somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুরনন

২০ শে মার্চ, ২০১৮ সকাল ১১:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ব্রাজিল-বেলজিয়ামের খেলা চলছে। আমার ক্লাশ থ্রিতে পড়ুয়া ছেলে গোঁ ধরে বসে আছে, খেলা দেখবে। শেষ মেশ ধমক দিয়েই তার মা তাকে ঘুমাতে পাঠালো। তখন ১২:৩০টা বাজে। আর ১৫ মিনিট থাকলেই হাফ-টাইম হবে এটা সে জানে। কিন্তু শাসনের কাছে হার মানলো। গল্পটা এতটুকুই ছিল। ডালপালা গজালো পরদিন। একটা ব্যাপার মনের মাঝে খচ খচ করছে, আমার ছেলে খেলাধুলার বিষয়ে এত জানে কিভাবে? সে মেসির গল্প জানে, চেহারা চেনে। রোনালদোর বিষয়ে জানে, চেহারা চেনে। ক্রিকেটতো তার নিজেরই পছন্দের খেলা, সব টিমের সবার নাম জানে, রেকর্ড টেকর্ডতো তার কাছে খুবই আকর্ষনীয় বিষয়...কিন্তু কিভাবে?

নিজের কথা মনে পড়লো হঠাৎ করেই। ১৯৮২ সালে আমি ঠিক অতটুকুই ছিলাম। ওয়ার্ল্ডকাপও নিয়ম করেই চলছিল। হাউকাউ শুনে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে ড্রয়িং রুমে চোখ কচলাতে কচলাতে চলে আসলাম। বাবা উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলে উঠলো, 'এদিকে আয়, বস!' মা কিন্তু এ যুগের মায়ের মতন করলেন না। বাবা বললেন, 'দ্যাখ এই হলো সাদা পেলে। ওর নাম 'জিকো'!' আমি মাথা চুলকে মায়ের কোলে শুয়ে পড়ে খেলা দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন স্কুলে যেয়ে দেখি স্যারেরা সবাই মিষ্টি খাওয়া খাওয়ি করছেন। অনুসন্ধানে জানতে পারলাম বিশ্বকাপের গতকালের খেলায় তারা জিতেছেন। অর্থাৎ একদল আরেকদলকে নিমকি খাওয়াচ্ছেন, যাদের সবাই ব্রাজিল সমর্থক! দারূনতো!

এই স্মৃতিটা মনে পড়ার সাথে সাথেই হুড়মুড় করে আরও সব স্মৃতি একের পর এক ঘাই মারতে থাকলো মনের মাঝে। সেই সময় মনুষ্য সমাজে ব্যয়বহুল মনোরঞ্জন ছিল টিভি! বুঝতে হবে এভাবে, 'ঘরের ভিতরেই সিনেমাহল'! আমার এখনও মনে আছে আমাদের বাসায় টিভি আসে ৮০'র দশক শুরু হবার আগেই। একটা PHILIPS সাদাকালো টিভি। ভাল্ব সিস্টেম, টিভি অন করলে সবার আগে এ্যান্টেনা ধরে নাড়া দিতে হতো। ছবি আসতে সময় লাগতো আরো বেশি। টিভির পেট ছিল ইয়া মোটা। সেই টিভিতেই দেখা হত আগা খান গোল্ড কাপ কিংবা আবাহনী বনাম মোহামেডানের খেলা। একবার মনে আছে টিভিতে রেসলিং দেখানো হবে। সবাই দৈনিক ইত্তেফাকের পাতায় চোখ বুলাচ্ছেন আর সাধু ভাষায় (তখন পত্রিকা সাধু ভাষায় লিখা থাকতো) ঘিরে ধরা মানুষদের অনর্গল শুনিয়ে যাচ্ছেন রেসলাদের বর্ননা। এর মধ্যে একজনের নাম মনে গেঁথে যায়। নাম ছিল Mighty Mongol! আমার নানু গ্রামের মানুষ, ঊনি বলতেন, 'মাইটা মুঙ্গল'! শুধু তাই না, রবিবার সাপ্তাহিক বন্ধ ছিল বিধায় টেলিভিশনের প্রোগ্রাম শুরু হত সকাল ৯টায়। দেশের বাইরে অনুষ্ঠিতব্য যে কোন খেলাধুলা সরাসরি উপভোগ করতে হত বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের কল্যানে! যখন স্কুলে পড়তাম তখন বড়দের ঝগড়া দেখতাম আবাহনী আর মোহামেডান নিয়ে। সেসব সংক্রমিত হত আমাদের ছোটদের মাঝেও! ছড়াও শিখেছিলাম প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য-

ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা
বোয়াল মাছের দাড়ি
আবাহনী ভিক্ষা করে
মোহামেডানের বাড়ি।।

মামা, চাচা, বাবা কারো না কারো হাত ধরে স্টেডিয়ামে যেতে চাইতাম শুধুমাত্র আবাহনী-মোহামেডানের খেলা দেখবে বলে। মা নিষেধ করতো। কারণ তাঁর শংকা ছিল স্টেডিয়ামে সমর্থক সমর্থকদের ঝগড়া কুৎসিত পর্যায়ে চলে গেলে মারামারি বেঁধে যেতে পারে। কিন্তু হতো না তেমন। সবাই ভুলে যেত এবং পরবর্তী ম্যাচের জন্য প্রস্তুত থাকতে আগাম শাসিয়ে রাখতো! কায়সার হামিদ, সালাউদ্দিন, চিমা ওকেরি (বিদেশী) ইত্যাকার নাম জ্বল জ্বল করত। ডানা কিংবা গথিয়া কাপের সাফল্য শোনার পর রাত জেগে টিভি রিপ্লে দেখেছে সবাই আর মনে মনে বিশ্বকাপের অংশীদার হবে মর্মে সোনালী স্বপ্নে বিভোর থেকেছে পাড়া প্রতিবেশী।

বেলা গড়িয়ে, '৮২ পেরিয়ে '৮৬ চলে আসলো। নিজেই কত খেলা খেলতে পারি। বল নিয়ে দৌড়াই, ব্যাট হাতে রান করি কিংবা পাড়ার ব্যাডমিন্টন টুর্নােমেন্টে নাম লিখিয়ে ১০০ টাকা দামের প্রাইজবন্ড নিয়ে রাতের ঘুম হারাম করতে থাকি আর ভাবতে থাকি ফাইনাল পরীক্ষাটা না থাকলে কি আনন্দই না হতো! কত শত খেলার মাঠ ছিল তখন। টিন এজ। দৌড়াতাম আর বুক ভরে নির্মল বাতাস টানতাম ফুসফুস বোঝাই করে। আপনারা আজ যেখানে বড় বড় স্থাপনা দেখছেন, বিল্ডিং দেখছেন কিংবা সুবিশাল সুপার মার্কেট দেখছেন, সেগুলোই একসময় আমাদের খেলার মাঠ ছিল! বিভিন্ন পাড়ার নিমন্ত্রণে প্রীতি ম্যাচও খেলতাম এইসব স্থানেই। বল নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে যেয়ে ব্যাথা পেতাম, তখন হাত বাড়িয়েই দূর্বা ঘাস নিয়ে ডলে নিতাম আক্রান্ত স্থানে। ব্যস, সব ঠিক। খেলায় নামার আগে মাঠে একটা চক্কর দিতাম। পায়ে বল আসলেই জোরে লাথি। বলের গায়ে ঘাসের সবুজ ছোপ লেগে যেত। মাড়ানো, থ্যাৎলানো ঘাসের কি যে অদ্ভুত ঘ্রান ছিল তা শুধু যারা সবুজ ঘাসের মাঠে খেলেছে তারাই বলতে পারবে। বিকেলে মাঠে গিয়ে সেই ঘ্রান পাবার সাথে সাথেই চনমন করে উঠতো মন, ক্লান্তি নিমেষে উধাও! পৃথিবীতে সবচেয়ে আনন্দের সময় সম্ভবত বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলা! আমি বাজিও লাগতে পারি এবং এতে সবার সমর্থন পাবো তাও জানি।

এই '৮৬ সালেই গুজ গুজ ফুস ফুস শুরু হলে একটা বিশেষ বিষয় নিয়ে। তা হলো বিশ্বকাপ। অনুষ্ঠিত হবে মেক্সিকোতে। আমি খেলা বুঝি তা বলবো না। কিন্তু খেলতে তো পারি। তাই যথেষ্ঠ। পাড়ার সবাই মিলে গলাগলি করতে করতে পরিকল্পনা করতে থাকি কিভাবে খেলাটা দেখা যায়। না, তখন প্রজেক্টর ছিল না। বাবা-মা রাত জাগতে দেবেন কি না সেই টেনশনেই অস্থির। কারণ স্কুল তো আর মাফ নেই। সেই সময় একটা অদ্ভুত সমস্যা তৈরী হল। কাউকে কিছু জানান না দিয়ে বার্ধক্যজনিত কারণে আমাদের একমাত্র PHILIPS টিভিটি কোমায় চলে গেল। বাবার জেদ চেপে গেল। খেলা দেখবেন কিন্তু রঙিন টিভিতে দেখবেন। তখন পুরোনো টিভি বদলে অল্প কিছু দাম দিয়ে নতুন টিভি পাওয়া যেত। অন্তত বাবা সেই রকম একটা নেটওয়ার্কের খোঁজও পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পুরোনো টিভির দাম এতই কম উঠেছে যে তাতে জমানো টাকা মিলিয়ে নতুন টিভি আর হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেদ আর শখ দুটোই কাজে লাগলো। নতুন টিভি আসলো ঘরে।

টুর্নামেন্ট শুরু হতেই জল্পনা কল্পনা শুরু হলো। আমাদের, অর্থাৎ ছোটদের সবার প্রথম এবং একমাত্র ফেভারিট ব্রাজিল। আমার ক্ষেত্রে কাজ করেছিল দু'জন প্লেয়ারের কারনে। শুনেছিলাম ব্রাজিল স্কোয়াডে দু'জন আছে যাদের একজনের নাম সক্রেটিস আর আরেকজন জুলিয়াস সিজার। এই নাম মানুষের হতে পারে? আমি তো বইয়ে পড়েছি এদের নাম। শেষ পর্যন্ত সক্রেটিস দুটো গোল দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু আসর মাত করে রেখেছিল 'ক্যারেকা' নামের এক জাদুকর। পেয়েছিলেন ৫ গোল! কিন্তু মেজাজ হারিয়েছিলাম এটা মনে আছে আর স্কুলের কানাঘুসায় উত্তেজিত হয়ে পড়ে দাড়িঅলা সক্রেটিস আর সিজারের প্রতি ভালবাসা হারিয়েছিলাম একটি বিশেষ কারণে। দু'জনেই কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে টাইব্রেকারে গোল মিস করেছিল! তাও এই ফ্রান্সের কাছে! মজার ব্যাপার মিশেল প্লাটিনিও ছিল ফ্রান্সের সেই স্কোয়াডে। বাবা বলেছিলেন এর দিকে চোখ রাখতে, অঘটন ঘটাবেই। অঘটন ঘটিয়েছিলেন। তিনিও পেনাল্টি মিস করেছিলেন! ব্রাজিলের খেলা সেখানেই শেষ! কিন্তু এখন সাপোর্ট করবো কাকে?

হঠাৎ করেই নজর কাড়লো একজন। নাম গ্যারি লিনেকার। ইংল্যান্ডে খেলেন। পোলান্ডের সাথে তিনি হ্যাট্রিক করে বসলেন। পাড়ার বন্ধু বান্ধবরা আবার উত্তেজিত। এই ইংল্যান্ডই পারবে ফ্রান্সকে উচিৎ শিক্ষা দিতে। ভাল কথা। কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা চলছে। তুমুলভাবে ইংল্যান্ড সাপোর্ট করে যাচ্ছি। বাবাও তাই। কারণ ফ্রান্স এই ইংল্যান্ডের হাতে, এই সেমিফাইনালেই নাকানি চোবানি খাবে। কাপ যেই জিতুক তাতে কিছু যায় আসে না। তখনও জানতাম না বিধাতা খেলা নিয়ে কি অদ্ভুত খেলাই না খেলবে!

ছোটখাট গড়ন, পেটমোটা এক ফুটবলার একাই ৭ জনকে কাটিয়ে নিয়ে গোল দিয়ে দিলেন! তার আগেও একটা দিয়েছেন, কিন্তু হাত দিয়ে। তা আবার জেনেছি অনেক বড় হয়ে। লিনেকার ব্যাটা গোল পেয়েছে ঠিকই কিন্তু ততক্ষনে সব শেষ! কিন্তু ভুলতে পারলাম না খেলাটার কথা, ভুলতে পারলাম না সেই পেটমোটা লোকটার কথা। ততক্ষনে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছি। ফ্রান্সকে শিক্ষা দিতে হলে এরকম টিমই দরকার। এই আর্জেন্টিনাকেই দরকার। কারন ফ্রান্স ব্রাজিলকে হারিয়েছে। হঠাৎ করেই বাবা বলে বসলেন, আমি নাকি আসলে খেলা না বুঝেই এইসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছি! মূল কথা হলো, ব্রাজিল বাজে খেলেছিল বলেই সেদিন হেরেছিল, এখানে ফ্রান্সের কি দোষ? এত বোঝানোর পরেও রাগ যাচ্ছে না। পুরো মন প্রান আর্জেন্টিনাকে সঁপে দিয়ে কায়মোনো বাক্যে ওয়েষ্ট জার্মানির মুন্ডুপাত করে যাচ্ছি, যাতে ওরা ফ্রান্সের কাছে হেরে যায়। আর গিয়ে পড়ে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার কাছে। এদিকে একই দিনে বেলজিয়ামেরও মুন্ডুপাত করছি যাতে তারা না জেতে। ম্যারাডোনা নিরাশ করেনি। দুই গোলে আর্জেন্টিনা জিতেছে এনজো শিফোর বেলজিয়ামের সাথে। দু'টো গোলই দিয়েছে ম্যারাডোনা! কিন্তু ফ্রান্স হেরে বসলো জার্মানির কাছে! একই দিনে দুটি খেলা ছিল, আমার মনে আছে।

আমি আর জার্মানীতে ফেরত গেলাম না। আর্জেন্টিনাতেই রয়ে গেলাম। জার্মানির সাথে ফাইনালের দিন সে কি উত্তেজনা। সঙ্গত কারনেই উত্তেজনা। কারন গ্যারি লিনেকার ৬ গোল দিয়েছে, ম্যারাডোনার ৫! ইংল্যান্ড যেহেতু ছিটকে পড়েছে, তাই ম্যারাডোনার জোর সম্ভাবনা আছে আরো গোল দেয়ার। ততদিনে পত্র পত্রিকায় আর লোকমুখে শুনে একটা বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল ম্যারাডোনাই পারবে, কারণ সে জাদুকর! গোটা দু্ই গোল দিয়েও দিতে পারে। বাবা আরও একটু উসকে দিয়ে বললেন যে, পেলের পর এই ছোকরাটাকে নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে। তখন তো আর ফেসবুক ছিল না। কত শখ করেই না ম্যারাডোনার খেলা দেখতে বসেছিলাম। সেই ম্যাচে ম্যারাডোনা আর গোলই পায় নি। বাবা খেলার শুরু হওয়ার দশ মিনিট পরেই বলেছিলেন যে, ম্যারাডোনা আজ আর কিছু করতে পারবে না। কারন জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, 'কড়া মার্কিং, সম্ভব না'! আমি কিছুই বুঝলাম না। কিন্তু সেই টুর্নামেন্টে ফ্রান্স হলো ৪র্থ, বেলজিয়াম হলো ৩য়, জামার্নি হলো ২য় আর আর্জেন্টিনা তো ৩-২ গোলে জিতে কাপই নিয়ে গেল। কিন্তু ম্যারাডোনা ছিলেন গোলবিহীন। কে কে গোল দিয়েছিলেন তা আর মনে নেই।

পরের আসর ইটালিতে। আবার জল্পনা কল্পনা। এ টুর্নামেন্টে ঘুরে ফিরে যে কয়েকটি শব্দ উচ্চারিত হয়েছে তা হলো, টোটাল ফুটবল, হ্যাজি, ব্যাজিও, শিলাচি, লুপেসকু, ওমাম বায়িক, রজার মিলা, ক্যানিজিয়া, ম্যারাডোনা আর কোডেসাল। অর্থাৎ নেদারল্যান্ড, রুমানিয়া, ইটালি, ক্যামেরুন, আর্জেন্টিনা আর ফাইনালের রেফারি। সেবার আর আর্জেন্টিনা পারে নি। ব্রাজিলকে আর্জেন্টিনা হারিয়ে দেয়, কিন্তু ম্যারাডোনা গোল পায় নি। কারন সেই 'কড়া মার্কিং' ! কিন্তু ব্রাজিলের বারটা বাজালো ক্যানিজিয়া। এমনকি ফাইনালে উঠতে উঠতে বুরুচাগা, ক্যানিজিয়া ইত্যাকার নানা ফুটবলারদের ফ্যান হয়ে গেলাম। ম্যারাডোনাতো আছেই। আবার ফাইনালে চলে গেল আর্জেন্টিনা! সাথে পেল গতবারের জার্মানীকে। এবার আর হলো না। পরাজয়ের স্বাদ আর্জেন্টিনা আর কি পেয়েছে, আমরা বন্ধু বান্ধবরা তার ৪গুন পেলাম এই ফলাফলে।

১৯৯৪। আসর এবার সাজিয়েছে আমেরিকা। এইবার নজর কাড়ল সুইজারল্যান্ডের সাত্তার (Sutter), সুইডেনের টমাস ব্রোলিন, হল্যান্ডের বার্গক্যাম্প, বুলগেরিয়ার স্টয়েচকভ। ও আরেকজন আছেন, আলেক্সি লালাস। আমেরিকার মানুষ। দাড়িও যে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেধেঁ রাখা যায়, তার উৎকষ্ট নমুনা পেশ করেন তিনি। এই বিশ্বকাপ মনে গেঁথে আছে ৫টি কারনে। এস্কোবারের আত্মঘাতী গোল, রজার মিলার আদু ভাই উপাধি পাওয়া (৪২ বছর), ম্যারাডোনার এফিড্রিন, রোমারিও বেবেতোর চোখ ধাঁধানো সব গোল উৎযাপন, ব্যাজিওর পেনাল্টি মিস! বিশেষ করে রেড ডেভিলদের সেই ক্যাপ্টেন মিশেল প্রুদ হোমের শেষ মিনিটের মরিয়া প্রচেষ্টা জার্মানির বিপক্ষে, কোনদিন ভুলব না। এখনো যখন বেলজিয়ামের খেলা দেখি তখন ঠিক এই কথাটাই মনে পড়ে। সেবার চমক দেখিয়ে ব্রাজিল কাপ জিতেছিল ঠিকই, কিন্তু বুঝতে শিখে গেছি খেলাটা আসলে যতটা না নৈপুন্যের বা গোলের তার চাইতেও বেশি মনোসংযোগের।

সেটা বোঝা গেল পরের আসরে, ঠিক বিশ বছর আগে ফ্রান্সে ১৯৯৮ এ। চিলির জামোরানো সালাস, গোল্ডেন বুট জয়ী ক্রোয়েশিয়ার ডেভর সুকার আর কাপ জয়ী জিদানের খেলা দেখে। এর ঠিক উল্টোটা করার ফলে ব্রাজিল, ইটালি আর জার্মানি বিপরীত ফল পেয়েছে। একটা দৃশ্য এখনো মনে আছে, চারজন ঘিরে ধরে আছে জিদানকে। বল নিয়ে এগুতেই দিচ্ছে না। জিদান একটু থেমে চারপাশ দেখে নিয়ে আলতো পায়ে বলটা উঠিয়ে মাথায় নিল। ঠিক প্রাক্টিসিং এর সময় যে সব স্কিল দেখিয়ে ফুটবলাররা সবাইকে বিমোহিত করে, ঠিক সেই ভাবে ঘাড় আর মাথার খেলা দেখিয়ে বলটা প্রতিপক্ষের মাথার উপর দিয়ে বের করে দেয় জিদান! পুরো কাজটা করার জন্য সময় পেয়েছেন ৪/৫ সেকেন্ড আর জায়গা ছিল ৪/৫ ফিট! প্রতিপক্ষ ভড়কে গিয়ে বলের পেছনে ছুটতে শুরু করে জিদানকে একা ফেলে। জিদান মুক্ত হয়েই ডান দিকে গিয়ে তখনকার ক্যাপ্টেন আর বর্তমানের কোচ দিদিয়ের দেশমের কাছ থেকে পাস নিয়ে হেনরির দিকে ঠেলে দেন। বাকিটা ইতিহাস! আর আমার আর্জেন্টিনা সেই যে কক্ষচ্যুত হলো, বাতিস্তুতা, ক্রেসপো, আয়ালা, সিমিওন, রুগেরি, সোরিন, পম্পিডো, অর্তেগা, জানেত্তি, মাসেরানো, রোহো, হিগুয়েইন, আগোয়েরো এমনকি হালের মেসিরা পর্যন্ত টেনে আনতে পারলো না!

এতগুলো কথা খরচ করলাম এমনি এমনি নয়। পেশাগত কারনে, আমি এই ২০১৮ বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে ঢাকার বাইরে ছিলাম। হোটেলে একা বসে খেলা না দেখে ভাবলাম স্থানীয় মানুষদের সাথে বসেই দেখি। আমি অবসার্ভ করলাম দর্শকরা দুই ভাগে বিভক্ত, একদল বয়স্ক যারা ইটালী, ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা নিয়ে আফসোস করছে; আরেকদল অপেক্ষাকৃত নবীন যারা স্পেন, ক্রোয়েশিয়া, বেলজিয়াম বা জাপানের খেলা দেখে তারিফ করছে। ১৯৮৬ আর ১৯৯০ তে আর্জেন্টিনা ফাইনাল খেলেছে জার্মানির সাথে। তাতে দুই দেশের ফ্যান ফলোয়িং তৈরী হয়েছিল যা আজ অব্দি সেই সময়কার ফুটবল প্রেমিদের মনে এখনো গেঁথে আছে। এরপর বিশ্বকাপ জিতলো ব্রাজিল, ফ্রান্স, ইটালি, স্পেন আর জার্মানি! এভাবে প্রতিটি বিশ্বকাপই নতুন নতুন হিরো তৈরি করে আর নতুন নতুন দলের ক্রেজ তৈরি করে। আমি এখনো ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া, দক্ষিন কোরিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, মেক্সিকো, কলাম্বিয়া, চিলি, জাপান কিংবা ক্রোয়েশিয়ার কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। ভয়ও করি। কারণ গত ৮৬ থেকে খেলা দেখে বুঝেছি ফুটবল সেই আগের মত নেই। যে কেউ, যে কাউকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারে। এটা বিশ্ববাসী এই বিশ্বকাপে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। আমি খুব চেয়েছিলাম ২০১৮ বিশ্বকাপে বেলজিয়াম আর ক্রোয়েশিয়া ফাইনালে খেলুক। তাতে তাবৎ ফুটবল প্রেমীরা একটা নতুন স্বাদ পেত, বিশ্ব ফুটবলও একটা নতুন মাত্রা পেত! তা হয় নি। আর তাতে কিছু আসে যায়ও না। কিন্তু এই ইচ্ছা ব্যক্ত করার ফলে কেউ কেউ ভুল ভাবে নিয়েছে। বলেছে, 'ও! নিজের দল তো আর নাই, তাই!' আবার কেউ বলেছে, 'হাইব্রিড সমর্থক' কিংবা 'ডিগবাজি সমর্থক'!

আমি ফুটবল ভালবাসি। আমি আর্জেন্টিনাই থাকব। এবং এন্টি জার্মানি থাকব। মনে সবসময় আশা থাকবে, দক্ষিন আমেরিকা থেকেই যেন সকল তারকার উত্থান হয়। কাপ যেন এশিয়ার কেউ না কেউ পায় (কবে পাবে, আল্লাহ মালুম), আর বাংলাদেশ যেন ক্রোয়েশিয়ার মতই ঝলসে উঠতে পারে।

শুধু আপত্তি এক জায়গায়। আমাদের সময় ফুটবল ছিল নির্মল নিরন্তর আনন্দের উৎস। কাদা ছোড়াছুড়ি করলেও তা একটা নির্দিষ্ট গন্ডিতে থাকত। পরবর্তীতে আমরা আমরাই গলা ধরে খেলতে যেতাম। বন্ধু সংগত কারনে শত্রু হলেও অপরিচিত থাকত না। এখন ফেসবুক আর ইউটিউব যতটা না জ্ঞানের উৎস তার চাইতে বেশি হয়ে উঠেছে প্রোপাগান্ডা, ম্যানুপুলেশন, ব্যক্তি আক্রমন আর অশিক্ষিত ট্রোলের সমাহার। অপরিচিত কত মানুষ বন্ধু হতে চেয়ে বিভিন্ন বিষয় ভাগ করে নেয়ার পরেও নিমিষেই অপ্রিয় অপরিচিত হিসেবে পরিচিতি পায়! ভয়টা এখানেই। আমার ছেলেটা এই জেনারেশনের। আমার মতন কোন কিছু জানার জন্য আর বাবাকে জিজ্ঞেস করবে না। সোজা স্মার্টফোনটি হাতে তুলে নেবে! পত্রিকা পড়বে না। ল্যাপটপের গুগল থেকেই সব দেখবে। সে জানতে হয়তো পারবে অনেক কিছু, কিন্তু বুঝবে না কিছুই। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম-

অধ্যাপক তথ্য দেন
উপাধ্যায় জ্ঞান দান করেন
আচার্য দক্ষতা দেন
পন্ডিত নিরীক্ষা শক্তি দেন
গুরু দেন অর্ন্তদৃষ্টি

শেষকথাঃ
ফ্রান্সকে আমি পছন্দ করতাম জিদানের কারনে। বেলজিয়ামকে এনজো শিফোর কারনে। তেমনি ভাবেই সুকারের কারনে ক্রোয়েশিয়া। ইংল্যান্ডকে বেকহ্যামের জন্য। আর মেসি তো আছেই একটা ভিন্ন জায়গায়। আগামি বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার না হোক, অন্তত নতুন কারো হাতে যেন ওঠে।

ক্রোয়েশিয়াকে ধন্যবাদ। অন্তত ছেড়ে কথা বলেনি। 'দুর্ভাগ্য' ছিল তাদের অপর প্রতিপক্ষ!

*** এবারের বিশ্বকাপে আমি যাকেই সমর্থন করেছি, তারাই হেরেছে। আর এই বিশ্বকাপে আমার প্রিয় খেলোয়াড়দের একজন হলো হ্যাজার্ড! গতবার ছিল ফোরলান।

আর মেসিতো মেসিই!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ২:১৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিপ্লবের নিঃশব্দ মূল্য: অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বাংলাদেশি ছাত্র আন্দোলন

লিখেছেন মুনতাসির, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:২৫

এ লেখাটি বেশ বড়ো। এখানে ছোট করে দেয়া হল। পুরো লেখাটি যদি কেও পড়তে চান, তবে নীচের লিঙ্ক থেকে পড়তে পারবেন।


সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন পর্যালোচনা চলছে। জাতিসংঘের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিরহ

লিখেছেন গোধুলী বেলা, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:৪৪

একটি কবিতা লিখা হবে বাদে কিছুক্ষণ
মেঘমালারা বারি পাত করিছে ক্ষণে ক্ষণ।
গগনভেদি কামান গোলা পরিছে মুহুর্মুহু
দুরুদুরু ভয়েতে কাপিছে বুক বাদ যায়নি কেহ।

জানালার পাশে  প্রেমিকার ছলছল চোখ
বৃষ্টিরো সাথে সে কেঁদে  ভাসাইছে বুক।
হাজারো... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিছু কিছু মানুষ বলার শুরু করেছে, "আমরা আগেই ভালো ছিলাম"।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:০২



একাধিক কারণে মানুষ ইহা বলার শুরু করেছেন: (১) সাধারণ মানুষ কোমলমতিদের ক্রমেই চিনতে পারছেন, ইহা ভীতি ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করছে; কোমলমতিরা সরকারের গুরুত্বপুর্ণ অনেক পদে আছে ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি - একাল সেকাল

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮



টানা বৃষ্টির মধ্যে মরিচের দাম বেড়ে হয়েছে ৪০০ টাকা কেজি । অন্যদিকে ফার্মের মুরগির এক পিছ ডিমের দাম বেড়ে হয়েছে ১৫ টাকা।শুধু মরিচ নয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কমলা যদি পরাজিত হয়, "দ্রব্যমুল্য"ই হবে ১ নম্বর কারণ

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৭



দ্রব্যমুল্য হচ্ছে অর্থনৈতিক সুচকগুলোর ১ টি বড় প্যারামিটার; ইহা দেশের অর্থনীতি ও চলমান ফাইন্যান্সের সাথে সামন্জস্য রেখে চলে; টাস্কফোর্স, মাস্কফোর্স ইহার মুল সমাধান নয়; ইহার মুল সমাধন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×