বড় ফুপা মারা যাবার পর থেকে মনে একটা বিষন্নতা কাজ করতেছে কদিন ধরে। ওদিকে মা এর হাতে নতুন ফোন পড়া মাত্রই দিনের মধ্যে ইমো তে হাজারটা কল। কল দিলে বলে কল তো দেই নাই। ভুলে টাচে কল চলে গেছে। কিছু বলি না, অসুস্থ মানুষ। কিন্তু কাল যেটা ব্যাতিক্রম হলো সমানে ভাইবারে উইচ্যাট ইমো তে কল। প্রথমে ভাবলাম ভুলে কল আসতেছে..."হ্যালো, কাহিনী কি? হইছে কি?"
ওপার থেকে মা এর গলা,"কোথায় গেলা? রনি কল করছে। কথা বলো।"
আব্বা ফোন ধরে উদাস ভাব,"কি হইছে? কল দিছো কেন?"
: আশ্চর্য্য, সকাল থিকা সমানে ভাইবারে উইচ্যাটে ফোন। ইমোতে ভিডিও কল। কাহিনী কি?
: ও আচ্ছা, এই তোমারে নিয়া দুশ্চিন্তায় আছি।
: দুশ্চিন্তা মানে? আমি কি যুদ্ধে গেছি নাকি?
: তোমাদের ঐ খানে নাকি আগুন লাগছে। সমানে ঘর বাড়ি গাছপালা জ্বলে ছাই। দুশ্চিন্তায় থাকি তো।
: আগুন লাগছে জঙ্গলে। আমি থাকি সাগর পাড়। যেই গরম পড়ছে, আগুন লাগবো না তো বরফ পড়বো নাকি।
: কত গরম?
: আজকা ২৭।
: কও কি? আমাগো এইখানে গতকালকাও ৩২ আছিলো। তোমাগো ২৭ এই আগুন?
: এইখানে গাছপালা বেশী। জঙ্গল শুরু হইলে খালি জঙ্গলই। কোনো খালি নাই। তাই গরম বেশী পড়লেই আগুন লাগে।
: কিসের গাছপালা তোমাগো। বাংলাদেশে এখন যেই গাছ। ঢাকার বাইরে গেলে পুরাই সবুজ। মনে হয় পুরা দেশটাই সবুজ হইয়া গেছে।
: এ্যা.... তো জঙ্গলে মঙ্গল করো। আর কিছু কইবা?
: তোমারে একটা কথা কই। তোমার ফুপুর হজ্বের ৩ লাখ টাকা মাইর গেছে। তো আগামী বছর আমি আর তোমার ফুপু হজ্বে যামু।
: একবার না হজ্ব করলা?
: আরে তোমার বড় কাকা, কাকী আর তার পোলা এই যে গত সপ্তাহে হজ্বে গেলো। তো যাওয়ার আগে নিয়ত করছে আগামী বছর আমাগো আবার হজ্বে পাঠাইবো।
: তার পোলা না সেদিন পয়দা হইলো। বয়স কত?
: ও তো কোরানে হাফেজ। বয়স ১২।
: ঐত্তেরী। শুনো, সামনের বছর আমি টাকা দিতাছি, আম্মারটা কইরা আসো।
: আইচ্ছা।
: কি আইচ্ছা?
: একটা কথা কমু?
: আর কি কইবা?
শুরু হলো ফুপিয়ে কাঁদা। আমি দেশে থাকতে বাবাকে কাঁদতে দেখিনি। কিন্তু মা অসুস্থ হবার পর এই এক বাতিক তার কান্না কাটি। এমন সময় আমি মোবাইলটা বন্ধ করে দেই। এই সময়টা আমার জন্য খুব খারাপ কাটে। সবসময় মনে পড়ে লম্বা চওড়া ৬ ফুটি একজন ফর্সা সুঠাম দেহী মানুষ যার মুখে একটা মিস্টি হাসি, সেই মানুষটা কিভাবে কাঁদে! মাত্র কয়েকবছরের ব্যাবধানে লম্বা সাদা দাড়ী দেখলে তারে এখন পুরাই সালমান এফ রহমান লাগে। তার কান্নার আওয়াজ শুনে এবার মোবাইলটা কাটলাম না। আম্মা কলটা ধরলে জিজ্ঞেস করলাম," সে কান্দে কেন?"
আম্মা ওপার থেকে আব্বাকে জিজ্ঞেস করলো,"তোমার পোলায় জিগায় তুমি কান্দো কেন?"
আব্বা জবাব দিলো এমনি। আম্মা সেটা আবার আমাকে শোনালো,"এমনি!"
: কুল।
: তুমি এখন ঘুমাইবা?
: ঘুমামু মানে? এখন ঘুমায় কেমনে? আমি কাজে?
: এত রাইত কইরা কি কাজ করো বাবা?
: ঐত্তেরী! এইখানে দিন।
: সকালে খাইছো?
: হ খাইছি।
: খাওয়ার আগে বিসমিল্লাহ বইলা খাইবা। খাওয়া শেষ হইলে শুকুরআলহামদুলিল্লাহ। নামাজ পড়?
: না।
: নামাজ বাদ দিও না। ঘরে ঢুকবা ডান পা দিয়া বাইর হইবা বাম পা দিয়া। ঘুমানোর আগে আয়াতুল কুরসী পড়বা।
: আইচ্ছা।
: ইসস! এই আয়াতুল কুরসী তোমারে কেমনে মুখস্থ করাইছিলাম। মনে আছে?
: আমি ফোন রাখলাম, কাম আছে।
ফোনটা রেখেই বসে রইলাম কিছুক্ষন। মনে আছে তখন হুজুর জানালো পরের দিন অবশ্যই যে আয়াতুল কুরসী মুখ্স্থ করে আসি। নাইলে কপালে শনি আছে। বাসায় এসে আম্মাকে বললাম আয়াতুল কুরসী কোথায় পাবো। আম্মা একটা আমপাড়া বের করে বললো, শুরু কর। ১ ঘন্টার মধ্যে মুখস্থ যেন পাই। প্রথমবার পুরোটা পড়ে মনে হলো কে যেনো মুখে খুব তেতো কিছু ঢেলে দিছে। এত কঠিন, এত প্যাচঘোেচের আরবী, কোনো মিল নাই। মিল থাকলে মুখস্থ কইরা আরাম। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ১ ঘন্টা পার হলো টের পাইনি। এমন সময় আম্মাজান হাজির। মুখস্থ ধরলে আল্লাহু লা হুয়াল যেয়েই গুলায় গেলো। ন গদে দিলো বন চটকানা। কানে ধরে বললো,"বইসা বইসা কি ধ্যান করলি?" এমন সময় দাদাজান দেখে বললো,"মাইরো না। একটু ধৈর্য্য ধরে পড়াও, দেখবা মুখস্থ হয়ে গেছে।" আম্মাজান আক্ষেপের সুরে বললো,"ওর ঘ্যান ঘ্যান শুইনা আমার মুখস্থ হইয়া গেছে কিন্তু ওর মুখস্থ হয় না। ওর মাথা যে কুন দিকে!" এটা বলে আরেকটা থাপ্পড়। ওদিকে মাঠ থেকে পোলাপানের খেলার শব্দ কানে আসতেছে। বুকটা ছিড়ে যাইতেছে কি যে মুখস্থ করতে বসলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা যায়, আম্মা বন চটকানা রেখে ইক্ষু দিয়া পিটায়, তাতে কাজ না হইলে ডাসা (ঘরের দরজার দুই কপাট ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ করার পরও এক্সট্রা সিকিউরিটির জন্য মোটা কাঠের একটা খিল পড়ানো হতো। ঐ মোটা কাঠকে ডাসা বলতাম)। অনেক কস্টে রাত ১০ টার দিকে মনে হইলো মুখস্থ হইছে। আম্মাকে গিয়ে বললাম, মুখস্থ হইছে।
: কালকা ক্লাসে পারবি তো?
: হ।
: এখন খাইতে বয়। সকালে ক্লাসে যাইয়া যেনো ভুল না হয়।
চিন্তা করলাম মুখস্থ ধরবো না আগে জানলে মেলা আগেই আমপাড়া রাইখা মাঠ থিকা একটা ঘুরান্তি দিয়া আসতাম। শিট! ভুল হইয়া গেছে। ওদিকে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সকালে বেলা ক্লাশে গেলাম। বসলাম একেবারে শেষ বেঞ্চের কোনার জায়গায়। যাতে হুজুরে না দেখে। মাথা গুজা করে রাখলাম। হুজুর ক্লাসে ঢুকলো, ঢুকেই একজনকে দাড়া করিয়ে জিজ্ঞেস করলো আয়াতুল কুরসী বলতে। সে তোতা পাখির মতো বলে দিলো। হুজুরের আবার নিয়ম ছিলো কোনো কিছু মুখ্স্থ করতে দিলে তার পরের দিন ৪-৫ জনকে জিজ্ঞেস করে। যখনই একেকজনকে দাড়া করায় আমি হাফ ছেড়ে বাচি। যখনই ৫ নম্বরের জন্য হুজুর চোখ বুলাচ্ছিলো হঠাৎ করেই পড়লো আমার ওপর।
"ঐ কুজা, কোনায় বইসা রইছোস, খাড়া, শুরু কর!"
আমি আমতা আমতা করতে করতে দাড়ালাম। শুরু করতে গিয়ে দেখি সূরা বাকারার প্রথম লাইন খালি মাথায় আসতেছে কিন্তু আয়াতুল কুরসীর কুনো খবর নাই। এদিকে শীতের সকালে পিঠ ভিজে ঘামে একাকার। হুজুর মতলব ভালো না আঁচ করতে পারলো। হাতে বেত নিয়ে দিলো একটা ঝাড়ি,"মুরগীর মতো ঝিম ধরছোস কেন? আয়াতুল কুরসী ক তাড়াতাড়ি!"
হুজুরের ঝাড়ি খেয়ে কি যে বললাম খেয়াল নাই। শেষ না হইতেই দেখি বেতের ৫ টা বাড়ী আমার পশ্চাদে আমেরিকার এফ ২২ বিমানের মতো গুলিবর্ষন করে আমারে ধ্বংস করে দিলো। ব্যাথা স হ্য করতে না পাইরা দিলাম কয়টা লাফ। লাফ দেইখা ক্লাশ ভর্তি পুলাপানের কি হাসি। ছুটির পর যখন বাসায় যাইতেছিলাম তখন ডেবিট আমার সাথে সাথে হাটতেছিলো,"কিরে তোর কাহিনী কি? আয়াতুল কুরসী জিগাইলো আর কইলি টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটিল স্টার। তোর মাথা কি ঠিক আছে?"
: আর কইস না। কালকা যে কতবার পড়ছি।
: কি কস সোজাই তো। আমার তো মুখস্থ।
: আরে আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল ......
কিছুক্ষন পর নিজেই লক্ষ করলাম পুরা আয়াতুল কুরসীটা মুখস্থ বলে ফেলেছি। ডেবিট বললো,"কিরে তুই তো পারস। ক্লাসে কি হইছিলো?"
আমি নিজেও জানি না ক্লাশে কি হইছিলো। আয়াতুল কুরসীর প্রতিটা শব্দ প্রতিটা লাইন যেনো আমার চোখের সামনে ভাসতেছিলো। তারপর থেকে এখনো পর্যন্ত আয়াতুল কুরসী এখনো ভুলি নাই। মাঝে মাঝে আমি যেনো নিজেকেই চিনতে পারি না। কিছু একটা হয় আমার, আগেও হতো। আমি আসলেই নিজেকে চিনতে পারি না।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১:২৯