের কেউ কেউ জামায়াতের রাজনীতি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে চাইবে। কেউ কেউ নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে। ভাঙ্গনও দেখা দিতে পারে দলে। পরস্পর সন্দেহ, কোন্দল বাড়বে। আদর্শহীন রাজনীতি, ধর্ম ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়বে। সম্পদের কারণেই বড় কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে যেতে পারবে না জামায়াত। ৪ দলীয় জোট যদি বড় কোনো আন্দোলন গড়ে তোলে, তবে বুঝতে হবে সেই আন্দোলনের প্রধান শক্তি বিএনপি, জামায়াত নয়। বড় আন্দোলন, সংগ্রাম করার শক্তি, সামর্থ্য, ক্ষমতা কোনোটাই নেই জামায়াতের। অর্থ-সম্পদের কারণেই তারা সেটা হারিয়েছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




