আগের পর্ব: Click This Link
সঙ্গতি ও অসঙ্গতি
এককথায় বলা যায় বাংলা সিনেমায় সঙ্গতির চেয়ে অসঙ্গতিই যেন বেশি। এর কাহিনী সমাজবাস্তবতা থেকে যোজন দূরে অবস্থান করে। চলচ্চিত্র একটি সৃজনশীল মাধ্যম। সুতরাং এটি কল্পনাশ্রয়ী হতেই পারে। তবে, কথা হলো এই স্বপ্নালোক শেষ পর্যন্ত কোন দিকে দর্শককে নিয়ে যায় তা বোঝা দায়। উদাহরণ দিয়ে বলি, বেশ কয়েকজন মন্দ লোকের বিরুদ্ধে একা এক নায়ক যুদ্ধ করে যাচ্ছে -- বেশিরভাগ ছবির কাহিনী এই সরলরৈখিক ন্যারেটিভের ওপরে নির্ভর করে। এটা ঠিক সমাজে কিছু মন্দ লোক রয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে সমাজেরই কিছু লোক প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু, ভয়ঙ্কর ধরনের রক্তবিলাসী মারামারি করার ক্ষমতাবিশিষ্ট না হলে প্রতিবাদ করা যাবে না, এই ধারনা মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর সংগ্রামকে এক কল্পনাবিলাসী অবস্থানে নিয়ে যায়। নায়কের মতো বিশাল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একা দাঁড়ানো সম্ভব নয়। সুতরাং পর্দায় নায়কের জয়ে দশর্কের জমে থাকা ক্রোধের সাময়িক অবসান ঘটলেও ঘটতে পারে। তবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে দর্শকের উৎসাহ যোগায় না।
ছবিগুলোর ইতিহাসজ্ঞান সামান্যই মনে হয়। তাই এযুগেও ব্রিটিশ আমলের খানবাহাদুরদের দেখা যায়। (বিদ্রোহী সালাউদ্দিন) বর্তমান সময়ের সাধারণ জ্ঞানেও ঘাটতি রয়েছে এসব ছবির। বাঘের বাচ্চা ছবিতে বলা হয়েছে সরকারী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে গেলে মন্ত্রী-সচিব ধরতে হয়, যা মোটেও ঠিক নয়। এক দু’জন এভাবে ভর্তি হলেও হতে পারে, কিন্তু এর সাধারণীকরণ করার অর্থ হলো প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি-পরীক্ষাকে মূল্যহীন করে তোলা।
ঢাকাই ছবিতে সাপের গুরুত্ব সাংঘাতিক। ফ্যান্টাসি-পোশাকি-সামাজিক সব ছবিতেই সাপের দেখা মেলে। এমনকি সাপেদের জীবন নিয়ে প্রচুর ছবি নির্মিত হয়েছে (নাগ নাগিনী, নাগিনী কন্যা, শীষনাগ প্রভৃতি ছবির নাম স্মর্তব্য), সেসব ছবিতে নাগিনী কন্যার সঙ্গে রাজপুত্রের প্রেমের ঘটনা দেখানো রীতিমতো স্বাভাবিক টেক্সটে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে যে ছবিতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে প্রবল ক্ষমতাধর চশমা আবিষ্কৃত হচ্ছে সেই একই ছবিতে সর্পরূপী মানুষ বা মনুষ্যরূপী সর্পকে আমরা দেখছি। (রঙ্গীন চশমা) সিনেমায় সাপের এই প্রবল উপস্থিতি কেন, কেন অন্যান্য সরীসৃপ যেমন কুমীর কিংবা কেঁচোকে দেখা যায় না, তা নিয়ে মনোঃসমীক্ষণভিত্তিক আলাদা গবেষণা হতে পারে। বাংলাদেশী সিনে-ইন্ডাস্ট্রি কী কারণে ভারতীয় পুরাণ কিংবা মনসামঙ্গল-এর লিগ্যাসি বহন করে চলেছে, তাও বিরাট প্রশ্ন, যার সমাধান হওয়া জরুরি।
সিনেমার প্রতিটি গানই বিরাট অসঙ্গতির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। এমনিতে সিনেমায় গানের ব্যবহারই একটি খাপছাড়া বিষয়। প্রেমিক-প্রেমিকার মনে ভাবের উদয় হলেই যে তারা সমুদ্রতটে গিয়ে নাচতে ও গাইতে থাকে, এমন নয়। কিন্তু কাদামাটিতে গড়া কোমল মনের অধিকারী উপমহাদেশীয় দর্শক সিনেমায় গানের উপস্থিতি অনিবার্য বলে ধরে নিয়েছে। তবে যেহেতু সা¤প্রতিক বাংলা ছবিতে গানগুলো ব্যবহৃত হয় সেক্স-ক্যাপসুল হিসেবে তাই গানগুলো ছবির সঙ্গতির সঙ্গে একেবারেই বেমানান হয়ে থাকে। ধরা যাক একটি পর্নোগ্রাফিক গান, সেটা শুরু করার সূত্র সাধারণত এরকম হয়ে থাকে: অসৎ পুলিশ অফিসারের যোগসাজসে হয়তো নায়ককে হাজতে পোরা হয়েছে, ভিলেনকূল মাতোয়ারা হয়ে তাই ঘোষণা দিলো, “আজ তবে একটু ফুর্তি করা যাক”। এই ফুর্তির দৃশ্যায়ন হিসেবে হয়তো একটি কাটপিস জুড়ে দেয়া হলো। (বিদ্রোহী সালাউদ্দিন)
সেট নির্মাণের ক্ষেত্রে সিনেমাগুলোতে খুবই দুর্বলতার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রায় প্রতিটি ছবিতেই সাধারণত ভিলেনের বা নায়কের আস্তানার একটি সেট ফেলা হয় যা সাধারণত বিশাল এক ড্রয়িংরুমের মতো হয়ে থাকে। (বিদ্রোহী সালাউদ্দিন, রঙ্গীন চশমা) ড্রয়িংরুমের মাঝ থেকে একটি সিঁড়ি হয়তো দোতলায় উঠে গেছে। এই ড্রয়িংরুমের সেটে প্রায়ই গোলাগুলি বা মারামারির দৃশ্য দেখা যায়। দেখা যাবে দোতলার সিঁড়িতে কেউ আহত হয়ে গড়াচ্ছে। তার সামান্য পায়ের ধাক্কায় সিঁড়ির রেলিঙগুলো নড়তে থাকে। কিংবা এমন অস্ত্র ব্যবহার করা হয় যা কেবল দেখতে বিশাল বা নিকষ কালো, কিন্তু এর ফিনিশিং দেখে অনুমান করা যায় কাঠ কেটে আলকাতরা মেরে অস্ত্র তৈরি করা হয়েছে।
চলবে ...
দ্রষ্টব্য: গীতি আরা নাসরীন ও ফাহমিদুল হক প্রণীত 'বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প: সঙ্কটে জনসংস্কৃতি' (শ্রাবণ, ২০০৮) গ্রন্থে এই ধারাবাহিকটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ৮:১৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




