খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট প্রস্তাব পাঠালেন যে আমার অর্থ সম্পদ নিয়ে যান, সিরিয়া যেয়ে বাণিজ্য করুন যা মুনাফা হবে তার একটা অংশ আমি আপনাকে দিব। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রস্তাব টি গ্রহন করলেন। যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিরিয়া সফরের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন সেই সময় খাদিজা রাযিআল্লাহু আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রাত্যহিক কাজ কর্মে সাহায্য করার জন্য উনার স্বীয় ক্রীতদাস মায়সারাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে দিয়েছিলেন। সেই যুগে ক্রীতদাসদের সাথে কিরকম ব্যবহার করা হত ? ইসলাম পূর্ব যুগে ক্রীতদাসদের অবস্থা ছিল এরকম যে গালিগালাজ ছাড়া মনিবরা তাদের সাথে কোন কথাই বলত না। মারপিট, প্রহার, চাবুক দ্বারা পেটানো, লাত্থি, উষ্টা এমনকি পান থেকে চুন খসলেই মনিব কর্তৃক দাসদের কে নির্মম ভাবে হত্যা করা ছিল সেই যুগে সাধারন ব্যাপার। কিন্তু খাদিজা রাযিআল্লাহু আনহার ক্রীতদাস মায়সারা দেখতে পেল যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো তাকে তার নাম ধরে ডাকছেন না। ক্রীতদাস মায়সারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর চেয়ে বয়সে বড় ছিল। তার কোন ভূল ভ্রান্তিতে তাকে প্রহার করা তো দূরের কথা তাকে কোন কটু কথাও বলছেন না। যখন কোন কাজ তার দ্বারা করাচ্ছেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও সেই কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। যেমন জ্বালানীর জন্য লাকড়ী সংগ্রহ, অগ্নি প্রজ্জলন, মালামাল উঠানো নামানো এরকম সকল ছোট বড় কাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্রীতদাস মায়সারার সাথে একসাথে কাজ করছেন। এমনকি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উট বা ঘোড়ার পিঠে আরোহন করছেন তো তাকেও সাথে করে আরোহন করিয়েছেন। সেই যুগে দাসদের খাবার ছিল মনিবের উচ্ছিষ্ট বা ঝুটা। কিন্তু ক্রীতদাস মায়সারা দেখলো খাবারের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে হাত ধরে নিজের কাছে বসিয়ে একই পাত্র থেকে খাবার খেতে বলছেন। এমনিভাবে সবকিছুতেই মনিব দাসের সমান অধিকারের ব্যবহার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করে দেখিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ! এই ছিল নবুয়্যতের পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। নবুয়্যতের পরেও বা খায়বরের যুদ্ধ ও মক্কা বিজয়ের পরেও কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনযাত্রা একেবারেই সাধাসিধে ছিল।
ক্রীতদাস মায়সারা দেখল দুপুরের খাবারের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভ্যাস বশত কোন বৃক্ষের নিচে ঘুমিয়ে পড়লেন। ক্রীতদাস মায়সারা লক্ষ্য করল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বৃক্ষের ছায়ায় ঘুমিয়ে যেতেন এর কিছুক্ষন পর সূর্য ঢলে যেত, তখন তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর রোদ পড়ার কথা, কিন্তু ঐ বৃক্ষ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর রোদ লাগতে দিত না। বৃক্ষটি নিজের দিক পরিবর্তন করে নিত এবং ঝুঁকে যেত এবং তাতে করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ছায়া বাকী থাকত। এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন দুপুর রোদে সিরিয়ার রাস্তায় হাটতেন তখন আকাশের পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিন কোথাও কোন মেঘের নাম গন্ধ নেই কিন্তু ছোট এক টুকরা মেঘমালা তার নিজস্ব গতিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ছায়া দিতে দিতে এগিয়ে চলছে। কখনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর রোদ লাগতে দিত না। সিরিয়ায় ব্যবসা করার সময় ক্রীতদাস মায়সারা লক্ষ্য করল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন পণ্যের সাথেই ভেজাল মিশাচ্ছেন না। অর্থ্যাৎ দুধের সাথে কখনই পানি মিশাচ্ছেন না। এমনকি কোন পণ্য বিক্রি করার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পণ্যের ক্রেতাকে ঐ পণ্যের দোষ ত্রুটি ঠিকই উল্লেখ করে দিচ্ছেন। আর তখন ঐ পন্যটি কিনতে আসা ক্রেতা ব্যক্তিটি অবাক হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে তাকিয়ে থাকত। সুবহানাল্লাহ!
অতঃপর সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পর খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার ক্রীতদাস মায়সারা স্বীয় মনিব খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে উচ্ছসিত প্রশংসা করল।
ক্রীতদাস মায়সারার নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যক্তিগত আচার ব্যবহার ভালভাবে জানার পর খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা কে জিজ্ঞাস করেন কিভাবে এই বিয়ে হবে। তখন খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলেন- “ আপনি স্বীয় চাচা আবু তালিবকে বলুন, তিনি যাতে আপনার সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। তখন আমি এই প্রস্তাব গ্রহন করে নিব। ” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় চাচা আবু তালিবকে বললেন- “ আপনি আমার বিয়ে খাদিজার সাথে করিয়ে দিন। ” তখন প্রতিউত্তরে আবু তালিব বলে- “ বৎস! খাদিজা খুবই অহংকারী। খাদিজার আগে ২ বার বিয়ে হয়েছিল। এমনকি ঐ ঘরে তার সন্তান সন্ততিও আছে। মক্কার এমন কোন সর্দার নেতা নেই যে খাদিজার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায় নি। কিন্তু খাদিজা এই সব বড় বড় সর্দার কে অপমান করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এদিকে তুমি এতিম। আর আমাদের তো তেমন কোন অর্থ সম্পদও নেই। আমি খাদিজার কাছে তোমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব কিন্তু খাদিজা তো আমাকেও অপমান করে ঘর থেকে বের করে দিবে ? কি লাভ যেয়ে ? ”
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় চাচা আবু তালিবকে বললেন- “ আপনি গিয়েই দেখুন না। ” সুতরাং আবু তালিব খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার কাছে যেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে উচ্ছসিত প্রশংসা করল। খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা তো নিজেই আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন। খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেল। খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার সাথে বিয়ের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বয়স ছিল ২৫ বছর আর খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার বয়স ছিল ৪০ বছর। খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা দু দু বার বিধবা হয়েছিলেন। কয়েক সন্তানের মা ছিলেন। তাকেই প্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিয়ে করেন। খাদিজাকে বিয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আর্থিক সমস্যার পুরাপুরি সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু খাদিজার সকল সহায় সম্পত্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নব্যুয়ত পূর্ব ও পরবর্তী জীবনে মক্কার গরীব দুঃখীদের মাঝে দান করে দিয়েছেন।
নব্যুয়তের ৭ম বর্ষে হযরত ওমর রাযিআল্লাহু আনহু ইসলামে দীক্ষিত হন এবং ইসলাম বেশ ভাল একটা শক্ত অবস্থানে আসে। তখন মক্কার সকল গোত্ররা একত্রিত হয়ে একটি লিখিত চুক্তিনামা করে যে তারা কেউ বনু হাশেম গোত্রের সাথে কোন লেনদেন ক্রয় বিক্রয় করবে না। এমনকি বনু হাশেম গোত্রের কারো সাথে কেউ কোন কথা বার্তা ও সামাজিক সম্পর্কও রাখবেনা। সেই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনু হাশিম গোত্রের সকলকে নিয়ে কাবার পার্শ্ববর্তী নিজেদের মহল্লা ছেড়ে একটু অদূরেই শাব-ই আবু তালিব বা আবু তালিব গিরি উপত্যকায় উঠলেন এবং সেইখানেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন একটানা ৩ বছরের জন্য।
শাব ই আবু তালেবের এই ৩ বছর সাহাবীদের কে ঘাস পাতা গাছের পাতা, শুকনা চামড়া, এই গুলি খেয়ে জীবন ধারন করতে হয়েছিল। সাহাবীদের ছেলে মেয়েরা ক্ষুধার জ্বালায় চিৎকার করে কাঁদত। খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার উপর কিন্তু কুরাইশদের এই অবরোধ টা ছিল না। কিন্তু খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা স্বেচ্ছায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে একটানা ৩ বছর নিজের পাকা বাড়ি ছেড়ে আবু তালিব গিরি উপত্যকায় পড়ে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা খেয়েছেন খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা তাই খেয়েছিলেন। কিন্তু খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা চাইলেই পারতেন আবু তালিব গিরি উপত্যকা ত্যাগ করে নিজের পাকা বাড়িতে বিলাস বহুল জীবন যাপন করতে। নব্যুয়তের ১ম জীবনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে যখন মক্কার কাফেররা পাগল-কবি-যাদুকর বলে আখ্যায়িত করা শুরু করেছিল তখন খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা সুষ্পষ্ট ভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নব্যুয়তের সাক্ষী দিয়েছিলেন। দ্বীন ইসলামের সাথে খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার সম্পর্কটা কি রকম ? মা যেমন শিশুকালে বাচ্চাকে নিজের হাতে কোলে-পিঠে করে মানুষ করে ঠিক তেমনি খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহাও ইসলামের প্রাথমিক যুগে দ্বীন ইসলামকে উম্মুল মুমেনিন হিসাবে নিজের হাতে বড় করেছেন। তবে খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্নিত হাদীসের সংখ্যা খুব কম। কারন ইসলামের মেয়েলী বিধি বিধান গুলি সবচেয়ে বেশী নাযিল হয়েছিল মাদানী জীবনে। কিন্তু খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা মক্কী জীবনেই নব্যুয়তের ১০ম বর্ষে ইন্তেকাল করেন। মক্কার প্রাচীন কবর জান্নাতুল মালায় খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার দাফন হয়। উনার কবরের চিহ্ন এখনও বিদ্যমান আছে।
[ তথ্যসূত্রঃ প্রিয় নবীজীর প্রিয় প্রসঙ্গ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, মদীনা পাবলিকেশন্স, ৩৮/২ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০ ]
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:৪৯