আসন্ন সংসদ নির্বাচনঃ ফলাফল যা আছে তাই থাকবে?
শরীফ হোসাইন মৌন
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২০০৭ সালের ২২ শে জানুয়ারীর মধ্যবর্তী সময়কাল আর ২০০৮ সালের এখনকার মুহূর্তটি একই রকম টানটান উত্তেজনাকরই মনে হচ্ছে। শুধু পাত্র-পাত্রী ও বক্তব্যের মধ্যে অসাধারন বৈপরীত্য, এই আর কি!
তখন আওয়ামী লীগ ও সমমনা কমিউনিষ্টদের জোঁক ছিল নির্বাচন বর্জনের দিকে আর এখন সেই কাজটা করছে বিএনপি।আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলোর দাবী আদায়ের সেদিনের প্রক্রিয়াটি ছিল সহিংসতা ও খুন-খারাবিতে পূর্ন। আর আজ বিএনপির নেতৃত্ত্বাধীন চার দলের দাবী দাওয়াগুলো অহিংস ও নিরুত্তাপ বক্তৃতা-বিবৃতিতে পূর্ন। দুই বছর পূর্বের বাতিল হওয়া নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তের সময় গুলো ভাবলেই গা শিউরে উঠে। জান হাতের মুঠোয় নিয়ে পাবলিক সেদিন রাস্তায় বেরুত। দেশের আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতির কথা না হয় বাদই দিলাম। একই রকম রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সংকটে চারদলীয় জোটের আচরনটি প্রশংসার দাবীদার। এ থেকে সাধারন জনগন দুই দলের মন মানসিকতার বিচার করতে পারে। কিন্তু মনে হচ্ছে চার দলীয় জোটের দাবীটি আগ্রাহ্য হবে। তাহলে এটাই প্রমান হবে এ মরার দেশে উচিত কথার ভাত নেই, গায়ের জোরেই ন্যায়-অন্যায় দাবী আদায় করা সম্ভব?
একটি গনতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বর্জনের অযৌক্তিক আওয়ামী সহিংস ভাষা যা বিদেশীদের ইন্ধনে হয়েছিল , সেদিন জনগনের দৃষ্টি কেড়েছিল। আর আজ পরাশক্তি সমর্থিত অগনতান্ত্রিক, সংবিধান বহির্ভূত জরুরী সরকারের পাতানো নির্বাচনের বিপক্ষে চারদলের যৌক্তিক দাবীর প্রতি জনগন ও মিডিয়ার দৃষ্টি উল্লেখযোগ্য নয়। এরই নাম বাংলাদেশ!
অযৌক্তিক সহিংসতা এদেশের দরিদ্র,অশিক্ষিত,অর্ধ-শিক্ষিত ও অপশিক্ষিতদের দৃষ্টি কাড়ে। তারা পুলক ও কম্পন অনুভব করে এবং তাদের মনে শক্তিমানের(অপশক্তি)প্রতি শিশুসুলভ প্রীতির সৃষ্টি হয়। এই সমাজেরই সৃষ্ট মিডিয়া কর্মীরাও সেই প্রীতিরই জয়গান গায়! সব মিলে বলা যায়, যেমন পাবলিক, তেমন নেতা,তেমন সরকার আর তেমনই বুদ্ধিজীবী।
এক-এগারো;পরাশক্তি মার্কিন,বৃটেন ও ভারত এই তিন অক্ষশক্তির দীর্ঘ দিনের সফল ষড়যন্ত্রের ফসল। মোটা বুদ্ধির কিছু লোক আছে এই সরল সত্যটাকে এখনো মানতে নারাজ। এদেশীয় যেসব এজেন্টরা এই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল তারা স্বভাবতই তার বিরোধীতা করবে। আর যারা এক-এগারোর সুবিধাভোগী তারা ও একে ষড়যন্ত্র বলে জনসমক্ষে মানতে নারাজ। এই দুই প্রকার দেশপ্রেমিকদের(!)অসম্মতিতে আমাদের কোন ক্ষোভ নেই। কিন্তু এর বাহিরে যারা সুবিধাভোগী কিংবা ষড়যন্ত্রকারী নয় কিন্তু পরাশক্তির উৎপাদিত বলে এই সরকারকে মনে করেনা কিংবা হোক পরাশক্তির তবু দূর্নীতি পরায়ন আওয়ামী-বিএনপির চেয়ে উত্তম –এমন ধারনা পোষণ করে তাদের কি বলা যায়? এক কথায় আবাল। আবাল নোয়াখালী অঞ্চলে বহুল প্রচলিত একটি জনপ্রিয় আঞ্চলিক শব্দ। যে ষাড় গরুটির অন্ডকোষ অপসারনের মাধ্যমে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে কলুর বলদের মতো নির্দ্বিধায় অনবরত চাষাবাদের লাঙ্গল টানাতে সক্ষম করে গড়ে তোলা হয়-তাই আবাল। মানুষ নামের দ্বি-পদী এই আবালগুলোর প্রতিবাদের ভাষা নেই আছে আত্নসমর্পনের অগাধ স্বামর্থ্য। এরা রাজনীতিকে ঘৃনা করে। এরা যুদ্ধকে ভয় করে। এরা আত্নকেন্দ্রিক,স্বার্থপর। এরা পুঁজিবাদী। এরা নিজের পরিবার নিয়েই ভাবে। পুজিঁবাদী খোলসে এরা নিজেদের চাকচিক্যময় করে গড়ে তোলে। এরা মিডিয়ার খেলার পুতুল। এদের জন্ম ড্রইং রুমের টিভি সেটের সামনে মৃত্যুও সেখানে। সেখান থেকেই বিকশিত হয় এদের চিন্তা চেতনা। এরা আপন আপন কামনা বাসনা ও স্বার্থপরতার খোলসে শামুকের মত নিজেদের গুটিয়ে রাখে। এরা অন্ধ। এরা উচ্চ শিক্ষিত হতে পারে কিন্তু তবু এরা মূর্খ।এরা সুবিধাবাদী।পরাশক্তির হাতের ক্রীড়নক হয়ে নগদ নারায়ন প্রাপ্তিকেই এরা জীবনের চরম ও পরম স্বার্থকতা জ্ঞান করে এবং অনুকূল পরিবেশে রাজনীতিবিদদের বংশ ধরে গালাগাল করাকে সততা ও পান্ডিত্যের মাপকাঠি মনে করে।
কোন মিথ্যাই যেমন বৃথা যায়না তেমন কোন অন্যায় ও ফলহীন থাকেনা । নিপীড়কের প্রতিও কখনো কখনো নিপীড়িতের অত্যাশ্চর্য্য মোহের জন্ম নেয়।মানবিক এ দুর্বলতা কোথাও কোথাও শোষককে শোষিতের প্রেমরসে সিক্ত করে। তখনই মানুষ পরাজিত হয়। যারা মানেনা এ পরাজয়, জেগে থাকে, জেগে উঠে, হুংকার ছুঁড়ে ছিঁড়ে ফেলে পরাশক্তির গোলামীর শেঁকল তারাই পুরুষ। বাকী সব আবাল। হোক সে ডক্টরেটধারী, ধনপতি,জনপ্রিয় সাহিত্যিক, অভিনেতা কিংবা আরো কিছু। সর্ব বিচারে সে পরাশক্তির গোলামীতেই স্বর্গীয় সুরা পান করে। যে কোন দখলদার সামরিক শাসকদের আমলে এই সুরা পানকারীরা সংখ্যাধিক্য ঘটে। যেমন আজ বাংলাদেশে বেড়েছে পরাশক্তির প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে লালিত পালিত তাদেরই উচ্ছিষ্টভোগী সুশীলদের প্রাদুর্ভাব। কারো কারো মনে জিজ্ঞাসা ,প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে বাংলাদেশের গ্যাসের প্রতি পরাশক্তির লোভনীয় দৃষ্টি আছে সেটা না হয় বোঝা গেল, মুসলিম দেশ বলে এ দেশ পরাশক্তির টার্গেটে আছে সেটাও না হয় বোঝা গেল কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশকে নিয়ে আমেরিকার এত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকবে কেন? আর কেনই বা তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল ভারতকে সে ষড়যন্ত্রর সঙ্গী করবে? বাংলাদেশে এমন কী আছে? যা আমেরিকায় নেই।
কাউকে যদি বলা হয়, ঢাকার মতিঝিলের এক খন্ড জমি অথবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত বাগেরহাটের এক খন্ড জমির যেকোন একটা বেছে নিতে, সে নিঃসন্দেহে মতিঝিলের জমিটিই বেছে নিবে। দুটোই সমমাপের তবে কেন মতিঝিলের ভূ-খন্ডের প্রতি এত লোভ? কারন অবস্থানগত কারনে এর মূল্য বেশী। বাংলাদেশের প্রতিবেশী উদীয়মান শক্তি ভারত যার সাথে রয়েছে ইসরাইল ও আমেরিকার সামরিক সখ্য, আরেক প্রতিবেশী মায়ানমার যার বুক পর্যন্ত এসে গেছে চীনের সড়ক যোগাযোগ। আছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান এবং তার পাশ জুড়ে বিশাল রাশিয়া ও ইরান। একটা ঘাঁটি যদি বঙ্গোপসাগরের সোনাদিয়ায় বা কুতুবদিয়া বা মহেশখালীতে করা যায় তো একযোগে নজর রাখা ও ভীতি সঞ্চার করা যাবে এই সব দেশে। কত দামী তাহলে এই মহেশখালী, কুতুবদিয়া কিংবা সোনাদিয়া যদিও এসব ভূ-খন্ডের তলদেশে গ্যাস কিংবা অন্যকিছুর সন্ধান এখনো নেই। যদিও সম্ভাবনা প্রবল। ড: ইউনূসের গভীর মহা সমুদ্র বন্দরের ভাবনাটা কি আমেরিকার ভাবনা নয়? কাজেই বাংলাদেশকে নিয়ে মার্কিন পরিকল্পনাটা সাজানো গোছানো ও দীর্ঘ হবে এতে আশ্চর্য কী!
ভারতকেই যদি ভয় দেখানো হবে তবে তাদের সাথে রাখা কেন? কারন সোজা। চরের দখলীকৃত ভূমির দেখভাল করবে চরেরই কোন এক লাঠিয়াল। জমিদারকে সময়মতো রিপোর্ট করলেই চলবে। শহরে বসবাসরত গ্রামের প্রভাবশালী লোকটি হঠাৎ গ্রামে গেলে গ্রাম্য চামচাটি যেমন পাশে থাকে আরকি।
পরাশক্তির সৃষ্ট এক-এগারোর ব্যাপারটি যখন পরিস্কার, ষড়যন্ত্রকারী এদেশীয় সুবিধাভোগী সুশীলরা যখন চিহ্নিত, পরাশক্তির মিডিয়া যখন ১/১১-র কৃতিত্ব জাহিরে মগ্ন, নষ্ট হয়ে যাওয়া ২২শে জানুয়ারীর নির্বাচনে যিনি সংবিধান লংঘন দেখেন , আসন্ন ১৮-ই ডিসেম্বর নির্বাচন হওয়াকে সেই ড: আকবর আলী যখন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার আলোকে দেখেন-তখন কী লাভ এই পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহন করে? প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আওয়ামী-প্রীতি, মান্নান ভূঁইয়া-প্রীতি, আওয়ামী লীগের ভারত ও আমেরিকার সন্ত্রাস বিরোধী অনন্ত যুদ্ধপ্রীতি-নির্বাচনের ফলাফল কী হবে তা কি আমাদের জানিয়ে দেয়না?
অনুষ্ঠিত মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচনে সব মেয়র আওয়ামী লীগের , অধিকাংশ কাউন্সিলর বিএনপি থেকে নির্বাচিত হয়। প্রশ্ন জাগতেই পারে কাউন্সিলররা কার ভোটে জয়যুক্ত হয়েছেন আর মেয়রদেরকে ভোট দিয়েছে কে? আর ফলাফল ঘোষনা করেছে কে? বেসরকারী প্রচার মাধ্যমে সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষনা নিষিদ্ধ করে সিইসি যে রুল জারি করেছে, তাতে নির্বাচনের ফলাফল বুঝতে আমাদের আর বাকী থাকে কেন? শেখ হাসিনা তার নাকে ক্ষমতার ঘ্রান পাচ্ছেন। বিএনপি আছে পরাজয়ের আশংকায়। কিন্তু তথাকথিত হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে জিতে আসবে দুই দলের পরাশক্তির প্রিয় সুশীলরা। রাজনৈতিক এতিম ড: কামালদের সমন্বয়ে গঠিত হবে জাতীয় সরকার তথা ফখরুদ্দিনের সংশোধিত রুপ নির্বাচিত(!) জনপ্রতিনিধি। নতুন বোতলে পুরোনো মদ। কি হবে এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাহলে? সুশীলদের রিজার্ভ বেঞ্চে অপেক্ষমান দ্বাদশ খেলোড়ার তথা ড: আকবর আলী, ড: মোজাফফর আহমদ, সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান এখন মাঠে নেমে পড়েছেন, এখন তারা খেলবেন। ভাড়াটে সুশীলরা ইদানিং নির্বাচন না হলে(অর্থাৎ কেউ নির্বাচনে না গেলে) অদৃশ্য অপশক্তির আশংকা(আসলে হুমকি) দেখান। এটা অনেকটা অন্ধকার ঘরে কেউ আমাদের লাইটের সু্ইচ অফ করে দেয়ার ভয় দেখানোর মত। দেশ পরাশক্তির দখলেই আছে, নির্বাচনে গেলে কিংবা না গেলেও তাদের দখলেইআছে যতক্ষন না তাদের তা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। আওয়ামী লীগ,বিএনপি, জামায়াতের কি বোধদয় হবেনা?
এত এত ডক্টরেটদের মাথা কিনে , আওয়ামী লীগের মত স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দলকে বোকা বানিয়ে দীর্ঘ দিনের ষড়যন্ত্রের সফল বাস্তবায়নের ভেতর যে ১/১১ আমেরিকা আমাদের উপহার দিয়েছে তার সুবিধা আদায় না করেই তথাকথিত ইলেকশনের ভেতর দিয়ে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের কাছে তারা ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে , তা কি সম্ভব? সম্ভব না বলেই একটা পাতানো নির্বাচনের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রীয় সিংহাসনে নতুন খেলোড়ারদের অভিষেক ঘটবে। তাদের ক্ষমতাও পাকাপোক্ত হবে আর আমাদের গনতান্ত্রিক নির্বাচনের স্বাধ ও মিটবে। আজ হোক , কাল হোক গন অভ্যুন্থান ও বিপ্লবের ভেতর দিয়েই এ পরাশক্তিকে উচ্ছেদ করতে হবে। নির্বাচন নামের পাতানো ফাঁদে কখনোই পরাশক্তির উচ্ছেদ সম্ভব নয়। বিএনপি এ সত্য কিছুটা বুঝলেও আওয়ামী ক্ষমতা-পিপাসুদের কারনে সে বিপ্লব সহসা হচ্ছেনা। কারন তথাকথিত পশ্চিমা গনতন্ত্রের রশিটি তাদেরই হাতে। অতিরিক্ত গনতান্ত্রিক হতে গিয়ে আমরা পুঁজিবাদী হয়ে গেছি, ভুলে গেছি বিপ্লব। রাজতন্ত্রের ভেতর থেকে থেকে যেমন নি:শব্দ আবাল শ্রেনীর সৃষ্টি হয় পশ্চিমা গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে থেকে থেকে আমরাও তেমনি মিছিল সর্বস্ব আবাল জাতিতে রুপান্তরিত হয়েছি।
১৯/১১/০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।






