ইহুদি, ক্রিশ্চিয়ানিটি ও ইসলাম থেকে ইয়াজিদি ধর্মমতে সৃষ্টি তত্ত্বে ভিন্নতা রয়েছে। তারা বিশ্বাস করে খোদা সর্বপ্রথম তাউস মালেকে সৃষ্টি করেন তাঁর নিজের রূহানী থেকে এবং তাকে অন্য কোন সৃষ্টিকে সিজদা না করার নির্দেশ দেন। এরপর খোদা অন্যান্য ছয় প্রধান ফেরেস্তাকে সৃষ্টি করেন এবং তাদেরকে পৃথিবী থেকে মাটি সংগ্রহের নির্দেশ দেন। তারা তা নিয়ে এলে তিনি ঐ মাটি দিয়ে আদমকে সৃষ্টি করেন এবং নিজের শ্বাস ফুঁকে দিয়ে তাকে জীবন দেন। এরপর তিনি ফেরেস্তাদের নির্দেশ দেন আদমকে সিজদা করার। এই নির্দেশ তাউস মালেক ছাড়া সকলেই পালন করে। খোদা তাকে সিজদা না করার কারণ জিজ্ঞেস করলে তাউস মালেক উত্তরে বলেন- “How can I submit to another being! I am from your illumination while Adam is made of dust.” তখন খোদা তার প্রশংসা করেন এবং সকল ফেরেস্তাদের সর্দার করে দেন। এরপর তাকে পৃথিবীতে তাঁর ডেপুটি হিসেবে নিয়োগ দেন।
ইয়াজিদিগণের নিকট প্রধান ঐশ্বরিক চরিত্র হচ্ছে মালেক তাউস। আর তাকে উপাসনা করা হয় ময়ূর রূপে কল্পনা করে। তিনি অন্য আর ছয় ফেরেস্তা নিয়ে মহাবিশ্ব শাসন করেন। কিন্তু এই সাতজনের সকলেই সর্বশক্তিমান খোদার অধিনস্ত। তিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করার পর থেকে এর প্রতি সরাসরি আর কোন আগ্রহ দেখাননি। ইয়াজিদিগণ সাত ফেরেস্তাকে উপাসনা করে তাম্র বা লৌহের তৈরী সাতটি ময়ূরের মূর্ত্তির আকারে, যাকে বলা হয় sanjaq. আর এর সবচেয়ে বড়টির ওজন প্রায় ৭০০ পাউন্ড।
ইয়াজিদিগণ দ্বৈতবাদ বিরোধী। তারা অশুভ বা evil-এর অস্তিত্ব অস্বীকার করে। আর তাই তারা প্রত্যাখ্যান করে পাপ, শয়তান এবং নরককে। তাদের মতে, ঐশ্বরিক আইন অমান্য বা ভঙ্গ প্রায়শ্চিত্ত হয় পুনর্জন্ম বা আত্মার দেহান্তরের মাধ্যমে, যা আত্মাকে উত্তরোত্তর পরিশোধনে সাহায্য করে। ইয়াজিদিগণ আরও বলে থাকে, যখন Tawûsê Melek খোদার নিকট তার গর্বের দরুণ পাপের অনুশোচনা করে, তখন তাকে ক্ষমা করা হয় এবং ফেরেস্তাদের নেতার পূর্বপদ তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। আর এই উপাখ্যান (myth)-ই ইয়াজিদিগণকে অন্যদের নিকট শয়তানের পূজারী হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে। ইয়াজিদিগণ আরও বিশ্বাস করে, তাদের প্রধান ধর্মীয় গুরু শেখ আদি, পুনর্জন্মের মাধ্যমে ঈশ্বরত্ব লাভ করেছিলেন।
ইয়াজিদি ধর্মের প্রধান কেন্দ্র শেখ আদির সমাধিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এবং বাৎসরিক উৎসব উৎযাপিত হয় এই সমাধিস্থলেই। আদির এই সমাধিটি মসূলের উত্তরে, Ash-Shaykh ‘Adi শহরের প্রাক্তন নেস্তোরিয়ান খৃষ্টান আশ্রমে অবস্থিত। আরবীতে লিখিত দু’টি পুস্তিকা, Kitab al-jilwah (“Book of Revelation”) ও Mashaf rash (“Black Book”), ইয়াজিদিগণের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। আর শেখ আদিকে প্রশংসা করে লিখিত আরবী স্ববগানও (Arabic hymn) সম্মানের সাথে পঠিত হয়।
Encyclopaedia of Religion and Ethics: ইয়াজিদিগণ মসূল থেকে ককেশাস অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে। এদের সংখ্যা ৫০,০০০এর মত। তারা নিজেদেরকে Dasni হিসেবে পরিচয় দেয় এবং কুর্দিশ উচ্চারণে কথা বলে। তাদের সম্প্রদায়ের প্রধান হচ্ছেন একজন খলিফা, যিনি শেখ আদির একজন উত্তরসূরী। তার অধীনে রয়েছে sheikh, kavval, ও faqir-গণ। পৌরোহিত্য পুরুষানুক্রমিক। তাদের নৈতিকতা, ঐ এলাকার গড় নৈতিকতার উপরে। তারা সাহসী এবং ধূর্ত। তাদের মেজাজ প্রফুল্ল কিন্তু শান্ত। আর তারা পরিচ্ছন্ন স্বভাবের। তাদের মহিলারা বোরখা পরে না এবং হয়ত: অপরিচিতদেরও অভ্যর্থনা জানায়। নীল রং এর প্রতি তারা বড় ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখায়। পুরোপুরি অশিক্ষিত হওয়ায়, তারা তাদের প্রথা ও ঐতিহ্য মৌখিকভাবে বংশ পরস্পরায় এগিয়ে নিয়ে যায়।
ইয়াজিদি বিশ্বাস মতে খোদা বিশ্ব সৃষ্টির পর তা সাত পবিত্র আত্মা বা ফেরেস্তার তত্ত্বাবধানে ছেড়ে দেন। এই সপ্তকের মধ্যে প্রধান ছিলেন তাউস মালেক বা ময়ূর ফেরেস্তা। এই তাউস মালেককে মুসলিম এবং খৃষ্টানগণ শয়তান হিসেবেই চিহ্নিত করে থাকেন। অন্যদিকে ইয়াজিদিগণ বিশ্বাস করে, তিনি অমঙ্গল বা wickedness -এর উৎস নন। তারা তাকে পতিত ফেরেস্তা নয়, বরং ফেরেস্তাগণের নেতা হিসেবে বিবেচনা করে। এমনকি “শয়তান” শব্দ উচ্চারণ এবং বলা তাদের জন্যে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারা এমন ধারণা পোষণ করে যে, মানুষের নিজের হৃদয় এবং আত্মার মধ্যেই অমঙ্গলের উৎস, তাউস মালেকের মধ্যে নয়। এই ধর্মের মূল চালিকা শক্তি তাউস মালেক ও শেখ আদি।
ইয়াজিদিগণ বিশ্বাস করে তাউস মালেক খোদারই প্রতিরূপ এবং একজন হিতৈষী ফেরেস্তা। তিনি নিজেকে তার পতন থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন এবং পরে সৃষ্টিকর্তারূপে আবির্ভূত হন। তিনি Cosmic egg থেকে cosmos সৃষ্টি করেন। অনুশোচনার পর তিনি ৭,০০০ বৎসর ক্রন্দন করেন। তার চোখের জলে ৭টি পাত্র পূর্ণ হয়, আর তা দোযখের আগুনকে নির্বাপিত করে ফেলে। ফলে ইয়াজিদি বিশ্বাসে নরকের কোন স্থান নেই।
ইয়াজিদি বিশ্বাস মতে তাউস মালেক প্রত্যেকের দায়িত্ব-কর্তব্য, কল্যাণ ও আশীর্বাদ এবং দূর্ভাগ্য বন্টন করেন তেমনই, যেমন তার ইচ্ছে। আর তাই এ সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করা কারও জন্যে জায়েজ নয়। শেখ আদি আরও বিশ্বাস করতেন তার আত্মা ও তাউস মালেকের আত্মা একই, বলা যায় একই আত্মার নূতন দেহধারণ।
ইয়াজিদি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন