ডিটেক্টিভ প্রদোষ চন্দ্র মিত্র উরফে ফেলুদার সাথে আমার পরিচয় আজ থেকে তেরো বছর আগে ঠিক এরকম সময়েই । মানে বর্ষাকালে । জুন-জুলাই ২০০২ । হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল সেই দিন । আনন্দমেলার স্পেশাল সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল ‘শেয়াল দেবতার রহস্য’ । আমি আনন্দমেলা কিনে শার্টের নিচে ঢুকিয়ে ভিজতে ভিজতে বাড়ি এসেছিলাম। এসেই পড়তে শুরু করি ফেলুদা । পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম বটে কিন্তু তারপর আর পড়ায় হয়নি ফেলুদার রহস্য কাহিনী । ব্যাপারটা ভেবে সত্যিই হজম হয় না ।
এরপর মাধ্যমিকের সময় পেলাম ব্যোমকেশ বক্সিকে । আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ব্যোমকেশ সমগ্র কিনে পড়তে থাকলাম আর মুগ্ধ হতে থাকলাম । এতটাই মুগ্ধ হলাম যে অন্য গোয়েন্দার প্রতি কোন টান-ই থাকল না । পরে ফেলুদার উপর করা সন্দীপ রায়ের মুভি গুলো দেখলাম । সব্যসাচী ফেলুদার ভুমিকায় । একটু ইন্টারেস্ট বাড়ল । তার অনেক দিন পর বইয়ের দোকানে আনন্দ পাবলিশার্সের ‘ফেলুদা সমগ্র’ দেখলাম । দু খন্ড । দাম হাজার টাকা । নিলাম ।
শুরু হল ফেলুদা পড়া । প্রথম দু-একটি গল্প পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল । কারন ফেলুদাকে নিয়ে যত মাতামাতি হয় তার জন্য ঐ গল্পগুলো যথেষ্ট নয় । বাদশাহী আংঠি প্রথম হেব্বি লাগল । মনে হল আহা! এই না হলে আডভেঞ্চার। তারপর সোনার কেল্লা মাথা ঘুড়িয়ে দিল । মছলি বাবা মানে জয় বাবা ফেলুনাথের তো জবাবই নাই । ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা আর গোঁসাইপুর সরগরম এর তুলনা কোন রহস্য গল্পের সাথেই হয় না । এভাবেই আমি ধীরে ধীরে ফেলুদা ভক্ত হয়ে উঠলাম ।
ফেলুদা গল্পের প্রধান আকর্ষন আমার কাছে থ্রি মাস্কিটিয়ার্সের উপস্থিতি । মানে ফেলুদা, তোপসে আর জটায়ুর ক্যামেস্ট্রিটা চমৎকার । যে কাউকে ভালো লাগবেই । তিন রকম বয়সের তিনজন । তোপসে হল কিশোর, ফেলুদা যুবক আর লালমোহন গাঙ্গুলী উরফে জটায়ু মধ্য বয়স্ক । এই তিন জনের একেক জন একেক রকমের । জটায়ু চরিত্রটা খুবই ইন্টারেস্টিং । উনি না থাকলে ফেলুদা গল্পে হাসির খোড়াক খুবই কম থাকত । তাই হয়ত সোনার কেল্লার পর এক দুটি গল্পে না থাকলেও বাকি সব গল্পেই জটায়ুর আবির্ভাব দেখা যায় ।
কিছু দিন আগে ‘কলেজ স্ট্রীট’ নামের একটি পুরোনো ম্যাগাজিনে শার্লক হোমসকে নিয়ে প্রবন্ধ পড়লাম । লেখক লিখেছেন বাংলা সাহিত্যে ব্যোমকেশ বাদে সকল গোয়েন্দা লেখকই পাঠককে ভুলিয়ে রেখে চমক দিয়েছেন। ফেলুদার ক্ষেত্রে আদতেই সত্যজিত রায় এমন করেছেন কিনা তা তর্কের ব্যাপার । সেটা বাদ’ই দিই । তবে ফেলুদার গল্প গুলো থেকে অনেক কিছু শিক্ষার আছে । এক একটি গল্প রহস্য আর আডভেঞ্চারের পাশাপাশি ভ্রমন কাহিনীও বটে । সোনার কেল্লায় রাজস্থানের, গ্যাংটকে গন্ডগলে গ্যাংটকের, দার্জিলিং নিয়ে গল্প গুলোই দার্জিলিং-এর, বাদশাহী আংঠিতে লাকনৌর, জয় বাবা ফেলুনাথে কাশি-বেনারসের, যত কান্ড কাঠমুন্ডুতে নেপালের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় । এছাড়া বিভিন্ন বিষয় যেমন প্যারা-সাইকোলজী, টেলিপ্যাথি, সংখ্যা তত্ত্ব, ইতিহাস, সার্কাস প্রভৃতি বিষয়ে অনেক জ্ঞান পাওয়া যায় ।
প্রথম দিকে ফেলুদার প্রতি তেমন আকর্ষন না থাকলেও পরে খুব ভালো লাগতে লাগে ফেলুদাকে । সাথে আবিস্কার করি ফেলুদার সাথে আমারও কয়েকটা অভ্যেস বেশ মিলে যাই । এক, চা খাওয়া । ফেলুদা চায়ের ব্যাপারে খুব বাড়াবাড়ি করে । মানে চা ভালো লাগেই । যেমন গোসাইপুরের গল্পটিতে দেখি ফেলুদা গ্রামে এসেছে বলে নিজে চা পাতা এনেছে । আমিও ঠিক তেমনি । আর যাকিছু যাই হোক কিন্তু চা ভালো লাগবেই । দুই, ফেলুদাকে খাওয়ার পরে ‘মিষ্টি পান’ লাগেই । লাখনৌ হোক বা কাঠমান্ডু পান ছাড়া মুশকিল ! আমারও ঠিক তাই । আর তিন নম্বরটা হল রাতে ঘুমানোর আগে একটু বই পড়ার অভ্যেসটা । এই সাদৃশ্যর কারনে ফেলু মিত্তিরের প্রতি টানটাও আরো বেড়ে গেছে বৈ কি !
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৩৪