বহু বিবাহ প্রথা নিয়ে বর্তমান সমাজে অনেক কথাই হচ্ছে যে ইসলাম ধর্ম নাকি পুরুষদের বহুবিবাহ করতে উৎসাহ দেয়, ইসলামী শরীয়াহ নাকি বহু বিবাহের মাধ্যমে পুরুষদের কে উৎসাহ দেয় ঘরে সতীন ঢুকিয়ে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করার। আচ্ছা আসলে ইসলামী শরীয়াহ বহু বিবাহ কে কতটুকু সমর্থন করে বা কোন পুরুষ কি চাইলেই যত ইচ্ছা বিয়ে করতে পারবে এবং বহু বিবাহ করার পর একজন পুরুষকে কিভাবে সংসার চালাতে হবে এই বিষয় গুলি নিয়ে আমি এখন আমার এই Note এ বিস্তারিত আলোচনা করবো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কন্যা ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহার নাম তো আমরা সবাই জানি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহা কে খুব ভালবাসতেন। ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহা অনেক অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন। ফাতেমী তসবীহ নামে যে তসবীহ টা আমরা ৫ ওয়াক্ত নামাযের পর ও রাতে ঘুমানোর আগে পড়ি সেটা কিন্তু হযরত ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহা থেকেই বর্ণিত হয়েছে। এমনকি ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহার প্রতি বেশি শ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে শিয়ারা তাদের রাজ্য শাসন ব্যবস্থাকে ফাতেমী খিলাফত নামে অভিহিত করতো।
ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহা জীবিত থাকা অবস্থায় আলী রাযিআল্লাহু আনহু ২য় বিয়ে করতে চাইলে এটা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন - "যে ব্যক্তি ফাতেমাকে কষ্ট দিবে সে আমাকে কষ্ট দিবে।" [তথ্যসূত্রঃ মেশকাত শরীফ, আহলে বাইত অধ্যায়] ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহা একজন সুস্থ সবল সন্তান দায়িনী মা ছিলেন। আলী রাযিআল্লাহু আনহুর ঘরে উনার কয়েকটি ছেলে মেয়ে ছিল। যদি এমন হত যে ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহার কোন ছেলে মেয়ে হয়নি বা ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহা অসুস্থতার কারনে সংসার চালাতে পারছেন না তাইলে আলী রাযিআল্লাহু আনহু ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহা জীবিত থাকা অবস্থায় বিয়ে করতে চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী কে কোন বাধা দিতেন না। কিন্তু ঘরে একজন সুস্থ সবল সন্তান দায়িনী স্ত্রী রেখে আলী রাযিআল্লাহু আনহু ২য় বিয়ে করবে এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পছন্দ করেন নি। আলী রাযিআল্লাহু আনহু তাই ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহা জীবিত থাকা অবস্থায় আর কোন বিয়ে করেননি। তবে ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহার মৃত্যুর পর আলী রাযিআল্লাহু আনহু ২য় বিয়ে করেছিলেন। [ তথ্যসূত্রঃ হায়াতুস সাহাবাহ রাযিআল্লাহু আনহু, হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ কান্ধলভী রহমাতুল্লাহ আলাইহি, দারুল কিতাব, ৫০, বাংলাবাজার, ঢাকা- ১১০০]
আপনি হয়ত এখন বলবেন যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তো বহু বিবাহ করেছিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বহু বিবাহ নিয়ে আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর আপনি এই লিংকে ক্লিক করলেই পাবেন
ইসলামে অনেক কিছুই জায়েজ তবে শোভন নয়। মা বাবার আপন চাচাত ফুফাত বোনকেও বিয়ে করা ইসলামী শরীয়তে জায়েজ তবে এটা ইসলামে শোভন নয় বা ইসলাম কখনো এই জাতীয় বিয়ে করতে উত্সাহ দেয় না। আপনি হয়ত এখন বলতে পারেন যে ইসলামী শরীয়তে কেন তাইলে পিতার বা মাতার আপন চাচাত মামাত বোনকে বিয়ে করা জায়েজ করেছে। এর কারন হল কখনো যদি কোন মুসলিম উনাদের কাউকে বিয়ে করেই ফেলে তাইলে যেন এটা কোন হারাম কাজ না হয়। সত্যিকথা বলতে কি ইসলাম খুব কম জিনিসকেই হারাম ঘোষনা করছে। যেমন সমুদ্রের সকল মাছ খাওয়াই কিন্তু ইসলামী শরীয়তে হালাল কিন্তু এখন মাছ বলতে কোনটাকে বুঝাবে। এই প্রশ্নের উত্তর ইসলাম জেলেদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। জেলেরা সমুদ্রের যে সকল মাছকে হিংস্র মাছ বলবে এই জাতীয় মাছ ছাড়া আর সকল মাছ খাওয়াই হালাল।
আচ্ছা এখন আমরা দেখি যদি একটা লোক তার ১ম স্ত্রীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ২য় বিয়ে করে তাইলে এর পরে তার বৈবাহিক জীবনটাকে কীভাবে চালাবে। গ্রাম এলাকায় এক সময় যৌথ পরিবার বা join Family এর প্রচলন ছিল। বাপ চাচারা একসাথে থাকতো একই হাড়িতে ভাত রান্না হত। যদি কোন ব্যক্তি ২য় বিয়ে করেই ফেলে তাইলে অবশ্যই তাকে তার ২ স্ত্রীকে ১ম স্ত্রীর সাথে একই ছাদের নিচে থাকতে হবে অর্থ্যাৎ join Family এর মত। আমাদের দেশে দেখা যায় যেই স্বামী ২য় বিয়ে করে সে শুধু তার যৌবণবতী স্ত্রীর সাথেই সংসার করে। আর ১ম স্ত্রীর সংসারে মাসে ১ বার যায়, মাত্র ২-৩ দিন থাকে। ফলে তার ১ম স্ত্রীর ছেলে মেয়েরাও পিতাকে ঐরকম ভাবে কাছে পায় না। অর্থ্যাৎ ধরেন ঐ ব্যক্তির যৌবণাবতী স্ত্রী থাকে মিরপুরে আর বিগত যৌবনা ১ম স্ত্রী থাকে রামপুরায়। দেখা যায় যে স্বামী ব্যক্তিটি মাসের ২৫ দিনই যৌবণবতী স্ত্রীর সাথে মিরপুরে থাকে আর মাসের ৫ দিন রামপুরায় যেয়ে বিগত যৌবনা ১ম স্ত্রীর সাথে থাকে। যা একটা সুস্পষ্ট হারাম কাজ। কিন্তু স্বামী ব্যক্তিটি যদি মাসের ১৫ দিন ১ম স্ত্রীর সাথে থাকে আর মাসের বাকী ১৫ দিন ২য় স্ত্রীর সাথে থাকে এবং টাকা পয়সা ভালবাসা উভয় স্ত্রীর সংসারেই সমান ভাবে ব্যয় করে তাইলে ঐ ব্যক্তির ২য় বিয়ে করা জায়েজ হবে। আর স্বামী যদি শুধু যৌবণবতী স্ত্রীর সংসারেই বেশি সময় ও টাকা পয়সা দেয় তাইলে কোরআন হাদীস অনুসারে ঐ ব্যক্তি তার মৃত্যুর পর সরাসরী জাহান্নামে চলে যাবে। এখন সে দুনিয়ার জীবনে যত নামায-কালাম-হজ্জই করে থাকুক না কেন উভয় স্ত্রীর হক সঠিক ভাবে পালন না করার কারনে মৃত্যুর পর সে নিশ্চিত জাহান্নামী।
আল-কোরআনে পুরুষদের বহু বিবাহ নিয়ে যে আয়াতটি এসেছে সেটা হল- “তবে নারীগণের মধ্য থেকে মনমতো বিয়ে করে নাও দুইটি,তিনটি অথবা সর্বোচ্চ চারটি;আর যদি আশংকা করো তাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করতে পারবে না তাহলে শুধুমাত্র একটাই।”(নিসা ৪:৩) এখন আমরা যদি আল-কোরআনের আরেকটি আয়াতের দিকে লক্ষ্য করি সেইখানে বলা হয়েছে- “তোমরা ইচ্ছে করলেও স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায় এবং সমতা সাধন করতে পারবে না।”(নিসা ৪:১২৯) অর্থ্যাৎ পুরুষদের বহু বিবাহ করার যে প্রধান শর্ত
স্ত্রীদের মাঝে সমতা রক্ষা করা আসলে এটা একটা খুব কঠিন কাজ। এই ২ টি আয়াত থেকে কিন্তু আমরা স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পাই যে পুরুষদের কে একটি বিয়ে করতেই ইসলাম উৎসাহ দিচ্ছে।
এখন কেউ যদি বলে আমার ২য় বিয়ে করার পর আমি এইভাবে সংসার চালাত পারবো না বা উভয় স্ত্রীর মাঝে আমার সময়, অর্থ, ভালবাসা সঠিক ভাবে ব্যয় করতে পারবো না তাইলে ঐ ব্যক্তির ২য় বিয়ে করা জায়েজ হবে না। এখন ঐ ব্যক্তি যত ধনীই হোক না কেন বা যত বীর্যবান পুরুষই হোক না কেন। [ তথ্যসূত্রঃ হানাফী মাযহাবের মূল ফিকাহের কিতাব হেদায়া, ইমাম বুরহান উদ্দিন আলী ইবনে আবু বকর রহমাতুল্লাহ আলাহি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ]
ইসলামের ১ম যুগে প্রচুর জিহাদ হইছিল। তখন অনেক নারীই বিধবা হয়েছিলেন। তাই সাহাবীরা বাধ্য হয়ে বহু বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সাহাবীরা বহু বিবাহ করতে উম্মাহ কে উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাবেইনদের সময়ে বহু বিবাহ টা কমে আসে।
ভারতবর্ষে যার মাধ্যমে লাখ লাখ হিন্দু মুসলমান হয়েছিলেন, অনেক সাধারন মুসলমান যার মাধ্যমে এহসানের পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন সেই খাজা মহীউদ্দিন চিশতী রহমাতুল্লাহ আলাইহি জীবনে মাত্র ১টি বিয়ে করেছিলেন। ওলী কুলের শিরোমনী বায়েজীদ বোস্তামী রহমাতুল্লাহ আলাইহিও উনার জীবনে মাত্র ১টি বিয়ে করেছিলেন। শাহজালাল রহমাতুল্লাহ আলাইহি তো জীবনে বিয়েই করেননি। [ তথ্যসূত্রঃ তাযকিরাতুল আউলিয়া, এমদাদিয়া লাইব্রেরী ]
ইসলাম কখনই পুরুষদের কে বহু বিবাহ করতে উৎসাহ দেয় নি বরং ইসলাম পুরুষদের কে এক স্ত্রীর মাঝেই সন্তুষ্ট থাকতে বলেছে। আর তাছাড়া ইসলামের বহু বিবাহের পর বৈবাহিক জীবনের শর্ত গুলি এত জটিল যে খুব কম মুসলমানের পক্ষেই সম্ভব ২ টি বিয়ে করা। আপনি হয়ত বলতে পারেন যে স্বামী যদি তার ১ম স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ২য় বিয়ে করে। এর উত্তরে আমি বলব যুক্তিযুক্ত কোন কারন ছাড়া বা ১ম স্ত্রীর কোন গুরুতর অন্যায় ছাড়া শুধু ২য় বিয়ে করার জন্য কেউ যদি তার ১ম স্ত্রীকে তালাক দেয় তাইলে তার এই বিনা কারনে ১ম স্ত্রীকে তালাক দেয়ার জন্য মাযহাব ভেদে ঐ স্বামী কে ৪০-৮০ টি বেতের বারি দেয়া হবে। [তথ্যসূত্রঃ ফতোয়ায়ে আলমগিরী] আর কেউ যদি ২য় বিয়ে করেই তাইলে এক্ষেত্রে ইসলাম তাকে উৎসাহ দেয় সে যেন সমাজের কোন অসহায় বিধবা বা তালাক প্রাপ্তা নারীকে বিয়ে করে যেই নারীকে সমাজের কেউ বিয়ে করতে চাচ্ছে না। কিন্তু ঘরে যৌবণবতী সন্তান দায়িনী স্ত্রীকে রেখে তরতাজা ২৪ বছরের আমেরিকান নাগরিকত্ব ধারী কোন মেয়েকে বিয়ে করবে আর এই জাতীয় বিয়ে করার ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়াহ কখনই উৎসাহ দেয় না।
আমরা জানি ইউরোপ আমেরিকার মানুষদের যৌণ চাহিদা খুব বেশী। Sex industry নামে ইউরোপ আমেরিকায় বিশাল বাজার আছে। ইউরোপ আমেরিকার প্রত্যেক টা ব্যক্তি তার জীবনে বান্ধবী, বন্ধুর স্ত্রী, যৌণ কর্মী, লিভ টুগেদার এরকম ভাবে মিলিয়ে গড়ে ৮-১০ টা নারীর সাথে সম্পর্ক করে কোন সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়াই। এত মেয়েদের সাথে একটি পুরুষের এই সম্পর্ক গুলি চলতে থাকে ঘরে বৈধ স্ত্রী রেখেই। মূলত এই বহু বিবাহ প্রথাটা দরকার ইউরোপ আমেরিকার জনগনের জন্য।
ইসলামী আক্বীদা সংশোধনের জন্য আরো পড়তে পারেন
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বহু বিবাহ প্রসঙ্গে ইসলাম বিদ্বেষীদের সমালোচনার জবাব
বনী কুরায়জা গোত্রের সকল পুরুষ ইহুদি হত্যা করা প্রসঙ্গে একটি পর্যালোচনা
ইসলামি শরীয়াহ কি কখনই দাস দাসী প্রথাকে সমর্থন করেছিল
স্টালিনের নৃশংসতার স্বীকার এক বাঙ্গালী বিপ্লবী
মাওসেতুং এর সময় চীনা মুসলমানদের দূর্দশতার কথা শুনুন
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ১২:৩১