somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক অদ্ভুত জাদুকরের কথা

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রিন্সেস নূরজাহানের রঙ্গনৃত্যের রেশ বহুদিন অব্দি বালক কুটিমিয়ার মনে অতৃপ্ত সুখের স্বাদ ছড়িয়েছিল যেমন, উষার পূর্বলগ্নে বটবৃক্ষের অন্ধকারে কল্পিত জন্তুর পদপ্রক্ষেপণ, অতঃপর রূপবতী দুঃখিনী গৃহবধূর ফাঁসিতে ঝুলে অপমৃত্যুর রহস্যোন্মোচন তার মনে এক গভীর বেদনাভাবেরও জন্ম দিয়েছিল। তার এতটুকু জীবনে কত সাধ— যা কিছু অদেখা, অদৃশ্য, অশরীরী, সবই তার কাছে বিপুল রহস্যে ভরা, তাকে দুর্নিবার আকর্ষণে টানে। পার্থিব ভোগবিলাসের বস্তুনিচয়ের চেয়ে অপার্থিব ও আধ্যাত্মিক জগতের রহস্য তাকে খুব বেশি ভাবায়। এক রাতে সে তার মার সাথে প্রসাব করতে বাইরে বেরিয়েছিল। আকাশে ধবধবে পূর্ণিমা, দিনের আলোর মতো চারদিকে জোছনা খলখল করছিল। কার্তিকের সেই রাতে বাড়ির উত্তরে আমন ধানের নাড়ার সমুদ্রে তাকিয়ে কিশোর কুটিমিয়ার মন মুহূর্তে চঞ্চল হয়ে উঠলো— এত্ত আলো! হঠাৎ সে অবাক হয়ে দেখে—সেই ধবল জোছনায় কে এক বৃদ্ধা ধানক্ষেতের আলের কাছে পশ্চিমমুখি হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে। তার পরনের শাড়িটিও জোছনার মতো ধবল ও ফরসা— সামনে সামান্য কুঁজো হয়ে, বুকের ওপর দু হাত জোড়াবন্ধ, স্বল্প ঘোমটা টেনে, কোনোমতে বোঝা যায় পাশের বাড়ির মনুর মা বুড়ির মুখটা। কিন্তু মনুর মা ওখানে কেন? তার ভাঙ্গা ঘর খালি পড়ে আছে। এত রাতে কেউ চকে যায়? শুধু তাই নয়, চকে গিয়ে সে নামাজে দাঁড়িয়ে। রহস্য কী? নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে কুটিমিয়া মাকে বলে ওঠে, ‘মা দ্যাক, মনুর মা বুড়ি। ক্ষেতের মধ্যে নামাজ পড়তেছে!’ হঠাৎ তার মা এসে উঁকি দেয় এবং এক পলক দেখেই ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলে কুটিমিয়ার হাত ধরে ছোঁ মেরে ঘরে নিয়ে যায়—কালিমা পড়ে কুটিমিয়ার বুকে থুথু ঘষে দেয়, মুখে ফুঁ দিয়ে দেয়।

বালক অবাক হয়। তার মনে কোনো ভয় নেই, তবু সে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘মা, মনুর মা বুড়ি এত রাইত্রে চকে ক্যানরে?’
মা তাকে আরো শক্ত করে বুকে জড়িয়ে বলে, ‘আল্লাহ তুই পানা দে, বালা মুসিবত দূর কর আল্লা।’
কুটিমিয়া মাথা সোজা করে মায়ের মুখের দিকে মুখ করে বলে, ‘কী অইছে মা?’
‘কিছছু না সুনা। ঘুমা। দিনে কমুনে।’
দিনের বেলা মা তাকে কিছুই বললো না, কুটিমিয়ারও সে-কথা মনে পড়ে নি। কিন্তু রাতের বেলা সহসা মনে পড়ে যায়, আর মুহূর্তেই ভয়ে তার সর্ব-শরীরে জাড়কাটা দিয়ে ওঠে—গত রাতে যাকে চকে নামাজ পড়তে দেখেছিল, আসলে সে মনুর মা বুড়ি নয়—মনুর মা সেই কবে মারা গেছে, গ্রামের গোরস্থানে তাকে কবর দেয়া হয়েছে- সে আসবে কোথা থেকে? ওটা মনুর মার ছল ধরে অন্য কেউ এসেছিল।

কোথায় যেন পরীর রাজ্য, জিনের রাজ্য! কেউ বলে তা অনেক দূরের আসমান পেরিয়ে। পরীদের গায়ে রূপ ঝলমল করে। অন্ধকার আকাশ জুড়ে যখন অগুনতি তারার ফুল ফোটে, রূপের পরীরা তখন আকাশময় উড়ে বেড়ায়, ছুটে বেড়ায়। নিজ্‌ঝুম নিশীথে বনবনানির চূড়ায় চূড়ায়, গাছগাছালির শাখায় শাখায় জোছনা ঢেউ খেলে যায়, ফুলের গন্ধে ফুলের সুষমায় তামাম পৃথিবী আনন্দোদ্বেলিত হয়ে উঠলে পরীরা মর্তে নেমে আসে। তারা ফুল কুড়িয়ে অঙ্গে সৌরভ মাখে, ফুলবিছানো পথে নরম পায়ে হাঁটে। হাত ধরাধরি করে নাচে। খলখল করে হাসে— মানুষের গন্ধ পাওয়া মাত্র বাতাসে মিলিয়ে যায়। কুটিমিয়া ভাবতো, তার হাতে যদি এমন একটি সোনার কাঠি থাকতো, ইচ্ছে হলেই পরীর পাখায় ভর করে উড়ে যেতো আসমানের পর আসমান ভেঙ্গে দূরের পরীর রাজ্যে। পাখিদের মতো যদি উড়তে পারতো, যদি তার দুটি ডানা থাকতো, যদি থাকতো একটি পঙ্খিরাজ ঘোড়া— সেই কাঠিটা একটা তারার দিকে তুলে ধরলে তারাটি খসে বাঁশপাতার মতো ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে নেমে আসে— একটা ফণাতোলা ধারাস সাপের দিকে তাক করলে মুহূর্তে ওটা একটা লতাগুল্ম হয়ে যায়— আরো কতো কী! ঐ কাঠিটি হাতে নিয়ে সে পাষাণ ফকিরের মতো পানির ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে নদী-মহাসমুদ্র পার হয়ে চলে যেতে পারে অজানা সন্ন্যাসে।

একবার এক শীতের দুপুরে সে আর নুরু শিমের মাচানে ছোট্ট এক বাসা থেকে টুনটুনির ডিম পাড়ছিল। হঠাৎ দেখে অল্প দূরে এক রক্তচোষা তক্ষক ঘাড় উঁচিয়ে গলগল করে রক্ত খাচ্ছে। তার সমস্ত গণ্ডদেশ রক্তে বিকটবর্ণ। নুরুকে ইশারা করতেই সে একটা ঢিল উঠিয়ে ছুঁড়ে মারে তক্ষকটার গায়ে—ওটা মাটিতে পড়ে কিছুক্ষণ ছটফট করে মারা যায়। দুজনে ঝুঁকে পড়ে চোখের সামনে তক্ষকের মরে যাওয়া দেখে। কিন্তু আশ্চর্য, তক্ষকটার মুখ থেকে এক ফোঁটাও এতক্ষণ চুষে নেয়া রক্ত ঝরলো না। এ ঘটনা তার মনে দাগ কেটেছিল। তক্ষকরা মানুষ দেখলেই দূর থেকে অলক্ষে নাভির গোড়ায় দীর্ঘ ও অদৃশ্য শুঁড় বসিয়ে রক্ত চুষতে শুরু করে। তক্ষকটাকে কেউ যদি না দেখে, ঐ মানুষটি আর বাঁচে না। কুটিমিয়ার ভাগ্য ভালো, তক্ষকটাকে দেখতে পেয়েছিল।
কুটিমিয়া ভাবতো, এমন একটা সোনার কাঠি যদি তার হতো, কোনোদিন কোনো তক্ষক তার শরীরের রক্ত চুষতে পারতো না।
দাদির কাছে সে গল্প শোনে— কোনো এক অতীতকালে কোনো এক মাছ ইউনুছ নবীকে গিলে খেয়েছিল। কুটিমিয়ার মন ভীষণ চঞ্চল হয়ে ওঠে বাসনায়। মহানবীর ইশারায় রাতের পূর্ণ চাঁদ দু ভাগ হয়ে গিয়েছিল— সেই অলৌকিক রহস্য তার মনকে প্রচণ্ড দোলা দিয়ে যায়। বাবার মুখে সে আনাল হকের গল্প শুনেছে। কী এক আশ্চর্য খোদাপাগল ধ্যানী মহামানব সেই আনাল হক ছিলেন— তাঁকে কাঠের আগুনে পুড়িয়ে ছাই করা হলো— সেই ছাই নদীতে ফেলা হলো— আনাল হকের শরীরের প্রতিটি ভাসমান ছাইকণা সমস্বরে সুরধ্বনি তুললো— ‘আনাল হক! আনাল হক! আনাল হক!’ কী করে বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানি (রাঃ) মাতৃগর্ভে থেকেই আঠার পারা কোরআন মজিদ মুখস্থ করে ভূপৃষ্ঠে পদার্পণ করেছিলেন! হাশরের দিন পাহাড়গুলো তুলোর মতো উড়তে থাকবে। সূর্য নেমে আসবে মাথার ওপরে। বালক কুটিমিয়া এসব শোনে আর সতত গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে।
তার আর কিছু ভালো লাগে না— মনে হয় যা কিছু সে দেখে, তা অতি সাধারণ; সাদামাটা; স্বাদগন্ধ-রহস্যহীন কোনো কিছুতেই তার মন ভরে না।
কুটিমিয়ার বাবা প্রায়ই এক জাদুকরের গল্প বলেন। ভীষণ আজব সেই জাদুকর, আর তার জাদু। মাটির ওপর সটান শুইয়ে দেয়া হয় দশ-বার বছরের এক বালককে, তারপর গায়ের ওপর বিশাল এক চাদর বিছিয়ে ঢেকে দেয়া হয় তার পুরো শরীর। জমকালো এক বাক্স থেকে বের করা হয় ঝলসানো এক তরবারি; হাতের বিচিত্র কৌশলে বাতাসে সাঁই সাঁই করে কয়েকবার সেই তরবারি ঘোরায়, তারপর চাদরের কোনা উঁচু করে জাদুকর ঢুকে যায় ভিতরে। উপস্থিত দর্শকগণের উদ্দেশে অনবরত তার জবান চলতে থাকে— ‘কেওই নড়বেন না, ঝিম ধইরা দাঁড়াইয়া থাকেন। পায়ের আঙ্গুল গাইড়া দাঁড়াইয়া থাকেন। একচুল নড়লে অমঙ্গল ঘইডা যাইব। এই পুলাডা আর কুনুদিন উঠবো না।’ এসব বলতে বলতে জাদুকরের গলা ধরে আসে, তারপর আল্লাহু আকবর বলে শুয়ে থাকা বালকের গলার ওপর চালিয়ে দেয় তরবারি। সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়বিদারক বিকট চিৎকারে বালক মাটি কাঁপিয়ে তোলে, দু হাতে দড়াম দড়াম করে নিজের বুকের ওপর ঘুষি ঝাড়তে থাকে, পা আছড়ে ছটফট করতে থাকে। এরপর গলার ঘর্ঘর শোনা যেতে থাকে। ধড় থেকে একটানে মুণ্ডুটি সরিয়ে নিয়ে যায় চাদরের আরেক কোনায়, বিচ্ছিন্ন মাথা থেকে অনর্গল মা-মা আর্তস্বর বের হতে থাকে। ধীরে ধীরে জাদুকর চাদরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে, তার সর্বাঙ্গ প্লাবিত, হাতের চকচকে সাদা তরবারিখানা রক্তে জবজবে। মানুষ মানুষের রক্ত সহ্য করতে পারে না। জাদুকরের শরীরে ও তরবারিতে রক্ত দেখে অনেকে সংজ্ঞা হারায়। অনেকে চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে হাত-পা নাড়ায়, এবং মুহূর্তেই ভূপতিত হয়। খেলা দেখানোর শেষ পর্বে জাদুকর আবার চাদরের ভিতরে ঢোকে, সবেগে মন্ত্রপাঠ করতে থাকে, বিচ্ছিন্ন মাথাটাকে ধড়ের কাছে এনে জোড়া লাগিয়ে দেয়, বেরিয়ে এসে একটানে চাদরটি সরিয়ে ফেলে। মানুষ তখন অবাক হয়ে দেখে ক্লান্ত অবসন্ন দেহে ছেলেটি আধমড়ার মতো মাটির ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, তার গলার কাছে রক্তের নদী। গলার রক্ত মুছে দিয়ে দুর্বলশরীর ছেলেটিকে জাদুকর আস্তে হাতে দাঁড় করায়, নিজের বাহুতে জড়িয়ে চারদিকে ঘুরে দর্শকগণকে তার গলা দেখায়, সেখানে একটি সরু রেখা, যে-রেখা বরাবর তার মাথাটিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল।
এ ছেলেটি জাদুকরের নিজের লোক হতে পারে— হতে পারে তার ছোটো ভাই বা আপন পুত্র। দর্শকসারি থেকেও উৎসাহী কাউকে ডেকে এ সাহসী জাদুটি দেখানো হতে পারে। কিন্তু কুটিমিয়া কিছুতেই মিলাতে পারে না— চাদরের উপর থেকে স্পষ্ট বোঝা গেলো— গরু জবাইয়ের মতো জোরে ছেলেটির গলা চেপে ধরে নির্মমভাবে তরবারি চালিয়েছে কসাই জাদুকর— তারপর দেহ থেকে মস্কক আলাদা করে ফেলেছে। সেই খণ্ডিত মস্তক কীভাবে জোড়া লাগালো তা ভেবেই অস্থির হয়ে উঠলো কুটিমিয়া।
এই জাদুকরের একটা কাহিনি আছে, যার সাথে জড়িয়ে আছে এক সাহসী ছেলের করুণ পরিণতি। গালিমপুরের সিদ্ধী পীর সাহেবের ওরস মোবারকে একবার এই জাদুকর তার অলৌকিক জাদু দেখিয়ে মানুষকে তাক লাগিয়ে দিল। দর্শকগণকে বড্ড এক প্রলোভন দেখিয়ে সে বলেছিল, যদি কোনো সাহসী যুবক তার তরবারির নিচে মাথা পাততে রাজি হয়, জাদুকর তাকেই তার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে সমস্ত জাদুবিদ্যা দান করবে।
দুপুরের ঝাঁঝালো রোদে মানুষ নিরুত্তর ও নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলো। জাদুকর আবারও তার বরের ঘোষণা করলো— তখনই ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলো এক সুঠামদেহী তেজী তরুণ। তার অসীম সাহসিকতায় মুগ্ধ জাদুকর।
সে এক অত্যাদ্ভুত জাদু প্রদর্শনী ছিল। চাদরের নিচে শায়িত অমিত সাহসী তরুণ যুবা জাদুকরের তরবারিতে দ্বিখণ্ডিত হবার প্রাক্কালে গগনভেদী চিৎকারে চতুর্দিক প্রকম্পিত করলো। তার দেহটি জবাই করা গরুর মতো ছটফট করতে থাকলো— অবশেষে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়লো। দেহ থেকে মাথা সরিয়ে চাদরের নিচ থেকে জাদুকর বেরিয়ে আসে। বিধ্বস্ত তার চেহারা, ঘর্মাক্ত সর্বশরীর, দুর্বোধ্য তার মুখাবয়ব, রক্তাক্ত তরবারি ও শরীর। বিরক্তির সাথে তরবারিখানা পাশে ছুঁড়ে ফেলে। মানুষের চোখেমুখে বিস্ময়। জাদুকর তার কোঁচড় খুলে কী যেন বের করে— একটা সুতার গুটি; গুটি খুলে সুতার মাথা শাহাদাৎ আঙুলে জড়ায়, তারপর উর্ধ্ব আকাশের দিকে গুটিটি ছুঁড়ে মারে— সুরসুর করে সুতা খুলতে খুলতে গুটি ওপরের দিকে উঠে যেতে থাকে, বিস্ময়ে মানুষ বাকরুদ্ধ, তারা জানে না ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে পরের মুহূর্তে। অত্যাশ্চর্য ঘটনাটি সহসাই ঘটে গেলো। সুতার মাথা ধরে ঝুলতে ঝুলতে জাদুকর আকাশের দিকে উড়ে গেলো, উড়ে গেলো...বহুদূর আকাশে যাবার পর জাদুকর অদৃশ্যে মিলিয়ে গেলো। তখনই মানুষের চৈতন্যোদয় হলো—চাদর সরিয়ে সবাই আর্তনাদ করে ওঠে—হায়, এ কী দেখছে চোখের সামনে—একধারে দেহবিচ্ছিন্ন শির, অন্যধারে নিস্তেজ শরীর। চোখের সামনে এমন একটা তরতাজা খুন হয়ে গেলো? কেন হলো এমন খুন? জাদুকরের মন্ত্রে কি তাহলে ভুল ছিল? ভুল হয়েছিল? সেই খুনের রহস্য আজও জানা যায় নি।

এমন একজন জাদুকর হওয়ার বাসনায় কিশোর কুটিমিয়া মাঝে মাঝেই বুঁদ হয়ে থাকে। মন্ত্র পড়ে একটা কুকুরের গায়ে ফুঁ দিয়ে ওটাকে একটা পাথর বানিয়ে ফেলা যেতো যদি, এক ফুঁয়ে একটা নদী যদি ধু-ধু মরুভূমি হয়ে যেতো! বাতাসকে যদি নিজের বশে আনা যেতো, আকাশের মেঘ, চাঁদসূর্যকে যদি বশ করা যেতো, এক মন্ত্রে ঝাঁঝাঁ দুপুরে সূর্য ডুবে অন্ধকার রাত্রি হতো যদি, আরেক মন্ত্রে থালার মতো গোল একটি চাঁদ আকাশে ঝলমল জোছনা ছড়াতো!
মাছেরা কীভাবে পানির নিচে বেঁচে থাকে— কুটিমিয়ারও এমন করে বাঁচতে সাধ হয়। পাখির মতো দু পায়ে মাটি ধাক্কা দিয়ে ভূমি থেকে আকাশে উড়াল দেবে, বাতাসে সাঁতার কেটে শূন্যে ভেসে বেড়াবে— কুটিমিয়ার সাধ হয়। কখনো কখনো স্বপ্নের ভিতর একটা দুরন্ত কালো ষাঁড় তার দিকে তেড়ে আসে— নাগালে পাবার আগেই এক লাফে সে শূন্যে উঠে যায়, তারপর পাখিদের মতো মনের আনন্দে উড়তে থাকে। ঘুম ভাঙবার পর তার মন বেদনায় কাতর হয়ে ওঠে।
সোনার কাঠি বা জাদুর কাঠি কোনোদিন পাবে না সে জানতো। তবু খুব ইচ্ছে হতো— যদি এতটুকুন ক্ষমতা পেতো— তার গামছার চার কোনায় চারটি গিঁঠুতে চারটি জিনকে বন্দি করতে পারে, তাতেই অনেক মোজেযা তার হাতের কব্জায় চলে আসতো। জিনরাও নাকি দেখতে মানুষের মতোই। তবে আশ্চর্য হলো, তারাও নাকি মানুষকে দেখতে পায় না। মানুষ যেমন জিনকে ভয় পায়, জিনও তেমনি ভয় পায় মানুষকে। মানুষ যেমন জিনকে বন্দি করতে চায়, জিনও মানুষকে। মানুষের ঘরদোরই জিনদের ঘরদোর। কিন্তু তারাও ভাবে মানুষেরা জিনদের ঘরেই বসবাস করে। মহান আউলিয়া পীর-দরবেশ হলেই তবে জিনকে কবজ করা যায়। তখন জিনকে যা-যা আদেশ করা হয় মুহূর্তে তাই করে ফেলে।

নবাবগঞ্জের গালিমপুরের সিদ্ধী পীর সাহেবের কবজে আছে হাজার হাজার জিন। প্রতি বৎসর কার্তিকের শেষ শুক্রবারে ওরস শুরু হয়, চলে একটানা সাতদিন। মানুষ রূপধারী জিন-মুরিদগণ দিনরাত পীর সাহেবের ভক্তি-খেদমতে আত্মনিমগ্ন হয়— মানুষের মতোই তারা জিকির করে, বাবার পদসেবা করে, হাঁটাচলা করে, খাওয়া-দাওয়া করে; কেবল পীর সাহেবই চিনেন কারা মানুষ আর কারা মানুষের রূপধারী জিন। যে কাজ মানুষের অসাধ্য, পীর সাহেব অনায়াসে জিনদের দিয়ে সে-কাজ সমাধা করেন। কী বিপুল সেই ওরসের আয়োজন— সব কাজই করে দেয় জিনদের দিয়ে করানো হয়।

আড়িয়াল বিলের হাঁটুপানি পার হয়ে দীর্ঘ ৮ মাইল পথ পায়ে হেঁটে সিদ্ধি পীরের ওরসে গেলো কুটিমিয়া আর তার কয়েকজন বন্ধু। সার্কাস, পুতুলনাচ, সাপের খেলা, জাদু ইত্যাদি দেখতে দেখতে রাত গভীর হলো। এক জায়গায় জটলা দেখে তারা সেখানে জড়ো হলো। অনেক বছর আগে পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া এক পাগল- যাকে প্রথম দিন দেখে হ্যামেলিনের বাঁশিঅলা মনে হয়েছিল। এই জটলার এক পাশে একটা দোকানে বিভিন্ন ধরনের পোস্টার বিক্রি হচ্ছিল- যেখানে শেখ ফরিদ, রামকৃষ্ণ এবং ইমাম মাহাদীর হাতের তালুর ছবি ছিল। পাগলের মুখে কথার খই ফুটছে- সুগভীর আধ্যাত্মিক কথা, যা কুটিমিয়ার কচি মগজে ঢোকে না। হঠাৎ হঠাৎ সে চিৎকার দিয়ে ওঠে- ‘এই দুনিয়া ফানা হবে, কিছুই রবে নারে, কিছুই রবে না।’
মহা আশ্চর্য ঘটনাটি হঠাৎ করেই ঘটলো। পাগল তার মাথার পাগড়ি খুলে ফেললো। ডান হাতে মাথার রুক্ষ চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করার মতো পেছনে নিল। মুখের গুচ্ছ গোঁফ আর কালো শ্মশ্রুতে নরম করে হাত বুলিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো- ‘দেখ আমারে, আমারে দেখ- আর দেখ ঐ ছবি।’ বলে সে তার হাতের লাঠি রামকৃষ্ণের ছবির দিকে নির্দেশ করে। মানুষ হতবাক। এ অসম্ভব। এ এক নিছক পাগল, কোনো জাদুকর নয়। মানুষ অবাক হয়ে দেখলো, ছবির রামকৃষ্ণ ঠিক ছবির পাশে দাঁড়িয়ে।
আশ্চর্যের শেষ নেই। পাগল এবার বলে- ‘তোরা খেয়াল কইরা দেখ, আমার চাপদাঁড়ি না হইয়া যদি শেখ ফরিদের মতো খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি হইতো, আমার মুখ কেমন হইত!’ কেবল অবাক হবার পালা। রামকৃষ্ণের চাপদাঁড়ির আড়ালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি অলা একটা মুখ দেখা যায়, যেটি আর কেউ নয়, স্বয়ং শেখ ফরিদের মুখ।
পাগলের গল্প চলতে থাকে। দুনিয়ার সকল পয়-পয়গম্বরের কাহিনি তার ঠোঁটে অনর্গল বের হয়ে আসছে। মানুষ যা প্রশ্ন করে, সব উত্তরই এ পাগলের জানা। দুনিয়ায় কবে রোজ কেয়ামত হবে, সব হিসাব তার জানা। দাজ্জাল কবে কোথায় মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়াবে, হযরত ঈসা কবে পুনরাবির্ভুত হবেন- সব, সব কিছু সে বলে যাচ্ছে। কোনো কোনো পয়গম্বরের উপর তার প্রচণ্ড ক্ষোভ।
যাওয়ার আগে পাগল তার বাম হাত উঁচু করে বলে- ‘এ হাতের রেখাগুলান দেখ- এবার দেখ ইমাম মাহাদীর হাতের তালু।’ মানুষ দুটি তালুতে তাকিয়ে এবারও তাজ্জব হয়ে দেখে- পাগলের হাতটাই যেন ফটো করে ওখানে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে।

কেউ কেউ বলেছে লোকটা জাদুকর। কিন্তু কুটিমিয়ার দৃঢ় ধারনা, সে জাদুকর নয়। আর যদি কোনো জাদুকর হয়েই থাকে, তাহলে সে একজন অলৌকিক জাদুকর, যার বৃত্তান্ত কোনো মানুষের জানা নেই।
বাজারে বা মেলায় বিভিন্ন ধরনের পোস্টার বা ছবি বিক্রির যে দোকানগুলো বসে, সেখানে সচরাচর যে ছবিগুলো সব সময়ই দেখা যায় তা হলো, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মায়ের কোলে শিশু, পঙ্ক্ষিরাজ ঘোড়া, ইত্যাদি। সেখানে আরো যে ছবিটি খুব বেশি দেখা যেতো সেটি হলো শ্রী রামকৃষ্ণের ছবিটি। এমন একটি ছবি সেদিনের মেলার দোকানে ঝোলানো ছিল। ছবির রামকৃষ্ণের মাথায় একটা গাঢ় কালো রঙের পাগড়ি, গায়ে কালো-নীলাভ রঙের কাবুলি পরিয়ে দিলে যে অবয়ব গড়ে ওঠে, সেটিই এই মূর্ত পাগলের ছবি। সে যখন মাথা থেকে পাগড়ি খুলে ডান হাতের স্পর্শে শ্মশ্রুগুচ্ছ বুলিয়ে নিচে নামালো, স্থির ভাবে ছবিতে রামকৃষ্ণের দিকে তাকালো- মনে হলে ঠিক ছবির রামকৃষ্ণ তাঁর পরনের ধুতির বদলে একজোড়া পাগলি পরে আছেন, ছবির রামকৃষ্ণের মতোই তার মুখটি ঈষৎ হাঁ করে, তার ফাঁক দিয়ে ধবল দুটি দাঁত দেখা যায়।

সেই পাগলের সন্ধানে কুটিময়া আজও ঘুরে বেড়ায়। পদ্মার পানিতে ঝাঁপ দিয়ে যে পাগল প্রায় আধঘণ্টা পরে মাঝ নদীতে ভেসে উঠেছিল, তারপর ভাসতে ভাসতে সন্ধ্যার আঁধারের সাথে স্রোতের পানিতে হারিয়ে গিয়েছিল, সেই পাগল এতদিন পরে কোথা থেকে সিদ্ধি পীরের ওরসে এসে আবির্ভুত হয়েছিল!

সেই যে চলে গেলো পাগল, আর এলো না, তার দেখা মিললো না ইহজনমেও।


৩২টি মন্তব্য ৩২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

আমরা সবাই জানি, ইরানের সাথে ইজরায়েলের সম্পর্ক সাপে নেউলে বললেও কম বলা হবে। ইরান ইজরায়েলকে দুচোখে দেখতে পারেনা, এবং ওর ক্ষমতা থাকলে সে আজই এর অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়।
ইজরায়েল ভাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

নগ্ন রাজা কর্তৃক LGBTQ নামক লজ্জা নিবারনকারী গাছের পাতা আবিষ্কার

লিখেছেন মুহাম্মদ মামুনূর রশীদ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪০

LGBTQ কমিউনিটি নিয়ে বা এর নরমালাইজেশনের বিরুদ্ধে শোরগোল যারা তুলছেন, তারা যে হিপোক্রেট নন, তার কি নিশ্চয়তা? কয়েক দশক ধরে গোটা সমাজটাই তো অধঃপতনে। পরিস্থিতি এখন এরকম যে "সর্বাঙ্গে ব্যথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×