somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ত্যাগ

১৯ শে জানুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৪:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সাল দুই হাজার এক, ডিসেম্বর মাস, দেয়াল ঘড়িটায় কট্‌-কট্‌ করে দুইটা বাজে, শব্দ শোনতে শোনতে এমনেই বড় ক্লান্ত তার উপর দুই ডানার ছিলিং ফ্যানটার শব্দে বড় অস্থির আরিফ সাহেব, অনেক বার কেয়ারটেকার কে বলেও লাভ হয়নি। পাশেই ছোট রাস্তা আগে এই রাস্তায় এতো গাড়ী চলা-চল করতো না এখন প্রচুর গাড়ী চলে আর শুধু শুধু ভেঁপু বাজায় বড় বিরক্তির সাথে বসবাস করতেছেন আরিফ সাহেব। বয়স প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই এই বয়স থেকে মানুষ ফের বাচ্চা হতে শুরু করে, একে তো আরিফ সাহেব বড় রাগী মানুষ ছোট বেলা থেকেই তার উপর কিছু দিন ধরে হুইল চেয়ারটারও আওয়াজ বেড়ে গেছে, কয়েক বার করে হুইল চেয়ারের জয়েনে জয়েনে তেল দিয়েছে, একদিন ভালো থাকে তো, তার পর আবার আওয়াজ শুরু হয়ে যায়। শব্দ নামক সন্ত্রাসের জ্বালায় জীবন অতিষ্ঠ এক কথায় শব্দ বা আওয়াজ থেকে মুক্তির আশায় আরিফ সাহেব বড় ক্লান্ত।
হঠাৎ দরজায় খট্‌ খট্‌ শব্দ। কে?
আমি স্যার কেয়ারটেকার মামুন।
আরিফঃ- কি চাই?
মামুনঃ- স্যার আপনার সাথে দেখা করতে এক ভদ্র মহিলা এসেছে।
আরিফঃ- চলে যেতে বলো আমি আর কোন ইন্টারভিউ দেব না, মার্চ আর ডিসেম্বর এলেই সাংবাদিকরা পাগল হয়ে যায়, সারা বছর আর কোন খবর রাখে না, মামুন উনাকে চলে যেতে বল।
মামুনঃ- স্যার উনি লন্ডন থেকে এসেছে।
আরিফঃ- ওহ! এখন তা হলে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকরাও জ্বালাবে।
মামুনঃ- স্যার উনি সাংবাদিক নয়, আপনার পরিচিত বলতেছে, আপনাদের গ্রামের বাড়ীর।
আরিফঃ- মামুন আমার কাছে কোন টাকা-পয়সা নেই, আমি কাউকে কোন সাহায্য করতে পারবোনা, এক পঙ্গু কি আর করতে পারে, তিরিশ বছর ধরে হুইল চেয়ার বসা বৃদ্ধ কিছুই করতে পারবে না, উনাকে চলে যেতে বলো। দুঃখিত আমি দেখা করবো না।
নারী কন্ঠে- এখনও আগের মতো রাগ একটুও কমেনি বুঝি?
আরিফঃ- কে আপনি ভিতরে চলে এলেন, চলে যান এখন আমার খাবারের সময় হয়ে গেছে, মামুন খাবারের ব্যবস্থা করো আমি আসতেছি।
আমাকে খেতে বলবেন না? আমারও খুব খিদে পেয়েছে, মামুন সাহেব আমার জন্যও খারাবের ব্যবস্থা করুন।
আরিফঃ- অনুদানের টাকায় আমরা চলি আপনার জন্য খাবার এখানে নেই, বাহিরে হোটেল আছে ওখানে যান, শুনেছি ওখানে নাকি ভালো খাবার পাওয়া যায়।
তো ঠিক আছে আমি আপনাকে খায়াবো চলুন বাহিরের হোটেলে।
আরিফঃ- এক বার বলেছি চলে যান, তার পরও আপনি নির্লজ্জের মতো এখনও দাঁড়িয়ে আছেন, চলে যান।
চলে যাবো কিছুটা সময় চাই আপনার নিকট “রাধিকার” জন্য।
থমকে গেলো আরিফ সাহেব!! কে আপনি?
আপনার কিছুটা সময় দিন সব বলবো।
আরিফঃ- আমিতো এখন খাবার খাবো, তারপর দশ মিনিট পাবেন।
ঠিক আছে আমিও খাবার খাবো, মামুন সাহেব খাবার এখানে নিয়ে আসুন।

আপনার কি মনে আছে কালিকাপুর?
আরিফঃ- কেন নয়? খুব মনে আছে, সেই দিনগুলো মনে করে করেই তো গত তিরিশ বছর কাটিয়ে দিয়েছি।
আর আপনার চেয়ারাটা আমার পরিচিত-পরিচিত মনে হয়? আপনার গ্রাম কি কালিকাপুর।
কালিকাপুর মনে আছে আর কালিকার পুরের রাধিকাকে ভুলে গেছেন?
আরিফঃ- কালিকাপুর ভুলে যেতে পারি কিন্তু রাধিকাকে ভুলা যাবে না, সে আছে আমার অন্তর জুড়ে।
যাকে অন্তর জুড়ে রেখেছেন, তাকে একটু আগে সামনে আসতে দিচ্ছিলেন না।
আরিফঃ- তুমিই রাধিকা? অনেকটা পরিবর্তন চেনাই যাচ্ছে না।
রাধিকাঃ-এতো দিনে পৃথিবী অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু তোমার রাগ এখন আগের মতোই রয়ে গেছে। একটুও পরিবর্তন হয়নি।
আরিফঃ- কি আর করবো এই রাগ সাথে নিয়েই মরে যেতে হবে মনে হয়, তুমি দেশে কবে আসলে?
রাধিকাঃ- গত সপ্তাহে এলাম, দশ দিন আছি।
আরিফঃ- ছেলে-মেয়েরা আসেনি সাথে, তার কতো বড় হয়েছে, কেমন আছে?
রাধিকাঃ- না ছেলে-মেয়ে কেউ আসবেনা তারা বাংলাদেশকে পছন্দ করে না, লেখা-পড়া শেষ করে ছেলে নিজেদের কোম্পানি পরিচালনা করতেছে এই বছর থেকে, আর মেয়ে এখনও লেখা-পড়ায় আছে।
আরিফঃ- আর তোমার স্বামী? সে কি করে?
রাধিকাঃ- উনি গত বছর বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছে।
আরিফঃ- দুঃখিত আমি, দুঃখিত রাধিকা।
রাধিকাঃ- এইস ওকে।
আরিফঃ- আমি কিন্তু তোমাকে অনেক খোঁজেছি, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই তোমার বাড়ীতে গিয়েছিলাম আগস্ট ১৯৭২ কিন্তু তোমাদের ঘরে তালা ঝুলানো ছিল, তখন কেউ তোমাদের কোন খবর দিতে পারেনি, তারপর থেকে আর গ্রামে ফিরে যাইনি। ৮২ সালে জানতে পারি তুমি বেঁচে আছ আর তোমার বিয়ে হয়েছে স্বামীসহ বিদেশে আছ।
রাধিকাঃ- তোমার এই অবস্থা কি করে হলো?
আরিফঃ- দেশ স্বাধীনের দশ দিন আগে একটা অপারেশনের সময় আমার পায়ে এবং কোমরে গুলি লাগে, আমাকে বাঁচাতে একটা পা কেটে ফেলতে হয় আর আমি চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেলাম। তিন দিন পর আমার জ্ঞান ফিরে, দেশ স্বাধীন হওয়ায় ভেবেছি স্বাধীন হয়ে গেলাম কিন্তু তার বিনিময়ে হারিয়েছি মা-বাবা, যাদের ৭১ সালে পাক বাহিনী হত্যা করে, ওদের মৃত দেহ পর্যন্ত পাইনি। হারিয়েছি বড় ভাই যার খবর আজও মিলেনি, বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। যাকে এতো ভালোবাসতাম তাকেও হারিয়ে ফেলেছি। বেঁচে থাকার ইচ্ছে ছিলো না, কি আর করা আল্লাহ এখন বাঁচিয়ে রেখেছেন।
রাধিকাঃ- তোমার না একটা ছোট ভাই ছিল?
আরিফঃ- আছে, এখন মনে হয় ঢাকায় পরিবার নিয়ে আছে।
রাধিকাঃ- তোমার খোঁজ-খবর নেয় না, আর তুমি “পঙ্গু যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় কেন্দ্রে” কেন?
আরিফঃ- ছোট ভাই একবার এসেছিল এখানে, তার বিয়ের দাওয়াত দিতে, যাওয়া হয়নি। এখানে খুব ভালো আছি দুই বেলা খাবার মিলে, ওষুধ মিলে, বিনোদনের জন্য টিভি আছে বই আছে ভালোই কেটে যায়।
রাধিকাঃ- তোমার ভাই এটা ঠিক করেনি?
আরিফঃ- কেনো? তুমিও তো আমার অপেক্ষা করোনি, একজন পঙ্গুর জন্য কি ভরসায় অপেক্ষা করবে।
রাধিকাঃ- বিশ্বাস করো আমার কিছুই করার ছিল না, দেশ স্বাধীনের পর-পরই বাবা আমাদের আত্নীয়ের সাথে আমার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়ে দেয়, আমি একজন মেয়ে কি করবো, তুমিও স্বাধীনের পর ফিরে আসোনি, বাবা-মাকে কিছুতেই বুঝাতে পারিনি তুমি বেঁচে আছ। সবাই বলা-বলি করছে তুমি বেঁচে নেই কিন্তু আমার মন মেনে নিতে পারে নি।
আরিফঃ- যাক, এখন ঐ সব ভেবে কি আর হবে, তোমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে মনে হয়, একটু পরে সন্ধ্যা হয়ে যাবে, সন্ধ্যার পর এখান থেকে গাড়ী পাবে না।
রাধিকাঃ- আমি গাড়ী নিয়ে এসেছি। আর একটা কথা তুমি আমার সাথে লন্ডনে চলো।
এই কথা শোনার পর আরিফ সাহেব খুব রেগে গেলেন।
আরিফঃ- মামুন ম্যাডামকে গাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসো, কোথায় মামুন জলদী করো। আর ম্যাডাম আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?
রাধিকাঃ- আরে কি বলতেছে তুমি?
আরিফঃ- আপনি আর কখনও এখানে আসবেন না।
এই বলে নিজ রুমে চলে গেলেন আরিফ সাহেব একবারও পিছন ফিরে চায় নি
মামুনঃ- ম্যাডাম চলেন আপনাকে গাড়ী পর্যন্ত পৌছে দেই, স্যারকে কেউ বুঝাতে পারবে না, আজ আর ঘর থেকে বাহির হবে না, দরজা বন্ধ করে রাখবে রাতের খাবারও মনে হয় খাবেনা প্লীজ ম্যাডাম আপনি আসুন।
রাধিকা চোখ মুছতে মুছতে গাড়ীর দিকে চলতে লাগলো.........।

১৬-০৬-২০১৬ ইং
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৪:৪৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×