somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি ময়ূরাক্ষী, একজন হিমু (চতুর্থ পর্ব)

২০ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৮:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি ধানমন্ডি ২৭ এ দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি। কাকভেজা হয়ে গেছি। মুটামুটি এক ঘণ্টার মত হল এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছি। আধা ঘণ্টা আগেও হাঁটু পানি ছিল। হঠাৎই পানি বেড়ে কোমড় পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে। অবাক করার মত বিষয় হল, এই পানি কোমড় পর্যন্ত উঠে যাবার পর আর বাড়ছে না। পানি না বাড়লেও বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। আজকে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কিছু মানুষ প্রথমদিকে বেশ আগ্রহ নিয়ে আমাকে দেখছিল। একজন দূর থেকে দুই একটা ছবিও তুলেছে। হয়ত ফেইসবুকে দেবে! এখন আর কেউ দেখছে না। আশেপাশে মানুষজন যা ছিল সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটাছুটি শুরু করে দিয়েছে। দোকানপাটের ভিতরেও পানি ঢুকে পড়েছে। সবচে বেহাল অবস্থা হয়েছে কাপড়ের দোকানগুলোর। একটা দোকানের ডিসপ্লেতে রাখা মেয়ে পুতুল ভেসে যেতে দেখলাম সামনে দিয়ে। বেচারা দোকানি করুণ চোখে তাকিয়ে আছে পুতুলের দিকে। আমার ধারণা মেয়ে পুতুল বলেই হয়ত তার আফসোসটা একটু বেশি। পুতুলটা একা যায়নি। সাথে করে গাড় নীল রঙের একটা শাড়িও নিয়ে যাচ্ছে!আমি বেশ কয়েক জায়গায় খেয়াল করেছি কিছু লোক আছে যারা দোকানের সামনে গিয়ে এই মেয়ে পুতুলগুলোর সামনে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকে। এইরকম একজনের সাথে কথা বলে দেখতে হবে। তার ওইসময়ের ভাবনাটা জানা দরকার।
সবচে মজার ব্যপার হল এই মুহূর্তে পুতুলটাকে দেখতে সত্যিকারের একটা মেয়ের মত লাগছে। আমি চোখের আড়াল হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকলাম ওটার দিকে। আমার কেন জানি মনে হল মেয়ে পুতুলটাও আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিল। জ্যোৎস্না বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে জেনেছি। হিমুর কাছ থেকেই জেনেছি। আমি এখনও সেই বিভ্রান্তিতে পড়িনি। এত তাড়াতাড়ি পড়বো বলে মনে হয় না। আমার হিমু হতে এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। আমার কেন জানি মনে হল এই হয়ত পুতুলটা ফিরে আসবে ভাসতে ভাসতে। এসে বলবে, আচ্ছা মানুষ তো আপনি হিমু সাহেব! একটা মেয়ে আপনার সামনে দিয়ে দিব্যি ভেসে গেল অথচ আপনি একটাবার তাকে বাঁচাতে চেষ্টাও করলেন না। আমি আরও অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। কিন্তু জিনিসটা আর এলো না। আচ্ছা! অতিরিক্ত বৃষ্টিও কি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে?
এই পানির মাঝে হেঁটে যাবার সাহস হচ্ছে না। হাঁটতে গেলে ভাল দেখে যে কোন একটা ম্যানহোলে পরে যাব নিশ্চিত। আমি এখনও ঢাকা শহরের রাস্তা ঘাটের সাথে সেভাবে পরিচিত হয়ে উঠি নাই। আমি কোমড় পানিতে দাঁড়িয়ে থেকে আবারও চারপাশে দেখতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই আমার সামনে দিয়ে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেল। আমিও বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। এইগুলোকে শুধু ঘটনা বলা ঠিক নয়। এইসব জিনিষের ভাল একটা নাম পাওয়া যায় আজকাল। এগুলোকে বলে বিচ্ছিন্ন ঘটনা! আমার সামনে দিয়ে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে গেল।
বিচ্ছিন্ন ঘটনা ১- যে ডামিটা আমার সামনে দিয়ে ভেসে গেল, সেটার পিছনে পিছনে ৮/৯ বছরের তিনজন ছেলেকে সাঁতরে যেতে দেখলাম। এর মধ্যে দুইজনের গায়ে কিছুই নেই। বাকি একজন শুধু একটা হাফপ্যান্ট পড়া। বুঝা গেল এরা টোকাই শ্রেণীর হবে। স্বাভাবিকভাবেই এদের উদ্দেশ্য ডামিটাকে হাসিল করা। তবে সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ডামিটার গতির চাইতে এদের গতি অনেক কম। তা সত্ত্বেও এরা আজ পুতুলটার পিছন পিছন ছুটবে। এদের কাছে এইটাই হয়তো বেশি আনন্দের।
বিচ্ছিন্ন ঘটনা ২- বৃষ্টি শুরু হয়েছে খানিকক্ষণ হল। এটুকু সময়ের মধ্যেই কয়েকটা নৌকা নেমে গেছে। অবাক করার মত বিষয় হল, এই নৌকাগুলোতে করে মানুষজন বেশ প্রফেশনালি যাতায়াত করছে। আমি বুঝতে পারলাম না, এগুলো কি আগে থেকেই আনিয়ে রাখা ছিল! এই চিন্তা শুরু করবার আগেই দেখলাম, একটা নৌকার পিছে পিছে একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট সাঁতরে যাচ্ছে। সাঁতরানোর সাথে সাথে উনি আবার হাতের লাঠি দিয়ে পানিতে বেশ ভয়ংকর ভঙ্গিতে আঘাত করছেন। “ঐ হারামজাদা খাড়া! খাড়া!” নৌকার চালক বেপারটাতে তেমন আগ্রহ না দেখিয়ে নিজের মত করে চলছে। মনে হয় এরকম ঘটনার সাথে সে আগে থেকেই পরিচিত। আমি ঢাকার রাস্তায় দুই একবার ট্রাফিক পুলিশকে দেখেছি রিকশা কিংবা ট্রাকের সাথে পাল্লা দিতে। জলযানের সাথে এহেন কাণ্ড দেখে আমি পুরাই তব্দা খেয়ে গেছি। তবে ভদ্রলোক যেভাবে সাঁতরাতে সাঁতরাতে পানিতে বাড়ি দিচ্ছেন, উনাকে এই লাইনে বেশ অভিজ্ঞ মনে হল।
বিচ্ছিন্ন ঘটনা ৩- একজন ভদ্রলোক আমার থেকে কিছু দূরে চোখ বড় বড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। আর একটু পর পর মোবাইল করে কাকে যেন ধমকাচ্ছেন। “শালার পুত! একটা প্যান্ট আনতে এতক্ষন লাগে?... না পাইলে লুঙ্গি নিয়ে আয়। লুঙ্গি না পাইলে বিছানার চাদর নিয়ে আয়। জলদি কর। পানি কমে যাবে একটু পর।” আমি বুঝতে পারলাম কোনভাবে এই ছোট্ট সুনামিতে উনি উনার নিচের অর্ধের পরনের কাপড় হারিয়েছেন। তাই পানি থেকে উঠার সাহস করতে পারছেন না। বাসায় কাউকে কাপড় আনার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন। পানি থেকে উঠলেও বিপদ আবার পানি কমে গেলেও বিপদ। উনার দাঁড়ায়ে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই। আমি একটু কাছে গিয়ে বেশ ভদ্রভাবে বললাম,
ভাই অবস্থা কি বেশি খারাপ?
বেশি খারাপ মানে? লোকটা একটা ধাক্কা খেল মনে হয়।
না মানে, ছোট প্যান্ট পরেন নাই?
ঐ শালার পুত, আমার দোকান নিয়া তর এত চিন্তা ক্যান? ভদ্রলোক মনে হয় “শালার পুত” ছাড়া কথা বলতে পারেন না।
ভাই আপনার কপালে আজ খারাবি আছে। মহাখালী থেকে এইখানে লুঙ্গি আসতে কমসে কম দুই ঘণ্টা লাগবে। আর এক ঘণ্টার মধ্যে এই পানি আপনার পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নেমে আসবে। এখন ভেবে দেখেন আপনার দোকানের ডিসপ্লে কি সবাইরে দেখাবেন, নাকি আমি কোন ব্যবস্থা করব?
আমার কাপড় মহাখালী থেকে আসতেছে আপনি ক্যাম্নে জানলেন? কে আপনি?
এক ঝটকায় তুই থেকে আপনিতে নেমে এসেছে লোকটা। আবার মনে হয় কাউকে ফোন দিল। এবার বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও সে কাউকে পেল না। বেচারার মুখ এবার একটু ছোট হয়ে গেছে। চেহারার মধ্যে একটা আতঙ্ক ভাব চলে এসেছে।কাঁচুমাচু মুখে আমাকে বলল, ব্রাদার বাঁচান। উজ্জ্বল শালার পুত একটা অকর্মা। অরে দিয়া মনে হয় হইত না। আমারে খুঁজতেই তো সন্ধ্যা লাগায়া ফেলবে।
বেচারা এক হাতে মোবাইল আর এক হাতে মানিব্যাগ ধরে আছে। আমি কিছু না বলে মানিব্যাগ থেকে দুটো একহাজার টাকার নোট বের করে নিলাম। এই দুটো নোট ই ছিল মানিব্যাগে। একটু দূরে একটা ছোটখাট দোকান থেকে টকটকে একটা হলুদ শাড়ি কিনে তার হাতে দিয়ে বললাম, এইটা পেঁচিয়ে চলে যান।
ব্রাদার, লুঙ্গি কিনে দিলেও তো পারতেন!
এইটা ভাবীর জন্য। ভাবীকে দিয়ে বলবেন, আমি একদিন উনার হাতের কালাভুনা খেতে আসব।
সত্যিই রিনা কালাভুনা প্রচণ্ড ভালো রান্না করে। আপনি কিভাবে জানলেন?
আমি কিছু না বলে সরে আসলাম। লোকটা আবার বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল। একসাথে কয়েকটা বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে আজ। কাটাতে সময় লাগতে পারে।
আমি কোমড় পানিতে দাঁড়িয়েই আবার বৃষ্টি দেখাতে মন দিলাম। তবে এই বৃষ্টি দেখাতে আলাদা কোন বিশেষত্ব নেই। জ্যোৎস্না দেখার যেমন নিয়ম আছে, বৃষ্টি দেখারও নিয়ম থাকতে হবে। এক হিমু জ্যোৎস্না দেখার নিয়ম করে গিয়েছে, আরেক হিমু বৃষ্টি দেখবার জন্য নিয়ম করবে। আজই হবে বৃষ্টি দেখার নিয়ম, এখনি হবে। কাপড়ের দোকানের লোকটা এখনও দেখলাম তাকিয়ে আছে। বেচারা হয়ত আমার মত আশায় আছে পুতুলটা আবার ফিরে আসবে। আমি বুঝতে পারলাম কাপড়টা বেশ দামী ছিল।
- “অনেক দামী ছিল ভাই?” আমি করুণ স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম।
এই লোকটা যথেষ্ট ভদ্র মনে হল। আমার প্রশ্ন শুনে সে দোকান থেকে নেমে আমার সাথে পানিতে এসে দাঁড়াল। এরপর মৃদু হাসতে হাসতে বলল, জি না ভাইয়া! কাপড় তেমন দামী না, আবার এক্কেবারে কমদামীও না। কিন্তু আমার দোকানের ডিসপ্লেতে আর কোন ডামি নেই।
আমি খেয়াল করে দেখলাম আসলেই উনার দোকানে আর কোন পুতুল নেই।
- দোকানটা দিয়েছি কয়েকমাস হল। ধীরে ধীরে শুরু করছিলাম ব্যবসাটা। এইটা প্রথম পুতুল ছিল। আমার ছোট মেয়েটা পছন্দ করে কিনিয়েছিল। সমস্যা নেই! আবারও কিনা যাবে।
- ভাই আপনার পুতুলের গল্প পরে শুনবো! আপনি আমাকে একটা কাগজ আর কলম দিন।
লোকটা আবারও বেশ শান্তশিষ্টভাবে দোকানের ভিতরে চলে গেল। আমি একনাগাড়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার কেন জানি মনে হল, এই মানুষটা নিজের ভিতর অনেক বড় একটা কষ্ট নিয়ে আছে।
খানিকক্ষণ পর লোকটা একটা ছোট্ট প্যাড আর পাঁচ টাকার গুডলাক কলম আমার সামনে এনে ধরল। আমি তার দিকে না তাকিয়েই লিখায় মন দিলাম। (চলবে )
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৮:১৯
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×