শিক্ষক ক্লাশের ডানপিটে ছাত্র বল্টুকে জিজ্ঞেস করলো, বল্টু তোমাকে যদি একটি বই আর একশো টাকা থেকে যে কোনো একটি নিতে বলা হয় তুমি কোনটি নেবে? বল্টুর উত্তর আমরা সবাই জানি, সে একশো টাকা নিতে চাইবে। অন্যদিকে শিক্ষক মহোদয় কিন্তু জ্ঞান আহরণের জন্য বই’ই নিতে চাইবেন। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যাটা তখন তৈরি হয় যখন ক্লাশের ঐ ডানপিটে ছাত্রটি পরবর্তীতে বড়ো বড়ো ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষক হয়ে ক্লাশরুমে ফিরে আসে এবং আরেকজন ডানপিটে ছাত্র মানিককে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হয়! এখানে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তা কি কেবলমাত্র বল্টুর বয়স দিয়ে ব্যাখ্যা দেয়া যায়? বল্টুর শিক্ষা কি এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে না? নাকি অন্য কিছু? যাইহোক, আমি যখন ডানপিটে বল্টু ছিলাম তখন অবশ্য এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি। ডানপিটে বল্টুবস্থায় চরম ফাঁকিবাজ ছিলাম, নেহাত বেসিক ভালো ছিলো বলে পরীক্ষায় উৎরে যেতাম। গল্পের বই পড়ার প্রবল নেশা ছিল, আর পরীক্ষার সময় এই নেশাটা বিশেষভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো। ম্যাট্রিক পরীক্ষা চলাকালীন সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময়-প্রথম খন্ড হাতে পেলাম। পরীক্ষার পড়ার ফাঁকে লুকিয়ে লুকিয়ে কয়েকদিনেই শেষ করে ফেললাম। দ্বিতীয় খন্ডের খোঁজে আশেপাশে নজর দিলাম, পেলাম না। প্রথম খন্ডটা আবারো শুরু করলাম, দ্বিতীয় খন্ডের জন্য তৃষ্ণা বাড়তেই থাকলো। লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়ে ব্যবহারিক পরীক্ষা শুরু হলো। ভরদুপুরে কড়া রোদে টুপি মাথায় ক্রিকেটার হবার অপূরণীয় আরেক নেশা জেগে উঠতে শুরু করলো। নতুন মৌসুমে কোন দলের বিরুদ্ধে কোন মাঠে কত রান করলাম- সেসব ডাইরীতে লিপিবদ্ধ করা শুরু করলাম। পরিসংখ্যান আরকি! যেহেতু সন্ধ্যার পর নিয়ম করে পড়তে বসতে হচ্ছে না, কাজেই পাঠ্যবইয়ের পাতার ভাঁজে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ার সুযোগও কমে যাচ্ছে। আরো মাস খানেক পড়ে সেই সময়-এর দ্বিতীয় খন্ড হস্তগত হলো। বিপুল উৎসাহ নিয়ে পড়া শুরু করলাম, কিন্তু কয়েক পাতা পড়ার পর মনে হলো- মজা পাচ্ছি না। জোড় করে আরো খানিকটা এগোলাম কিন্তু মন ভরছে না। ফলাফল আট-দশ পৃষ্ঠা পড়ার পরই দ্বিতীয় খন্ড পড়ায় ইস্তফা দিতে হলো। এ পর্যায়ে এসে বনফুলের পাঠকের মৃত্যু-এর বেশ যুতসই একটা উদাহরণ মনে হতে পারে, কিন্তু বছর খানেক পরে পাঠকের পুনর্জন্ম হলো। ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন সময়ই দ্বিতীয় খন্ডটা পড়লাম। সেসময় পরীক্ষা মাথার ওপর ছিল কিনা ঠিক মনে পড়ছে না।
আমার জীবনে প্রথম পাওয়া (মনে থাকা সাপেক্ষে ও যেকোনো পাতায় নিজের নাম লিখতে পারা সাপেক্ষে) গল্পের বই হলো- পিটারপেন! গল্পের বই না বলে অবশ্য কমিকসও বলা যেতে পারে। কোনো এক সুন্দর বিকালে শিউলী খালা (ছোট খালা) বইটা উপহার দিয়ে ছিলেন। পাতাভরা রংবেরংয়ের ছবি, সামান্য কিছু লেখা আমার শিশু মনে দারুণ দাগ কেটেছিল। তখন বয়স বড়োজোড় ছয় কি সাত! কাল্পনিক জগৎ থেকে উড়তে উড়তে পিটারপেন টিংকারবেলকে সাথে নিয়ে ওয়েন্ডিদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে ফেলে যায় ওর ছায়াটা, পরের রাতে আবারো ছায়া নিতে ফিরে আসে ওরা। ওয়েন্ডি জেগে উঠে পিটারপেনকে দেখে। পিটারপেন কিছুতেই ছায়াটা নিজের শরীরের সাথে জুড়ে দিতে পারছিল না, সে পিটারপেনকে তার ছায়া জোড়া লাগাতে সাহায্য করে। পিটার ওকে কল্পনার জগৎ নেভারল্যান্ডের গল্প শোনায়। ওদের উড়তে শেখায়... কী দারুণ এক জগতে টেনে নিয়ে যেত শিশু আমাকে, যদিও আমি টানা কখনো বইটা পড়ে শেষ করতে পেরেছি বলে মনে পড়ে না। আরেকটা কমিকসের নাম মনে পড়ছে- মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ। বৈশাখী মেলায় ঠাকুরগাঁও থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। শুধু নামটাই মনে আছে, ভেতরের উপাদান পুরোপুরি ভুলে গেছি।
একটা বিশেষ কারণে বছরে কয়েকবার দিনাজপুর থেকে রাজশাহী রেলভ্রমণ করা হতো। দিনাজপুর থেকে রাজশাহী পর্যন্ত সরাসরি কোনো ট্রেন ছিল না। শাটল ট্রেনে পার্বতীপুর, তারপর সেখান থেকে অন্য একটি আন্তঃনগর ট্রেন ধরতে হতো। মাঝে মাঝে শাটল ট্রেন আগে পৌঁছালে বা আন্তঃনগর ট্রেন দেরীতে এলে বেশ অনেকটা সময় প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করতে হবে। স্টেশনে ভ্রাম্যমান বই বিক্রেতাদের কাছে
এক ফর্মা বা দুই ফর্মার ছোট ছোট বই পাওয়া যেত। ভুতের গল্প কিংবা কৌতুকের বই। কোনোভাবেই বই কেনা এসব সুযোগ হাতছাড়া করতাম না। ভুতের গল্পগুলো অবশ্য জমিয়ে রাখতাম বাড়িতে পড়ার জন্য আর কৌতুকের বই পড়ে সবাইকে শোনাতাম। বস্তাপঁচা সেইসব কৌতুক শুনে কেউ না হাসলে খুব মন খারাপ হতো।
আম্মা ও আব্বা দুজনই ছিলেন স্কুল শিক্ষক এবং বইয়ের প্রতি বিশেষ অনুরাগী। বাড়িতে একটা আলমারী ছিল বইয়ে ভরা। বিভিন্ন বয়সের মানুষের জন্য বই থাকলেও শিশুতোষ বই খুব বেশি ছিল না। তবে দুইটা বইয়ের প্রতি আমার বিশেষ আকর্ষণ ছিল। একটা হলো- রেডিয়েন্ট ওয়ে নামক ইংরেজি ছড়ার বই। ভাই বোনদের মধ্যে একমাত্র মেজ ভাই মিশন স্কুলে পড়েছেন, সেই সুবাদে এটা ছিল উনার পাঠ্যবই। ইংরেজি ছড়ার পাশাপাশি প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছিল সুন্দর সুন্দর কার্টুনছবি যা ছিল আমার আর্কষিত হবার কেন্দ্রবিন্দু। আম্মা মাঝেমাঝে বইটা আমার হাতে দিতেন, নির্দিষ্ট সময় পর আবার তুলে রেখে দিতেন। আর দ্বিতীয় বইটা হলো- একটা ইংরেজি বর্ণমালা বই, যার মালিক আমার বড়ো ভাই, যিনি বয়সে আমার চেয়ে এক যুগ বড়ো। যথারীতি সেটাতেও ছিল চমৎকার সব ছবি। পাতাগুলো লেমিনেটিং করা। এখনো মনে আছে, একটা লাল বাই-সাইকেলের ছবি ছিল ওটাতে। রেডিয়েন্ট ওয়ে মাঝে মাঝে হাতে পেলেও এই
বইটা প্রায় পেতাম না বললেই চলে। আর এজন্যই হতো লাল বাই-সাইকেলটার কথা এখনো মনে আছে। প্রাইমারী পার হবো হবো করছি এমন একটা সময়ে ঠাকুরমার ঝুলি, ছোটদের আরব্য রজনীর গল্প, শাস্তি দিলেন শায়েস্তা, ঈশপের গল্প ইত্যাদি পড়া প্রায় শেষ তখন আলমারীর বইগুলোর মধ্যকার একটা সারিতে আবিস্কার করলাম তিন গোয়েন্দা সিরিজের অনেকগুলো বই। পরিচয় হলো কিশোর পাশা, রবিন মিলফোর্ড ও মুসা আমানের সঙ্গে। লস অ্যাঞ্জেলসে চাচা-চাচীর কাছে বড়ো হওয়া বাঙালি কিশোর পাশার নেতৃত্বে কত যে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছে তা বলে শেষ করা যায় না। ঘটনাচক্রে জিনা, রাফিয়ান, ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের সাথেও পরিচয় হলো। ‘ঝামেলা’ বুড়ো ফগর্যাম্পারকটকে ভালো লেগে গিয়েছিল। তারপর একদিন ওকিমুরো কর্পোরেশনের ওমর শরীফও এসে হাজির হলো। এদিকে প্রাইমারী পেরিয়ে হাইস্কুলে উঠে তিন বন্ধু মিলে আমরাও শখের গোয়েন্দা সংস্থা খুলে ফেললাম, নাম দিলাম- আমরা তিনজন। যেহেতু গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছি কাজেই একটা কার্ড (ভিজিটিং) বানাতে হয়। বড়ো ভাইদের ব্যবহৃত প্রাকটিক্যাল খাতার ভেতরের মোটা কাগজগুলো সংগ্রহ করলাম। ছোট করে কেটে একদিকে বিভিন্ন ধরনের নকশা করে অন্যদিকে সংস্থার নাম ও সদস্যদের নাম হাতে লেখা হলো। সংস্থার নামের নিচে তিনটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেয়া হবে নাকি আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দেয়া হবে এই নিয়ে ছোটখাটো একটা ঝামেলাও বেঁধে গেল তিনজনের মধ্যে। তিন গোয়েন্দার কার্ডে শুরুতে ছিল তিনটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন, মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই ব্যবস্থা! তাছাড়া নিজেদের প্রয়োজনে পাশাপাশি তিনটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকেও নিজেদের মধ্যে সংকেত আদান-প্রদান করা যাবে। কিশোর পাশার মাথা থেকে এই বুদ্ধি বের হয়েছিল। পরে অবশ্য ওরা প্রশ্নবোধক চিহ্ন পরিবর্তন করে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন ব্যবহার করে। ব্যাখ্যাটা
অনেকটা এমন ছিল যে, এতে করে একদিকে যেমন মানুষের দৃষ্টি আর্কষণ করা যাবে তেমনি বিষয়টা ব্যাখ্যা করার জন্য আলোচনা দীর্ঘায়িত করা যাবে। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত আমরা প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়েই শুরু করেছিলাম। কলম হারানো ছাড়া আর তেমন কোনো কেস পেতাম না। চুরি হওয়া বেশিরভাগ কলমের ব্র্যান্ড ছিল ‘রেডলিফ’ যেগুলো দেখতে একই রকম এবং অনেক ছাত্রই তা ব্যবহার করতো। কেসগুলো প্রায়ই অমিমাংসিত থেকে যাচ্ছিল আর গুরুত্বপূর্ণ তেমন কোনো কেসও পাচ্ছিলাম না। ফলাফল ধীরে ধীরে শখের গোয়েন্দাগিরি থেমে গেল। গোয়েন্দাগিরি থেমে গেলেও গোয়েন্দাকাহিনী পড়া থামলো না।
ফেলুদার সাথে তখনো পরিচয় না হলেও শ’খানেক তিন গোয়েন্দা পড়ার পর মাসুদ রানার সাথে পরিচয় হলো তেমনি আবার মুহাম্মদ জাফর ইকবালের হাকারবিন, দীপু নাম্বার টু কিংবা হুমায়ুন আহমেদের বোতল ভুত-এর মতো কিশোর উপন্যাসগুলো হাতে আসতে লাগলো। একদিন বাংলা ব্যকরণ ক্লাসে এক বন্ধু লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়তে গিয়ে ধরা খেল, পন্ডিত স্যারের তিন নম্বরি বেতের মার খেয়ে সে প্রায় অজ্ঞান যাচ্ছিলো। স্যার সঙ্গে করে বইটাও নিয়ে গেলেন। আমাদের একবন্ধু যে লুকিয়ে গল্পের বই পড়তে গিয়ে ধরা খেয়ে প্রায় শহীদ হয়ে যাচ্ছিলো সেদিকে আমাদের কারো খেয়াল নেই, পুরো ক্লাস তখন বইয়ের নাম উদ্ধার করতে ব্যস্ত। সবার মনেই এক প্রশ্ন- কী এমন বই যা পন্ডিত স্যারের ক্লাসেও পড়তে হবে? সেই বন্ধুটিকে বইয়ের নাম জিজ্ঞেস করা হলে সে বইয়ের নাম বলে না। স্কুল ছুটির পরে পন্ডিত স্যারে বইটা ফিরিয়ে দিলে আমরা করা কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে বইয়ের সুতা-বাঁধাই খুলে গিয়ে একেকজনের কাছে একেকটা পাতা চলে যায়। আমার ভাগে যেক’টা পাতাটা এলো তাতে দুইজন কিশোরের ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে মাছ চুরি করতে যাবার রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতার বর্ণনা পেলাম। জলের স্রোতে বালির পার ভাঙ্গার আওয়াজ, ঝাউবনের পাশ দিয়ে মক্কা ক্ষেতের ভেতর দিয়ে লুকিয়ে দাঁড় টানা, জেলেদের হাতে ধরা পড়া পড়লে কীভাবে পালাতে হবে তার আগাম বর্ণনা, গোটা কতক বড়ো বড়ো মাছ চুরি করে ডিঙ্গি নৌকায় তোলা, ফিরে আসার সময় জেলেদের হাতে ধরা পড়লো বলে এবং তারপর আমার সংগ্রহের পাতা শেষ! ভাবা যায়? এই রোমাঞ্চকর ঘটনার পরের অংশ তো পড়তেই হবে। পরের পাতা কার কাছে গেল? খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে বইটা যে সংগ্রহ করতেই হবে সে বিষয়ে আর কোনো দ্বিমত রইল না। ভাষাটা একটু কাটখোট্টা তবুও চালিয়ে নেয়া যায়। ইন্দ্র আর শ্রীকান্তের এই গল্প পরবর্তীতে বহু-বহুবার পড়েছি। যতবারই পড়েছি ততবারই মনে হয়েছে, এই গল্প পন্ডিত স্যারের ক্লাসে লুকিয়ে পড়া মোটেও অযৌক্তিক নয়।
স্কুল জীবনে আব্বা-আম্মার গড়ে তোলা লাইব্রেরীতে আরো অনেক বই দেখতাম, যেমন, বরফ গলা নদী, চিলে কোঠার সেপাই, টুনি মেম, সুলতানার স্বপ্ন, বিষাদসিন্ধু, আরেক ফাল্গুন ইত্যাদি ইত্যাদি আর ভাবতাম- বড়ো হলে পড়বো। কতটুকু বড়ো হয়েছি জানি না কিংবা কতগুলো বই পড়তে পেরেছি জানি না তবে কৈশরের সেই দিনগুলো এখনো ভালো থাকার প্রেরণা যোগায়।
ছবি: গুগলমামা।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০২২ সকাল ১১:২০