‘প্লিজ ছবি তুলবেন না। পত্রিকায় ছবি দেখলে কারখানার মালিক চাকরি নট করে দেবে।’ ছবি না তোলার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর জীবনের সবই বললেন বিউটি দাশ। সঙ্গে যোগ দিলেন রনি গুপ্ত—‘ভাই, এখানে জমিদারের দাপট বেশি। কবুতরের খুপড়ির মতো বাসা, জমিদার ভাড়া নেয় পাঁচ তারকা হোটেলের মতো। পানির কষ্টে বাঁচি না।’
‘দুপয়সা বাঁচাতে তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে কর্মস্থলে যাওয়া-আসা করি, মাস শেষে বাঁচানো টাকাগুলো গুণে দিতে হয় জমিদারদের।’—বলেন রোকেয়া খাতুন।
২৮ ও ২৯ এপ্রিল শ্রমিকপল্লি খ্যাত নগরের রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) ও আশপাশের এলাকায় গেলে পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকেরা তাঁদের দৈনন্দিন দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন।
হাতের ক্ষতস্থান দেখিয়ে পোশাক শ্রমিক বানু আকতার বলেন, ‘একদিন আধঘণ্টা দেরিতে কারখানায় গেলে ম্যানেজার আমাকে কেছি (কাঁচি) দিয়ে আঘাত করে।’
‘৪০ বর্গফুট আয়তনের একটি কক্ষে মাসে দুই হাজার ৪০০ টাকা ভাড়া দিয়ে আমরা ছয়জন থাকি’—বলেন দিলরুবা আকতার। ‘জমিদার সপ্তাহর একদিন পানি দেয়। অন্য সপ্তাহর পানি ড্রামে ভরে রাখি।’—বলেন ফারজানা রহমান। জানা যায়, শুধু ইপিজেড এলাকায় পোশাক ও অন্য কারখানার সংখ্যা ১৬২। এসব কারখানার বর্তমানে এক লাখ ৬৩ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এদের ৮০ শতাংশই নারী। দক্ষিণ হালিশহর ও উত্তর পতেঙ্গার কলসির দিঘির পাড়, নারিকেলতলা, আকমল আলী সড়ক, বন্দরটিলা হাসপাতালের পেছনে, ব্যারিস্টার সোলতান আহমদ কলেজ এলাকার বিভিন্ন কলোনি ও বাসাবাড়িতে এসব শ্রমিক বসবাস করেন। নারী শ্রমিকদের বেশির ভাগই নিম্নমানের ও ঝুঁকিপূর্ণ বাসা-বাড়িতে থাকেন। নারী শ্রমিকদের অভিযোগ, বাড়ির মালিকেরা ভাড়া বাড়ালেও পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসসংকট সমাধান করেন না। অন্যদিকে, কিছু কারখানায় শ্রমিকদের কর্মস্থলে যাতায়াতের জন্য নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা নেই। ফলে ঘরে-বাইরে প্রতিদিন নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
অভিযোগ রয়েছে, কারখানার মালিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঠুনকো কারণে শ্রমিকদের নির্যাতন করেন। কর্মস্থলে একদিন অনুপস্থিত থাকলে নির্ধারিত সময়ে বেতন দেন না।
সিমেন্ট ক্রসিং এলাকায় দেখা যায়, টিনশেড একটি বেড়ার ঘর হেলে পড়েছে। ছোট এ ঘরে কবুতরের খুপড়ির মতো কক্ষ বানানো হয়েছে ১২টি। প্রত্যেক কক্ষের আয়তন ৩০-৪০ বর্গফুট। একটি কক্ষেই থাকা-খাওয়া আর রান্না। আমেনা বেগমের (১৪) বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। দুই মাস আগে খালাতো বোন তসলিমার সঙ্গে সে চট্টগ্রাম আসে। বর্তমানে ইপিজেডের একটি পোশাক কারখানায় তিন হাজার ৩০০ টাকা বেতনে চাকরি করে। আমেনা বলে, ‘ছোট একটা কক্ষের মধ্যে আমি খালাতো বোন ও তাঁর স্বামী থাকি। জমিদার ভাড়া নেয় এক হাজার ৬০০ টাকা।’ এ ঘরের আরেকটি কক্ষে ভাড়া থাকেন পোশাক শ্রমিক রকিব মিয়া। তিনি বলেন, ‘এখানে ১২টি পরিবার থাকে। ঘরটি বেশ নড়বড়ে হয়ে গেছে। একদিকে হেলে পড়েছে।’ ছবি তোলার সময় তেড়ে আসেন জমিদার হোসনে আরা বেগম। বেশি ভাড়া নেওয়া প্রসঙ্গে হোসনে আরা বলেন, ‘সরকার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম দিন দিন বাড়াচ্ছে। তাই আমরাও ভাড়া বাড়াচ্ছি।’
বন্দরটিলা হাসপাতালের পেছনে রয়েছে বাহাদুর কলোনি। হারুনের বাড়ির (পাকা টিনশেড ঘর) ৫৬ বর্গফুট আয়তনের একটি কক্ষে ভাড়া থাকেন বিউটি, নাদিয়া, আফরোজা, বুলবুলিসহ আরও দুইজন শ্রমিক। ভাড়া দুই হাজার ৪০০ টাকা। ভাড়া নিয়ে বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকলেও পানিসংকট নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। এ বাড়িতে প্রায় ১৪-১৫টি পরিবার ভাড়ায় থাকেন।
নাজনিন বেগম বলেন, ‘কোনো মেহমান এলে তিন দিনের বেশি থাকতে পারেন না। জমিদার দেয়ালে সাইনবোর্ড লিখে দিয়েছেন।’ কলসির দীঘির পাড়ে দিলওয়ারা খাতুন বলেন, ‘অনেক সময় কারখানার মালিক ওভারটাইম দেন না। সরকার নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণ করার পর থেকে তাঁরা (কারখানার মালিক পক্ষ) আমাদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন করছেন।’ বিলকিছ বানু (৩০) সপরিবারে ভাড়া থাকেন নগরের দেওয়ানহাটে। তিনি বলেন, ‘আমি যে কারখানায় কাজ করি সেখানে গাড়ি আছে মাত্র ছয়টি। সকালে সমস্যা না হলেও সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার সময় একঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।’
দক্ষিণ হালিশহর, উত্তর পতেঙ্গা ও স্টিলমিল এলাকা ঘুরে শ্রমিকদের প্রায় একই দুর্দশার চিত্র দেখা গেছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) মহাব্যবস্থাপক এস এম আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইপিজেডের অভ্যন্তরে শ্রমিকদের কোনো অসন্তোষ নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্ট কারখানা মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়গুলো সমাধান করে দেওয়া হয়।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য আলাদা আবাসন তৈরির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’ ওভারটাইম না দেওয়া, দেরিতে কর্মস্থলে গেলে শ্রমিকদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




