ড. মোহাম্মদ আমীন সম্পাদিত
জাগৃতি প্রকাশনী, মূল্য: ছয় শ টাকা
আর দশটা বইয়ের সঙ্গে এই বইকে মেলানো যাবে না। কারণ, এ ধরনের বইয়ের সহজে দেখা পাওয়া যায় না। বইটির নাম সময়ের পরশপাথর। ড. মোহাম্মদ আমীন সম্পাদিত। এটি একটি স্মারকগ্রন্থ। সাধারণত মৃত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এ ধরনের গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করা হয়। এদিক থেকেও বইটি ব্যতিক্রম।
স্মারকগ্রন্থটি যাকে নিয়ে, ‘তিনি রাজনীতিক, এমপি এবং মন্ত্রী। বিত্ত ও চিত্তে আকাশের মতো উদার। খ্যাতিমান প্রাবন্ধিক, বিচক্ষণ বিশ্লেষক। বংশে বড়, কর্মে পরিচ্ছন্ন। চৌকস কাজে, বিনয়ী ব্যবহারে। দর্শনে স্বচ্ছ।’ (পৃষ্ঠা. ৯৪)
এ রকম একজন ব্যক্তিত্ব নিয়ে যে বই, তা নিয়ে আলোচনা করা সহজ নয়। ‘হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক, আজকে এমনই একজনকে নিয়ে ভাবছি, যাঁকে ব্যক্ত করার ভাষা, চিন্তা-চেতনা সত্যিই আমার খুব দুর্বল এবং আমার সাহস হচ্ছে না, না জানি আমার বর্ণনায় এত বড় এবং মহৎ ব্যক্তিত্বের কোনো অমর্যাদা হয়ে যায়।’ (পৃষ্ঠা ৪৩৬, লেখক অধ্যক্ষ মো. জসিম উদ্দিন, অধ্যক্ষ, ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি অ্যান্ড কলেজ, কালকিনি, মাদারীপুর)
এবার ব্যক্তিটির পরিচয় বলা প্রয়োজন। বই থেকেই ধার করে বলা যায়, ‘কিছুটা দ্বিধা আর দোদুল্যমানতা। কারণ, যে ক্ষণজন্মা ব্যক্তির প্রভা ও বৈভব এবং হূদয়ের ঐশ্বর্য আলোকপাতের জন্য লেখনীর এই ক্ষুদ্র প্রয়াস, তাঁর সূচনা করব কীভাবে? অঙ্কুরোদ্গম হতে বিশাল মহিরুহে রূপান্তরিত এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিটি হলেন সৈয়দ আবুল হোসেন।’ (পৃষ্ঠা. ২৯৭, লেখক মোহাম্মদ মোস্তফা, যুগ্ম সচিব)
জীবিত একজন ব্যক্তিকে নিয়ে কেন এই স্মারকগ্রন্থ? ভূমিকায় এর একটি কৈফিয়ত দিয়েছেন বইটির সম্পাদক। তিনি লিখেছেন, ‘দেশে অনেকের স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে; তাঁদের কয়জনই বা সার্বিক বিবেচনা ও চূড়ান্ত বিশ্লেষণে সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো চিত্ত, বিত্ত ও মননশীলতায় তাঁর কাছাকাছি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, সে বিষয়ে আমার ভালো ধারণা আছে। যেসব গুণ মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক, তার সব গুণ সৈয়দ আবুল হোসেনে বর্তমান।’
বইটিতে চারটি অধ্যায় রয়েছে। অধ্যায়গুলো হলো সৈয়দ আবুল হোসেন: জীবন ও কর্ম, সময়ের পরশপাথর, সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিবেদিত কবিতাগুচ্ছ এবং সর্বশেষ অধ্যায়টির শিরোনাম সৈয়দ আবুল হোসেনের কলম থেকে।
প্রথম অধ্যায়ের নির্দিষ্ট কোনো লেখক নেই। বরং সংকলন বলা যায়। এই অধ্যায়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবন ও কর্ম নিয়ে বিস্তারিত রয়েছে। শুরু জন্মস্থান ও পূর্বপুরুষদের বৃত্তান্ত দিয়ে। এরপর শিক্ষা ও কর্মজীবনের বিস্তারিত বিবরণ। এখান থেকে কিছু কথা তুলে দিলে পাঠকেরা সৈয়দ আবুল হোসেন সম্বন্ধে একটি ভালো ধারণা পাবেন।
যেমন অধ্যাপক মনোরঞ্জন দাস বলেছেন, ‘সৌম্যকান্ত চেহারা, অনেকটা আমাদের সুদর্শন দেবতা কার্তিকের মতো। গোলাকার মুখে হাসি পুরো লেপ্টে। চোখে নিষ্পাপ যোজনায় সারল্যের মুখরতা’। (পৃষ্ঠা. ৭৭)
শেখ হাসিনা উইমেন্স কলেজ অ্যান্ড একাডেমির বাবুর্চি লুৎফর রহমান হাওলাদার। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল: সৈয়দ আবুল হোসেন কেমন মানুষ? আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন মানুষ নয়, ফেরেশতা।’ (পৃষ্ঠা. ৯৫)
আবার খুলনা নিবাসী শেখ হাসিনা উইমেন্স কলেজ অ্যান্ড একাডেমির পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক শিবপদ মণ্ডলের মতে, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন একজন আদর্শ মানুষ। তাঁর চরিত্রে যে গুণাবলি রয়েছে তার সহস্রাংশও কারও মধ্যে প্রকাশ পেলে তিনিও মহামানব হয়ে উঠতে পারেন।’ (পৃষ্ঠা. ৯৬)
এনায়েতনগর ইউনিয়নের মাঝেরকান্দির মনির হোসেন একজন সাধারণ লোক। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো: আপনি সৈয়দ আবুল হোসেনকে চেনেন? আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘ওই দেখুন আকাশ। ওটাকে চেনেন? তিনি আমাদের জীবনের আকাশ, আমাদের বাতাস। তাঁকে ছাড়া আমরা কিছু বুঝি না।’ (পৃষ্ঠা. ৯৭)
একই প্রশ্ন করা হলে মীরা বাড়ির আনিসুর রহমান বললেন, ‘তিনি এত ভালো যে কেন ভালো লাগে বলতে পারব না। তিনি আমাদের চামড়ার মতো, আমাদের মাংসের মতো, আমাদের রক্তের মতো, চোখের মতো।’ (পৃষ্ঠা. ৯৬)
বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য এই অধ্যায়ের তিনটি অংশ আছে। এর মধ্যে একটি হলো, ‘সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনের মহামানবীয় কয়েকটি ঘটনা।’ সাধারণত মহামানবদের জীবনীতে যে ধরনের ঘটনার বর্ণনা আমরা পাই, এই অংশেও তেমনটি পাওয়া যায়।
পরের অংশের শিরোনাম ‘সৈয়দ আবুল হোসেন: তেজময় সিংহপুরুষ’। এরশাদ আমলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কলেজকে এমপিওভুক্ত না করার জন্য সে সময়ের শিক্ষামন্ত্রীকে তিনি বদলে ফেলেছিলেন। সেই ঘটনার বর্ণনা আছে এই অংশে।
আর শেষ অংশটির শিরোনাম হলো, ‘আলাপচারিতায় দার্শনিক নান্দনিকতা’। সৈয়দ আবুল হোসেনের বিভিন্ন সময়ের বলা কথার সংকলন। তিনি যে একজন দার্শনিক, তার অনেক চিত্র পাওয়া যাবে এই অংশে।
গ্রন্থটির দ্বিতীয় অধ্যায় মূলত সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের লেখা। তালিকাটি বেশ দীর্ঘ। লেখাগুলোও দুই ধরনের। যেমন সৈয়দ আবুল হোসেনের লেখা বিভিন্ন বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন বেগম সুফিয়া কামালসহ অনেকেই। সেসব যেমন সংকলিত করা হয়েছে, তেমনি সম্পাদকের অনুরোধেও অনেকে লিখেছেন। এই তালিকায় সদ্য প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও আছেন। সচিবরা লিখেছেন, রাজনীতিবিদেরাও লিখেছেন। তালিকায় তাঁর সহপাঠী এমনকি শিক্ষকেরাও আছেন।
বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে কয়েকটি শিরোনাম বলা যায়।
যেমন: রাজনীতিক আতাউর রহমান কায়সারের লেখাটির শিরোনাম ‘সুশোভিত সুমন’, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা ‘একজন স্বয়ংসিদ্ধ মানুষ সম্পর্কে’, সাবেক সচিব এম মতিউর রহমানের লেখার শিরোনাম ‘সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা’, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী লিখেছেন ‘বন্ধু আমার উদার নিদাঘ আকাশ’, রাজনীতিক মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ লিখেছেন ‘মহাঋত্বিক’, সরকারি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোস্তফার লেখার শিরোনাম ‘সতত বিভাময়’, আরেক সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ফরহাদ রহমান লিখেছেন ‘ম্যাগনেটিক ব্যক্তিত্ব,’ প্রকাশক ওসমান গনি বলেছেন, ‘মহান এক মানব’, অধ্যাপক নির্মল চন্দ্র পাল তাঁকে নিয়ে লিখেছেন, ‘মননশীল ভাষা বিজ্ঞানী’ ইত্যাদি।
এই অধ্যায়ে রয়েছে এস এম আবীর চৌধুরী মীমের লেখা ‘সৈয়দ আবুল হোসেনের বাণী’। মূলত বিভিন্ন লেখা ও বক্তব্য থেকে সংগৃহীত বাণীর একটি সংকলন। এর মধ্যে দুটি বাণীর কথা বলা যায়। যেমন ‘ওড়ার জন্য দুটি ডানার ওপর ভর করতে হয়। এক ডানায় ওড়া যায় না।’ ‘যোগাযোগের রথ বেয়ে আদিম মানুষ সভ্যতার জগতে উৎসারিত হয়েছে।’
লেখক তালিকার একটি নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি হচ্ছেন ডা. হাসমত আলী। পরিচয় অংশে লেখা আছে তিনি যানজটের দিন সৈয়দ আবুল হোসেনের হেঁটে যাওয়ার একজন প্রত্যক্ষদর্শী।
এই অধ্যায়ের সব লেখার সারাংশ পাওয়া যাবে সৈয়দ আবুল হোসেনের বন্ধু আবদুল কাদেরের লেখাটির শেষ বাক্যে। তিনি বলেছেন, ‘এ দীর্ঘ সময়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনে সামান্য খুঁতও খুঁজে পাইনি। ভেবে পাই না, তিনি মানুষ না দেবতা, নাকি তারও বড়!’
সবশেষে সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিয়ে লেখা একটি কবিতার একটি ছোট অংশ।
‘যে মানুষ স্বপ্ন গেঁথে গেঁথে
সেলাই করছে আজ পদ্মাপারের দরিদ্র মানুষদের বিচ্ছিন্ন জীবন:
ট্রয়ের সৈনিক তিনি, সময়ের সফল সন্তান। বুঝলে হেলেন!
বাড়িতে যে-অতিথি এলেন। লোকে তাঁকে জানে:
এক ক্লান্তিহীন স্বপ্নজয়ী আবুল হোসেন,
যদিও সৈয়দ তিনি, চাষার বাড়িতে এসে পিঁড়িতে বসেন।’
(এক স্বপ্নজয়ী মানুষের জন্য—আসাদ মান্নান, পৃষ্ঠা. ৫৪২)
তবে বইয়ের ছোট্ট দুটি ত্রুটির কথা বলা যায়। যেমন তিনি যখন প্রতিমন্ত্রী তখন সচিব ছিলেন হাসনাত আবদুল হাই। তিনি লিখেছেন, সারা দিন মন্ত্রণালয়ের কাজ করে সৈয়দ আবুল হোসেন চলে যেতেন তাঁর ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সাঁকোর অফিসে। আমরা জানি যে মন্ত্রী হিসেবে তিনি এটা করতে পারেন না।
আরেকটি ঠিক ত্রুটি নয়, বলা যায় অভাব। যেমন সৈয়দ আবুল হোসেনের সব সময়ের সঙ্গীদের কথা বইটিতে আছে। কিন্তু টিসিবিতে চাকরিকালীন কোনো সহকর্মীর কোনো স্মৃতিচারণা এখানে নেই।
সবশেষে বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১১:৫৬