এটি একটি বিখ্যাত গান, যার মূল শিল্পী ভূপেন হাজারিকা ও প্রতিমা পাণ্ডে বড়ুয়া। এ দুজন যুগল কণ্ঠে গেয়েছেন, আবার একক কণ্ঠেও গেয়েছেন। পরবর্তীতে অনেক বিখ্যাত শিল্পী এ গানটি গেয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশী শিল্পীদের মধ্যে ফেরদৌসী রহমান ও ফাতেমা তুজ জোহরা অন্যতম দুজন। সম্প্রতি ভারতের টপ র্যাংকিং শিল্পী জয়তী চক্রবর্তীও গানটি গেয়েছেন।
মূল শিল্পীদের পরে জয়তীর কণ্ঠে সবচাইতে বেশি ভালো লেগেছে, এরপর ফাতেমা তুজ জোহরার কণ্ঠে, যদিও ফাতেমা'র কণ্ঠে গানটি একটু চটুল হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে।
গানটি আসামের গোয়ালপাড়িয়ার লোকগীতি। এটি কবে কে রচনা ও সুর করেছিলেন, তা আজ আর জানার উপায় নেই। তবে, একেক শিল্পীর কণ্ঠে গাওয়া গানের কথায় বেশ তারতম্য লক্ষ করা যায়। নীচে দুটো ভার্সন দেয়া হয়েছে, আর উপরোল্লিখিত সব শিল্পীর গাওয়া গানই শেয়ার করা হলো।
এ গানটি সম্পর্কে জনৈক প্রত্যয় রাহা'র একটি প্রবন্ধের কিছু অংশ নীচে উল্লেখ করা হলো :
একটা গানের চলন যে একটা সভ্যতার ইতিহাস জানার চাবিকাঠি হতে পারে, সেটা কোনোদিন ভাবিনি।
‘হস্তির নড়ান হস্তির চড়ান
হস্তির গলায় দড়ি
ওরে সত্য করিয়া কনরে মাহুত কোনবা
দ্যাশে বাড়িরে।
ও তোমরা গিলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে
ও তোমরা গিলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে।’
গানটি প্রথম যাঁর কণ্ঠে শুনি তিনি ভারতের ক্ষণজন্মা মহান গুনী লোকগীতি শিল্পী শ্রদ্ধেয় প্রতিমা বড়ুয়া।
হাতির চলার ছন্দ আর এই গানের ছন্দে কি হুবুহু মিল। তাহলে কি হাতির চলার ছন্দেই এই গান বাঁধা হয়েছিল? তাহলে কি হাতির পিঠে বসেই এই ছন্দ অনুভব করে সেই ছন্দে গান তৈরি করার কথা ভাবা হয়েছিল?
---
বৃহত্তর উত্তরবাংলা ও নিম্ন অসমের লোকজীবনে ‘হাতি’ ছিল একসময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাহন। অরণ্যের কাষ্ঠ আনয়ন, রাজা-জমিদার-দেওনিয়াদের শাসনকার্য পরিচালনায়, দেশীয় মহারাজাদের রাজকার্য পরিচালনা, শিকারযাত্রা, বিনোদন ইত্যাদি কাজকর্মে হাতি ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান।
ফাঁস, খেদা ও আরো নানা ভাবে জংলি হিংস্র হাতিকে ধরা হত বন-বনাঞ্চল থেকে, কুনকী (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাতি), মাহুত, ফান্দি ও দফাদারদের সহায়তায়। এরপর শুরু হত নানা উপায়ে অশান্ত ভয়ানক জংলি হাতিকে পোষ মানিয়ে সামাজিক কর্মযজ্ঞে উপযোগী সহনশীল করে তোলার প্রচেষ্টা।
এইভাবে তৈরি হলো এক নতুন ধরনের লোকসংস্কৃতির ধারা ‘হাতি ধরার গান’ বা ‘হাতিগান’। গানের সাথে যুক্ত হলো বিভিন্ন ধরণের নৃত্যভঙ্গি। নাচের ধারা তো ছিলোই, তার সাথে চলতো নানা ধরণের লোকায়ত বাদ্যযন্ত্রের একটা যুগলবন্দী। এই ভাবেই শান্ত হত সেই হাতি। লোকায়ত রাজবংশী ভাষায় গান তৈরি হতো, জীবনযাপন, জীবনচর্যার ও সমকালীন সভ্যতার নানাবিধ রূপ ধরা পড়তো সেই গানে। কিন্তু মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ও সময়ের সাথে সাথে বিশ্বায়ন শিকড় বিচ্ছিন্নতা লোকায়ত ভাষাগুলির ওপর এক গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই ভাবে লোকসংস্কৃতির অনেক ধারারই বর্তমানে অবলুপ্তি ঘটেছে, প্রতিপলেই ঘটছে।
---
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হাতির মতোই গরু পালন, গরুর হালচাষ, রাখালিয়া জীবনযাপন যেমন আমাদের জীবন-জীবিকার সাথে সম্পর্কিত, তেমনি আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও রাখালিয়া গান ওতোপোতভাবে জড়িত। আসামি গানটার একটা বাংলাদেশি ভার্সন তৈরি করেছি আমি, সুর হুবহু, তবে, কথাগুলোতে 'মাহুত'-এর জায়গায় রাখাল এবং 'হাতি'র জায়গায় 'গরু'কে প্রতিস্থাপন করাসহ সামান্য রদবদল করা হয়েছে। নীচে 'মাহুত বন্ধুরে' গানের দুটো ভার্সন, এবং ৩ নম্বর সিকোয়েলে আমার রাখালিয়া ভার্সন দেয়া হলো। সবার নীচে গানের লিংক দেয়া হয়েছে।
১। ভার্সন-১ - মাহুত বন্ধুরে
তোমরা গেইলে কি আসিবেন ও মোর মাহুত বন্ধুরে
হস্তিরে নড়ান হস্তিরে চরান হস্তির গলায় দড়ি
ওরে সত্যি করিয়া বলরে মাহুত কোন বা দেশে বাড়ি?
হস্তি নড়াও হস্তিরে চরাও হস্তিরে পায়ে বেড়ি
আমি সত্য করিয়া কইলাম নারী গৌড়ীপুরে বাড়ি।
তোমরা গেইলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে?
আরে হস্তি নড়ান হস্তিরে চরান হস্তির পায়ে বেড়ি
আরে সত্য কইরা কনরে মাহুত ঘরে কয়জন নারী রে?
হস্তি নড়ান হস্তিরে চরান হস্তির পায়ে বেড়ি
আমি সত্য করিয়া কইলাম কন্যা বিয়া নাহি করি রে।।
২। ভার্সন-২ - মাহুত বন্ধুরে (এটা ফেরদৌসী রহমানের ভার্সন)
তোমরা গেলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে?
আরে, হস্তি নড়ান, হস্তিরে চরান, টাকুয়া বাঁশের আড়া,
ওরে কি সাপে দংশিলেক বন্ধুয়াক বন্ধুয়া,
আহইন মোর পোড়া রে,
আর গেলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে?
ওঝায় ঝাড়ে, বাইদ্যে ঝাড়ে,
ঢেঁকিয়ার আদাল দিয়া,
ওরে মুই নারীটা ঝাড়ুম বন্ধুয়ার দেশ্যে,
আদাল দিয়া রে,
আর গেলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে?
হস্তি নড়ান, হস্তিরে চরান, হস্তির গলায় দড়ি
ওরে, সত্যি করিয়া কনরে মাহুত, কোন বা দেশে বাড়ি?
আর গেলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে?
হস্তি নড়ান, হস্তিরে চরান, হস্তির গলায় দড়ি
ওরে, সত্য কইরা কনরে মাহুত, ঘরে কয়জন নারী রে?
আর গেলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে?
তোমরা গেলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে???
৩। বাংলাদেশী ভার্সন - ও মোর রাখাল বন্ধুরে - খলিল মাহমুদ
গরুরে চরাও
গরুরে খাওয়াও
গরুর গলায় দড়ি
আরে ওরে সত্য কইরা কওরে রাখাল
কোনবা গ্রামে তোমার বাড়ি রে
আরে আবার কি আসিবে
ও মোর রাখাল বন্ধু রে
তুমি আবার কি আসিবে ও মোর রাখাল বন্ধু রে
গরুরে চরাই গরুরে খাওয়াই
গরুর গলায় দড়ি
আরে ওরে সত্য কইরা কইলাম কন্যা আমার
আইড়াল গ্রামে বাড়ি রে
আমি গেলে কি মনে রাখিবে সোনার কন্যা গো
গরুরে চরাও গরুরে খাওয়াও
গরুর গলায় দড়ি
আরে ওরে সত্য কইরা কওরে রাখাল ঘরে
কয়জনা নারী রে
আরে আবার কি আসিবে ও মোর রাখাল বন্ধু রে
তুমি আবার কি আসিবে ও মোর রাখাল বন্ধু রে
গরুরে চরাই গরুরে খাওয়াই গরুর গলায় দড়ি
আরে ওরে সত্য কইরা কইলাম কন্যা বিয়া নাহি করছি রে
আমি গেলে কি মনে রাখিবে সোনার কন্যা রে
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫
গানের লিংক
১। জয়তী চক্রবর্তী
২। ফাতেমা তুজ জোহরা
৩। লোপামুদ্রা মিত্র
৪। ফেরদৌসী রহমান
৫। ভূপেন হাজারিকা
৬। প্রতিমা পাণ্ডে বড়ুয়া
৭। ভূপেন হাজারিকা ও প্রতিমা পাণ্ডে বড়ুয়া
বাংলাদেশী ভার্সন - ও মোর রাখাল বন্ধুরে
১। ভার্সন-১
২। ভার্সন-২ (লিরিক্যাল)
বোনাস
Extraction মুভিতে বাংলা গান !!!
ভিডিও'র গানে ব্যবহৃত ছবি : ইন্টারনেট ও আইএমডিবি (ইন্টারনেট মুভি ডাটা বেইজ)