তৃতীয় মাত্রায় সামহোয়্যারিন ব্লগে সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক সৈয়দা গুলশান আরা জানা ও ড. সিনহা এম এ সাঈদের মধ্যকার আলোচনাটি আপনাদের জন্য নীচে দিলাম।
সরাসরি এখানেও চলে যেতে পারেন। তৃতীয় মাত্রা
সঠিক সময়ে, সামহোয়্যারইন ব্লগটি বন্ধের ব্যাপারে ব্লগের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দা গুলশান আরা জানা ও লিডারশিপ স্টাডিজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মহোদয় ড. সিনহা এম এ সাঈদের মধ্যে একটি আলোচনা তৃতীয় মাত্রায় তুলে ধরার জন্য চ্যানেল আইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সৈয়দা জানা খুব সাবলীল ভাবেই ব্লগ খুলে দেয়ার ব্যাপারে তার যুক্তি তুলে ধরেছেন। ড. সিনহাকেও সশ্রদ্ধ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যে, বক্তব্যের শেষ প্রান্তে গিয়ে দেশের বিভিন্ন দুর্যোগে ব্লগারদের মানবিক সহায়তামূলক কর্মকাণ্ড, স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে ব্লগারদের ভূমিকা, ড. আনিসুজ্জামান, ড. সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ গুণিজনের ব্লগীয় দিবসে উপস্থিত হয়ে প্রেরণাদায়ক বক্তব্য প্রদানের কথা জানতে পেরে ব্লগ সম্পর্কে তিনি একটা ইতিবাচক ধারণা গ্রহণ করেছেন। জিল্লুর রহমানকেও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা তার দক্ষ সঞ্চালনা ও গঠনমূলক উপসংহারের জন্য।
সামহোয়্যারইন ব্লগ বাংলা ভাষার প্রথম ব্লগ, যা শুধু বাংলাদেশেই না, পৃথিবীর সমস্ত বাংলাভাষাভাষীদের কাছে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। লেখক, সাংবাদিক, মিডিয়াকর্মী নির্বিশেষে অজস্র অনলাইন ব্রাউজার এতে রেজিস্ট্রেশন করে ব্লগিং শুরু করেন। ব্লগ হলো একটা মুক্ত চিন্তার উন্মুক্ত প্লাটফর্ম, যেখানে একদিকে অবিরত সর্বশেষ ঘটনাসমূহ প্রকাশিত হতে থাকে, অন্যদিকে সাহিত্য, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম, গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, দেশীয় সংস্কৃতি, খেলাধুলা, বিনোদন, ব্যবসায়, রাজনীতি ও ধর্মীয় আলোচনা ও সংবাদ পর্যালোচনায় ব্লগ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। জ্ঞান আহরণ ও মত বিনিময়ের জন্য এই ব্লগটি রীতিমতো একটা নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে বাংলাভাষাভাষীদের কাছে। দেশীয় আইসিটি নীতির সাথে সম্পর্ক রেখে এ ব্লগ পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, যার ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট ব্লগারকে যথাযথ শাস্তি, যেমন, নিক ব্যান/ব্লক/স্থগিত করা, কমেন্ট ব্যান, 'নিরাপদ' থেকে 'জেনারেল'-এ নামিয়ে আনা, ইত্যাদি শাস্তি প্রদান করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, প্রত্যেক ব্লগারকেই একটা সুশৃঙ্খল পন্থায় নীতিমালা মেনে চলে ব্লগিং করতে হয়। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যখন একজন ব্লগার এখানে রেজিস্ট্রেশন করেন, শুরুতেই কিন্তু তিনি নিজের লেখা পাবলিশ করা কিংবা অন্যের ব্লগে কমেন্ট করার ক্ষমতা পান না। ২০০৫ সালে যখন ব্লগ প্রথম শুরু হলো, তখন রেজিস্ট্রেশনের সাথে সাথেই একজন ব্লগার অন্যের পোস্টে কমেন্ট করার সুযোগ পেতেন, এবং একটা নির্দিষ্ট সময়/দিন পর নিজের লেখা পাবলিশ করার ক্ষমতা দেয়া হতো তাকে। কয়েক বছরের মাথায় ব্লগের টেকনিক্যাল ডেভেলপমেন্ট হয়, এবং ব্লগ পাবলিশের নীতিমালাও পরিমার্জন করা হয়, যার ফলে একজন ব্লগার রেজিস্ট্রেশন করার পর প্রথমে তাকে 'অবজারভেশনে' রাখা হয়, এই সময়ে তিনি শুধু নিজের ব্লগে লেখা পাবলিশ করতে পারেন এবং সেই লেখায় অন্যের কমেন্টের উত্তর দিতে পারেন। তার অবজারভেশন পিরিয়ডে তার পোস্ট কিংবা কমেন্ট প্রদানের গুণগত মান বিচার করে তাকে অন্যের পোস্টে কমেন্ট করার সুযোগ দেয়া হয়। এতে তার কার্যক্রম 'সন্তোষজনক' বিবেচিত হলে তার পোস্ট প্রথম পাতায় আসার 'অ্যাক্সেজ' দেয়া হয়। যতদিন তার পোস্ট প্রথম পাতায় না আসবে, ততদিন তার পোস্ট অন্য ব্লগারের চোখে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এখানেও দুটো ধাপ আছে- 'জেনারেল' এবং 'নিরাপদ'। 'জেনারেল' থাকাকালীন সময়ে তার ব্লগিং সন্তোষজনক হলে তাকে 'নিরাপদ' ব্লগার হিসাবে প্রোমোট করা হয়। এই 'প্রবেশনারি' পিরিয়ডটা নির্দিষ্ট নয়। এই সময়ে একজন ব্লগারকে মডারেটরদের কাছে আস্থা অর্জন করতে হয়; এই আস্থার মাপকাঠি হলো, তার পোস্ট ও কমেন্টের গুণগত মান, অন্যান্য ব্লগারের সাথে তার সম্পর্ক, ইত্যাদি। যিনি যত দ্রুত এই আস্থা অর্জন করবেন, তিনি তত দ্রুত 'নিরাপদ' ব্লগারে পরিণত হবেন। এমনও হয়ত ব্লগার থাকবেন, যারা বহুকাল আগে রেজিস্ট্রেশন করেছেন, কিন্তু 'নিরাপদ' ব্লগার হিসাবে প্রোমোশন পান নি।
অনেকে নাকি বলছেন যে, এই ব্লগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-পরিপন্থী লেখা প্রকাশ করা হয়। যারা এটা বলেন, তারা নিঃসন্দেহে স্রেফ আন্দাজের উপর এই কথাটি বলেন। আমি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত আমার প্রচুর পোস্ট রয়েছে। এই ব্লগই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে শুরু থেকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে আহুত গণজাগণ মঞ্চে এই ব্লগের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়; এই ব্লগের কারণেই গণ জাগরণ মঞ্চের ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছিল, কারণ, ওখানকার একটা বড়ো অংশ ছিল আমাদের ব্লগারগণ।
বর্তমান সরকার দেশের ভেতরে সমগ্র পর্নো সাইটগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে অত্যন্ত সময়োপযোগী কাজ করেছেন, যাতে দেশের উঠতি প্রজন্ম একটা অন্ধকার জগত থেকে বের হয়ে আসতে সমর্থ হবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমরা জানতে পারছি যে এই নির্মল জ্ঞান-কর্ষণ ক্ষেত্র আমাদের সামহোয়্যারইন ব্লগটিকে তালিকাভুক্ত পর্নো সাইটসমূহের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার ফলে, এটি বর্তমানে কিছু জায়গা ছাড়া সবখানেই ব্লকড অবস্থায় আছে, অর্থাৎ, ব্লগারগণ এখন এখানে ঢুকতে পারছেন না এবং ব্লগিং করতে পারছেন না। এই ব্লগের রেজিস্টার্ড ব্লগারের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এটিকে ব্লক করার আগে যে-কোনো সময়ে অনলাইন বা লগড-ইন ব্লগারের সংখ্যা ২০০ থেকে ৫০০ পর্যন্ত দেখা যেতো, যা এ দেশের অন্য যে-কোনো ব্লগের চেয়ে অনেক গুণ বেশি, ভিজিটরের সংখ্যাও পাওয়া যেত ১৫০০ থেকে ৫০০০ পর্যন্ত (স্মৃতি থেকে লিখছি; কারো কাছে সঠিক তথ্য থাকলে প্লিজ কমেন্টে উল্লেখ করলে বাধিত হব); অথচ এটি ব্লক করার পর অনলাইন ব্লগারের সংখ্যা ৫০-এর নীচে পড়ে থাকে, ভিজিটরের সংখ্যাও ৫০০ অতিক্রম করে না।
যে-কোনো বুদ্ধিমান পাঠক এই ব্লগের পোস্ট ও ভেতরের কন্টেন্টসমূহ পড়লে সহজেই বুঝতে পারবেন যে এখানে এমন কোনো কন্টেন্ট নেই, যার জন্য ব্লগটিকে আদৌ কোনো পর্নো সাইটের ক্যাটাগরিতে ফেলা যেতে পারে। এই ফেইসবুকের যুগে আমরা জানি ফেইসবুকে কী ধরনের লেখাজোকা, ছবি ও ভিডিও শেয়ার করা হয়, কিন্তু আমরা কি কখনো ফেইসবুককে পর্নো সাইটের ক্যাটাগরিতে ফেলতে পারবো? এই পর্নোগ্রাফির অভিযোগে কি ফেইসবুককে কখনো বন্ধ করা সম্ভব হবে? ইউটিউবও কি পর্নোগ্রাফির জন্য কম দায়ী? আমাদের উঠতি জেনারেশন তো ফেইসবুক আর ইউটিউবেই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। আমরা কি এ দুটো বন্ধ করতে পারবো?
আমি জানি না, কে বা কারা কীসের ভিত্তিতে এটাকে পর্নো সাইট হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। একটা মুভি, ভিডিও, গল্প-কবিতা এক্স-রেটেড হওয়ার জন্য কিছু শর্ত থাকে। এই ব্লগে এমন কোনো কন্টেন্ট খুঁজে পাওয়া যাবে না, যা সেই শর্তের মধ্যে পড়ে। হঠাৎ হঠাৎ কোনো দুষ্টুমতি ব্লগার, কিংবা কোনো ষড়যন্ত্রকারী অসৎ উদ্দেশ্যে হয়ত কিছু বাজে লেখা বা ইমেজ শেয়ার করে থাকবেন, কিন্তু তা মডারেটরদের দৃষ্টিগোচর হওয়ামাত্র ব্লগ থেকে সরিয়ে ফেলা হয় এবং অপরাধের ডিগ্রি বিবেচনা করে তাকে ব্লক/ব্যান/স্থগিত বা তার কমেন্ট/পোস্ট ব্যান/ব্লক করা হয়। সবচাইতে বড়ো যে বিষয়টি লক্ষণীয়, তা হলো এরকম কোনো কিছু পাওয়া গেলে ব্লগাররাই তার বিরুদ্ধে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং অটো-রিপোর্টিং সিস্টেম থাকার ফলে রিপোর্টের ভিত্তিতে মডারেটরগণ যথাযথ সংশোধন বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন।
এখানে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হয়, যা যে-কোনো সামাজিক পরিমণ্ডলের আলোচ্য বিষয়। দেশের ১৭ কোটি জনগণের সবারই আলাদা আলাদা রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আলাদা আলাদা ধর্মীয় মতবাদ রয়েছে। ব্লগেও তার প্রতিফলন পড়তে বাধ্য। আলোচনাও সেভাবেই হয়। অনেকের একটা ভুল ধারণা আছে যে, ব্লগার মাত্রই নাস্তিক এবং এই ব্লগে নাস্তিকদের প্রোমোট করা হয়। এটাও একটা অনুমানভিত্তিক কথা। আস্তিক-নাস্তিক ইস্যুটা যে-কোনো জায়গায়, যেমন আড্ডায়, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে, ফেইসবুকে, ইত্যাদি নানান জায়গায় আলোচিত হয়ে থাকে, এখানেও ঐরকম আলোচনা হতে পারে; জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্র হিসাবেই এসব আলোচনা চলতে পারে। আমি নিজে খুব আল্লাহ-ভীরু মানুষ। এই সমস্ত আলোচনা খুবই জ্ঞানগর্ভ হয়, এবং জ্ঞান-পিপাসুরা তা থেকে অনেক লাভবান হয়ে থাকেন। এই আলোচনার মধ্যে কোথাও কোনো আপত্তিকর কিছু পাওয়া গেলে সেটাও মনিটর করা হয় এবং ব্যান করার মতো প্রতীয়মান হলে মডারেশন প্যানেল কর্তৃক সংশ্লিষ্ট ব্লগারকে ব্যান করা হয়, কিংবা আপত্তিকর কমেন্ট বা পোস্ট ডিলিট করে দেয়া হয়।
এই ব্লগটি একটি চলমান সংবাদপত্র। যে-কোনো কিছু ঘটিবামাত্র ব্লগারগণ এখানে শেয়ার করে থাকেন। এটি সাহিত্যের জন্য একটি উর্বর ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠিত লেখকরা তাদের লেখা দ্বারা নবীনদের উৎসাহিত করছেন, নবীনরা চর্চার মাধ্যমে পরিণতি অর্জন করছেন। খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন, বিজ্ঞান- অসংখ্য বিষয়ের এক অতুলীয় আর্কাইভ হলো এই ব্লগটি।
আমার ধারণা, যারা এটিকে পর্নো সাইট হিসাবে চিহ্নিত করেছেন, তারা ভুলবশত এটি করেছেন। হয়ত কোনো এক টেকনিক্যাল এরর সংঘটিত হওয়ার ফলে অটো সার্চিঙের সময় এটা পর্নো সাইট হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটা অচিরেই তাদের বিবেচনায় আনবেন এবং এটিকে সবার সামনে উন্মুক্ত করে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় আমাদের অবাধে সুষ্ঠু, সুন্দর ও নির্মল ব্লগিং করার সুযোগ ফিরিয়ে দেবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০১৯ সকাল ৯:২৮