somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নতুন শতাব্দীতে বাংলা সিনেমার হালচাল ৪

২৪ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ১১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্ব: Click This Link

বাংলাদেশের জনপ্রিয়ধারার ছবিগুলোর মধ্যে ষাটের দশক ছিল একই সঙ্গে নাগরিক রোমান্স (আবির্ভাব, ১৯৬৮) ও লোকজ ছবির (রূপবান, ১৯৬৫) দশক, সত্তরের দশক ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক (ওরা এগারো জন, ১৯৭২) এবং গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামো সংক্রান্ত ও জনজীবন চিত্রায়ণের (নয়নমনি, ১৯৭৬; মাটির ঘর, ১৯৭৯) দশক, আশির দশক ছিল ফ্যান্টাসি (সওদাগর, ১৯৮২) ও অ্যাকশন ছবির (নসীব, ১৯৮৪) দশক আর নব্বইয়ের দশক ছিল টিনএজ প্রেম (চাঁদনী, ১৯৯১) ও সহিংস (দাঙ্গা, ১৯৯২) ছবির দশক। বর্তমান দশকে নব্বই দশকের ধারাবাহিকতায়ই ছবি নির্মাণ হচ্ছে (মনের মাঝে তুমি, ২০০৪; ইতিহাস, ২০০২), তবে ভায়োলেন্স বেড়েছে মারাত্মকভাবে, যৌনতার বিকৃত উপস্থাপন চূড়ান্ত পর্নোগ্রাফিতে পৌঁছেছে।

যেহেতু জনপ্রিয়ধারার ছবিগুলো অনেকখানিই নায়ক-নায়িকাকে নির্ভর করে নির্মিত হয়, তাই বলা যায়: ষাটের দশক হলো রাজ্জাক-কবরীর, সত্তরের দশক হলো ফারুক-ববিতার, আশির দশক ওয়াসীম-অঞ্জুর, নব্বই দশক সালমান শাহ-শাবনূরের আর বর্তমান দশক হলো প্রয়াত মান্নার। তবে এই দশকের শেষের দিকে শাকিব খান সুপারস্টার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বর্তমান দশকে নায়িকা গৌন হয়ে পড়েছেন এবং নায়ক মান্না ভায়োলেন্সপূর্ণ ছবির আইকন-অভিনেতায় পরিণত হয়েছে। ভায়োলেন্সনির্ভর এইসব ছবির প্রবণতা শুরু হয় নব্বই দশকে নির্মিত কাজী হায়াতের দাঙ্গা ছবিটির মাধ্যমে। কাজী হায়াৎ নির্মিত দাঙ্গা (১৯৯২), ত্রাস (১৯৯২) কিংবা বর্তমান দশকের ইতিহাস (২০০২) নামের ছবিগুলোর খানিকটা পরিশীলিত রূপ থাকলেও, এই ধারার বাকি প্রায় সব ছবিই তার ছবিরই অপরিশীলিত অনুকরণ। বলাবাহুল্য রোমান্টিক কাহিনীনির্ভর কিছু ছবি পাশাপাশি নির্মিত হয়ে থাকে (মনের মাঝে তুমি, ২০০৩), কিন্তু সন্ত্রাসনির্ভর ছবিগুলোই শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্র-শিল্পের মূল ধারা। রোমান্টিক কাহিনীর ছবিগুলো কখনোই মান্না-অভিনীত ছবিগুলোকে ছাপিয়ে উঠতে পারে নি।

পটভূমি ও পদ্ধতি
আমাদের গবেষণা-টিম ২০০৩-২০০৪ সালে সারাদেশে পরিভ্রমণ করে যে-ছবিগুলো দেখেছে তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল -- ডেঞ্জার মিশন, ওরে বাবা, নয়ন ভরা জল, ঢাকাইয়া মাস্তান, ধ্বংস, বিদ্রোহী সালাউদ্দিন, রঙ্গীন চশমা, কালো হাত, পাপী সন্তান, বাঘের বাচ্চা, ঠেকাও বিচ্ছু, মহিলা হোস্টেল, সাবধান সন্ত্রাসী, জ্যান্ত লাশ, ব্যাচেলর, বাপ বেটার লড়াই, আঘাত পাল্টা আঘাত, ইমানদার মাস্তান, রংবাজ বাদশা, চেয়ারম্যান, গজব ও নয়া কসাই। এর মধ্য থেকে তিনটি ছবিকে বাছাই করে আধেয়-বিশ্লেষণভিত্তিক বর্তমান অধ্যায়টি দাঁড় করানো হয়েছে। ছবি তিনটি হলো এ আর রহমান পরিচালিত রঙ্গীন চশমা (২০০৪), এস এম সরকার পরিচালিত বাঘের বাচ্চা (২০০৪) এবং এফ আই মানিক পরিচালিত বিদ্রোহী সালাউদ্দিন (২০০৪)। ইতোমধ্যে এই তিনটি ছবির কাহিনীসংক্ষেপ ব্লগারদের অবহিত করা হয়েছে। আধেয় বিশ্লেষণে এই তিনটি ছবি ছাড়াও অন্যান্য ছবির অভিজ্ঞতাকেও প্রয়োজনে আলোচনায় সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। ছবিগুলো দেখা হয় অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিতে। প্রেক্ষাগৃহে বসে ছবি দেখার পাশাপাশি দর্শকদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। ছবি চলাকালীন ও ছবিশেষে তৎক্ষণাৎ লিখিত আধেয়-বিশ্লেষণ এই আলোচনার ভিত্তি। তার সমর্থনে নির্বাচিত ছবিগুলোর ভিসিডি বাজার থেকে সংগ্রহ করে বার বার প্লেয়ারে চালিয়ে বক্ষ্যমান নিবন্ধটিকে দাঁড় করানো হয়েছে।

প্রথম পাঠ
ছবিগুলো দেখে মনে হয়েছে এগুলোর কাহিনী খুব দুর্বল, পারম্পর্যহীন, অসংলগ্ন, কখনো কখনো একই ধাঁচের। এসব ছবির সম্ভবত কোনো লিখিত চিত্রনাট্য থাকে না, ন্যারেটিভে কোনো সঙ্গতি নেই, পরিচালনায় নেই কোনো দক্ষতার প্রমাণ। কারিগরী দিক থেকে ছবিগুলো সাংঘাতিক দুর্বল: অস্বচ্ছ প্রিন্ট, অস্পষ্ট শব্দ, দুর্বল সম্পাদনার পাশাপাশি নেই চলচ্চিত্রিক ভাষার ন্যূনতম ব্যবহার। ক্যামেরা কেবলই পাত্র-পাত্রীকে অনুসরণ করে, পারিপার্শিক ডিটেল কিংবা প্রতীকের ব্যবহার একেবারে অনুপস্থিত। মেলোড্রামাটিক হৈ-চৈ, চিৎকার-হুংকার, কান্নাকাটি সারা ছবি জুড়ে বিরাজ করে।

ছবিগুলোর প্রধান অবলম্বন যৌনতা ও সহিংসতা। যৌনতার নামে এসব ছবিতে যা দেখানো হয় তা স্রেফ পর্নোগ্রাফি। আর আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণ ও প্রতিশোধের নামে যে সহিংসতা দেখানো হয়ে থাকে তা পরিমাণে ও পারঙ্গমতায় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পর্নোগ্রাফির অংশটুকু বাদ দিলে এসব ছবিতে ভায়োলেন্স ছাড়া আর কিছুই থাকে না। পুরুষ ও নারী চরিত্রগুলোর নির্মাণ-কায়দাটি পুরুষ-প্রতীক ও নারী-প্রতিমা উভয়কেই নেতিবাচক পরিচয়ে তুলে ধরে: পুরুষ হলো সহিংস, তেজী, কামুক আর নারী হলো দুর্বল-অধস্তন, পুরুষের প্রেম-প্রত্যাশী ও পতিতা-পর্যায়ের।

চিত্রনাট্য নয়, ফর্মুলা
নির্বাচিত প্রতিটি ছবিতেই চিত্রনাট্যকারের নাম পাওয়া গেলেও, সুসংগঠিত কোনো চিত্রনাট্য এসব ছবিতে থাকে বলে মনে হয় না। কারণ সাত/আটটি গান, ১০/১১টি মারপিটের দৃশ্য, বিশাল ভিলেনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নায়ক -- এরকম একটি ফর্মুলায় ছবিগুলো বাঁধা। গানগুলোতে সেক্স মেশাতে হবে, মারপিটের দৃশ্যগুলোতে ভায়োলেন্সকে চূড়ান্ত কল্পনার স্তরে নিয়ে যেতে হবে, কাহিনীর লক্ষ্যতো এটুকুই। ভিলেনদের সন্ত্রাসী-গডফাদার হিসেবে চিত্রিত করা এবং তার বিরুদ্ধে জনদরদী প্রথম নায়ক কিংবা সৎ পুলিশ-অফিসার দ্বিতীয় নায়ক -- এইতো বাংলা ছবির প্রধান চরিত্র। নায়কের সহিংস হয়ে ওঠার পেছনের কারণ হিসেবে ছোটবেলায় বাবার হত্যাকাণ্ড, মায়ের ধর্ষণ কিংবা পরিণত বয়সে বোনের ধর্ষণকে দেখানো -- ফ্ল্যাশব্যাকে সঙ্গে দু-এক চিমটি মুক্তিযুদ্ধ দেখিয়ে দেয়া -- এই কাহিনীর মধ্যেই প্রায় সব ছবি ঘুরপাক খায়। একসময় ধনীর দুলালী নায়িকা ও নিম্নমধ্যবিত্ত নায়ক, গ্রামীন তরুণ-তরুণীর প্রেম বনাম কুচক্রী-কামুক মোড়ল, রাজকুমার আর বেদেনীর প্রেম ও তদ্উদ্ভূত সঙ্কট ইত্যাদি নানা ধরনের ফর্মুলা প্রচলিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে দেশপ্রেমিক যুবার সঙ্গে সন্ত্রাসী-গডফাদারদের দ্বন্দ্ব -- এই একটিমাত্র ফর্মুলায় ছবিগুলো চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ভালো চিত্রনাট্য না-থাকায় ও ফর্মুলায় বৈচিত্র্য না-থাকায় পরিচালক-প্রযোজকরা সহিংস দৃশ্যগুলো কীভাবে আরও বীভৎস করা যায়, যৌনতার বিষয়টিকে আরও কীভাবে বাড়িয়ে তোলা যায় -- সেদিকে মনোযোগ দিয়েছেন।

চলবে ...

চিত্র: 'বাঘের বাচ্চা' ছবিতে মান্নার বিক্রম।

নোট: গীতি আরা নাসরীন ও ফাহমিদুল হকের 'বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প: সঙ্কটে জনসংস্কৃতি' শীর্ষক বইতে (শ্রাবণ, ২০০৮) এই আধেয় বিশ্লেষণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×