১
অসুস্থ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে শরাফুদ্দিন পাগাম সাহেব খুব বিমর্ষ হয়ে যান। ধীরে ধীরে স্ত্রীর শরীরটা ছোটো ও কঙ্কালসার হয়ে যাচ্ছে। জীবনের অর্ধেকটা সময় ওর সামনে পড়ে আছে। কত বাসনা এখনো অপূর্ণ রয়ে গেছে তার। ওগুলো সব পূরণ হওয়ার পথে, আর মাত্র কয়েকটা বছর পার হলেই হতো। কিন্তু এর মধ্যেই স্ত্রীর শরীরে দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। যে-কোনো সময় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবেন, শরাফুদ্দিন পাগাম সাহেব তা জানেন, এবং মানসিক ভাবে তা নিয়ে নিজের প্রস্তুতিও আছে তার। কিন্তু তিনি চিন্তিত নাবালেগ মেয়েদুটোকে নিয়ে। এ বয়সে ওরা মা-হারা হয়ে যাবে। মায়ের আদরের মতো পৃথিবীতে আর কিছু নেই। শরাফুদ্দিন পাগাম সাহেব ছোটোবেলায় নিজের মাকে হারিয়ে যে বেদনা পেয়েছিলেন, তা থেকে মেয়েদের বেদনা অনুভব করতে করতে তার দু চোখ ভিজে যায়।
স্ত্রী-বিয়োগের পর মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আর বিয়ে করবেন না বলে স্থির ভেবে রেখেছেন শরাফুদ্দিন পাগাম সাহেব। তাকে একই সঙ্গে বাবা ও মায়ের ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ছোট্ট সংসারটাকে স্ত্রী যেভাবে সামলে গুছিয়ে রাখতেন, মেয়েদের আদর করা ছাড়া সংসারের আর কোনো কিছুতেই কখনো তিনি মনোযোগ দেন নি। প্রয়োজনে একহাঁড়ি পানি গরম করতে হলেও তা পারবেন কিনা সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। এরকম অনভ্যস্ততার মধ্য দিয়ে নিজের চাকরি বাঁচিয়ে রেখে মেয়েদের নিয়ে কীভাবে সংসার টানবেন, তা ভাবতে গেলেও শরাফুদ্দিন পাগাম সাহেবের দম আটকে আসে। নিজের শরীরটাও যে খুব নীরোগ তাও না। কিন্তু, স্ত্রীর অসুখের কাছে নিজের চিন্তা তিনি আমলেই নেন না কখনো।
একদিন সকালে প্রতিদিনকার মতোই শরাফুদ্দিন পাগাম সাহেব হাঁটতে বেরোলেন। জগিং করতে করতে হঠাৎ পাঁজরের নীচে একটু ব্যথা অনুভব করলেন, তারপর শ্বাসকষ্ট। এরপর নেতিয়ে রাস্তায় পড়ে গেলেন। শরাফুদ্দিন পাগাম সাহেব অসুস্থ স্ত্রী ও মেয়েদুটোর কথা ভাববার জন্য আর জেগে উঠলেন না।
২
নুরুলুদ্দিন আকন পই পই করে ছোটো ভাইদের বলে রেখেছিল, বাবার অসুখবিসুখে কোনোরূপ অবহেলা না করে যেন যথাসত্বর থানা সদরের হেল্থ ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। কেউ কথা শোনে না। মা-বাবা বৃদ্ধ হলে যেন সবার জন্য একটা ‘আপদ’ হয়ে যান। দিনভর মোবাইল টিপাটিপি আর ল্যাপটপ নিয়েই ছোটো ভাইগুলোর ব্যস্ততা। বাবাটা যেন এখন একমাত্র নুরুলুদ্দিন আকনের একার সম্পত্তি, সবখানি খোঁজখবর, দেখভাল শুধু ওকেই করতে হবে।
শুরুতে বাবার জ্বর ছিল। পরে সর্দি-কাশি। এরপর শ্বাসকষ্ট যোগ হয়। পাঁচদিনের মাথায় নুরুলুদ্দিন আকনের বকাবকি খেয়ে ছোটো ভাইয়েরা থানা সদরের ক্লিনিকে নিয়ে যায় বাবাকে। ক্লিনিকের ডাক্তার রোগীর অবস্থা ভয়াবহ বলে ঢাকায় রেফার করেন। নুরুলুদ্দিন আকনের মাথা পাগল হয়ে যায়। সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। ভাইয়েদেরকে তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্সে করে বাবাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করতে বলে। ঢাকা আসতেও কমপক্ষে তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগবে। এর মধ্যে সে হাসপাতালও ঠিক করে ফেলে। শীঘ্র সবকিছু গুছিয়ে একটা ছোটো ব্যাগ সাথে নিয়ে দ্রুততার সাথে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয় নুরুলুদ্দিন আকন।
রাস্তার ওপারে একটা সাদা ক্যাব দাঁড়ানো ছিল। রাস্তা পার হবার জন্যে সে মাত্র কয়েক কদম পা বাড়িয়েছিল, অমনি বাসটা দড়াম করে এক ধাক্কায় সামনে ফেলে দেয় তাকে, তারপর বুকের উপর একটা চাকা উঠিয়ে দিয়ে ফটাস শব্দে শরীরটা ফাটিয়ে দিয়ে ঘড়ঘড় করে চলে যায় বাসটা।
আমাদের মৃত্যুগুলো এমন আকস্মিক ও অনিশ্চিত।
৩
ছোটো দুটি ছেলেমেয়ে আকিশা ও রোশান আর স্ত্রী শামিলাকে নিয়ে একটা নিরিবিলি চারতলা দালানের উপরের তলায় আলালুদ্দিন মাখনের ছিমছাম সংসার। সুখে-দুঃখে-শান্তিতে বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল তাদের অনাবিল জীবনটা। কিন্তু মাসখানেক হলো মেয়েটা অসুখে পড়েছে।
অসুখে পড়ার পর থেকে আকিশা সারাক্ষণই মনমরা অবস্থায় থাকে এবং বেশিরভাগ সময়েই বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।
ছোট্ট আকিশার অসুখটা কিছুতেই সারছে না। ডাক্তার-কবিরাজ বেঁটে খাওয়ানো বাকি আছে, কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। আগে কতই না চঞ্চল ছিল মেয়েটা। ওর দু বছরের বড়ো রোশানের মনটা সবচাইতে বেশি খারাপ। দু ভাইবোন দিনভর একসাথে খেলা করতো, টিভিতে কার্টুন দেখতো। শামিলা ওদের দুজনকে একসাথে গোসল করাতো, খাওয়াতোও একসাথে। কার্টুন দেখতে দেখতে আকিশা খিল খিল করে হাসতো, এ হাসি দেখে রোশানের খুব মজা লাগতো। আকিশা ভাঙা ভাঙা শব্দে রোশানকে বলতো, ‘আমি জেলি, তুমি তম’ (আমি জেরি, তুমি টম)। জেরি যখন টমকে নানা ছলচাতুরীতে ফাঁদে ফেলতো, তখন হাসতে হাসতে আকিশার পেটে খিল ধরে যেত। আনন্দের আতিশয্যে ভাইয়ের বাহু কিংবা বুকে কামড় বসিয়ে দিত। রোশান হাত দিয়ে লালা মুছতে মুছতে বলতো, ‘এই, কামড় দিও না। আমি ব্যথা পাই।’ আকিশা হা-হা করে হেসে আরো একটা কামড় দিয়ে রোশানের শরীরে গড়িয়ে পড়তো।
ছোটো দুই ভাইবোনের এরকম আলাভোলা খেলা ও খুনসুটি দেখতে আলালুদ্দিন মাখন ও শামিলার খুব ভালো লাগতো। এ নিয়ে দুজন আলাপও করতো – ‘বাচ্চারা হলো আল্লাহর তরফ থেকে সবচাইতে সেরা পুরস্কার। দেখো, ওদের খেলাধুলা দেখতে দেখতেই আমাদের আনন্দে মন ভরে থাকে।’
মাঝে মাঝে দু ভাইবোন ছোটোখাটো জিনিস নিয়ে কাড়াকাড়ি করতো। এগুলো দেখতে খুব মধুর লাগতো। কখনো সখনো আলালুদ্দিন মাখন মনে মনে খুব করে চাইত, ওরা দু ভাইবোন একটু ঝগড়া করুক। কিন্তু ওদের ঝগড় খুব কোমল হতো। আকিশার কোনো খেলনা যদি জোর করে রোশান নিয়ে নিত, আকিশা বড়োজোর গলা সামান্য বাড়িয়ে মৃদু রাগের স্বরে বলতে পারতো, ‘দাও! দাও! আমার খেলনা দাও!’ এরপর রোশান খেলনা ফেরত না দিলে আকিশা কেঁদে কেঁদে বাবা বা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলতো, ‘দেয় না! দেয় না!’
আজকাল এসবের কিছুই হয় না। এজন্য রোশানকেও খুব মন খারাপ করে থাকতে দেখা যায়। টিভিতে কার্টুন দেখতে তার তেমন মন নেই, খেলনা নিয়েও কদাচিৎ বসতে দেখা যায় তাকে। নার্সারির পড়ারও তেমন চাপ নেই। আলালুদ্দিন মাখন বা শামিলা দুজনেই ওকে পড়ায়। কিন্তু, রোশান পড়তে চায় না। হঠাৎ হঠাৎ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে ওঠে, ‘ভালো লাগে না আমার।’ স্বামী-স্ত্রী ঠিকই বুঝতে পারে, ছোটোবোনের অচঞ্চলতার কারণেই সে এতটা মনমরা হয়ে থাকে। আলালুদ্দিন মাখন সময় পেলে রোশানকে নিয়ে একটু বাইরে ঘুরতে যায়। মাঝে মাঝে ছাদে যায়, যেখানে অন্য বাচ্চারাও আসে। সেখানে কিছুটা উৎফুল্ল সময় কাটালেও বাসায় ফিরে আসার পর আগের মতোই বিমর্ষ হয়ে পড়ে রোশান।
ছেলেমেয়েদের এরকম অসুখবিসুখে কোনো মা-বাবার মন ভালো থাকে না।
এর মধ্যে একদিন শামিলার নানা ও নানিজান ওদের বাসায় বেড়াতে এলেন। পুরো দালানের চারদিকের পরিবেশ এবং আকিশার চেহারা দেখে তিনি বললেন, ‘তোমরা বাসাটা বদলাইয়া ফালাও। অন্য খোলামেলা জায়গায় যাও। এ জায়গাটা ভালো না।’
আলালুদ্দিন মাখন আর শামিলা দুজনই খুব চিন্তিত হলো নানাজানের কথায়। নানাজান খুব কামেল মানুষ। তিনি যা বলেন খুব ভেবেচিন্তে বলেন, তাঁর কথার মূল্য অনেক।
নানাজানকে অনেক অনুনয় বিনয়ের পর তিনি জানালেন, এ দালানটা জিনের নজরে পড়েছে। এ কথা শুনে ওরা দুজনেই চমকে ওঠে। হায়, আকিশার উপর তাহলে জিনের আছর পড়ে নি তো! নানাজান কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে চুপচাপ থাকার পর ধীরে ধীরে মাথা উপর-নীচ দুলিয়ে বললেন, ‘খুব খারাপ জিন এটা। তোমরা জলদি বাসা বদলাইয়া ফালাও।’
দালানটা খুব পুরাতন না, বরঞ্চ আশপাশের দালানগুলোর তুলনায় এটাকে বেশ নতুনই বলা চলে। তবে, এ দালানটা ঘেঁষে পেছনে একটা উঁচু ঢিভি এবং তার উপর বিরাট ঝুঁপড়িওয়ালা একটা কড়ই গাছ দালানের ছাদ ছাড়িয়েও অনেক উপরে উঠে গেছে। কিছু দূরে রাস্তার উপর একটা বাঁশঝাড় অনেক জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। আম-জাম-দেবদারু গাছও জায়গা অন্ধকার করে কোথাও কোথাও জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। জায়গাটা মোটের উপর পরিচ্ছন্ন হলেও সূর্য ডোবার বেশ আগে থেকেই আলো-আঁধারীতে চারদিকটা কেমন ভুতুড়ে হয়ে ওঠে। এতদিন আলালুদ্দিন মাখন বা শামিলা এ ব্যাপারটা তেমন গুরুত্ব দেয় নি বা খেয়াল করে নি, কিন্তু নানাজানের কথার পর থেকে পুরো এলাকাটাই এখন ওদের কাছে ভৌতিক মনে হচ্ছে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই দরজা-জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দেয়। পর্দার ফাঁক দিয়ে হঠাৎ কড়ই গাছের দিকে চোখ গেলে গা শিউরে ওঠে।
স্বামী-স্ত্রী দুজনে খুব দ্রুত বাসা বদল করে অন্যদিকে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।
একদিন সারাদিন আকাশ জুড়ে মেঘ ছিল, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হলো। বিকেলের দিকে কিছুক্ষণ দমকা বাতাসও বয়েছিল। প্রতিদিনকার চাইতে একটু আগেই ছাদের দরজাটা আটকে দিয়ে এলো আলালুদ্দিন মাখন।
আজ আকিশার মর্জিটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে। মেঘ-তুফানের সাথে জিনদের মেজাজ-মর্জিও ওঠানামা করে কিনা তা ওরা জানে না। একটু পর পর আকিশা কান্না করে উঠছে। পেটে ব্যথা কিনা, তা ছোট্ট আকিশা হয়ত বুঝতে পারে না। পেট ব্যথা হলেও বাচ্চারা এরকম ঘন ঘন কান্নাকাটি করে।
অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর আকিশা ঘুমালো। আলালুদ্দিন মাখন ও শামিলা এতক্ষণ পর একটু স্বস্তি পেলো। রাতও গভীর হয়েছে। বাইরে বৃষ্টি ছিল এতক্ষণ, এখন নেই মনে হচ্ছে। তবে মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপটা শোনা যায়।
ওদের সবার চোখ মুদে এসেছে। এমন সময় ছাদের দরজায় কীসের শব্দে শামিলার হালকা ঘুম ভেঙে যায়। সে আকিশাকে বুকে টেনে নিয়ে কান খাড়া করে শোনে, শব্দটা আসলেই ছাদের দরজা থেকে আসছে কিনা। একটু পর আবার আওয়াজ হলো। থেমে থেমে কে যেন ছোট্ট হাতে ছাদ থেকে দরজায় থাপ্পড় দিচ্ছে। শামিলার শরীর কেঁপে উঠলো। সে ফিসফিস করে আলালুদ্দিন মাখনকে ডাকে।
-‘কী হয়েছে?’
-‘আমার খুব ভয় করছে।’
-‘কী হয়েছে? কীসের ভয়?’
-‘নানাজান ঠিকই বলেছিলেন। বাসাটা ভালো না। ঐ শোনো, ছাদ থেকে কে যেন দরজা থাপড়াচ্ছে। মনে হয় একটা বাচ্চা জিন।’
-‘ধূর! কী বলো? আমি তো কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছি না।’
-‘ওসব কিছু না। ঘুমাও। হয়ত ভুল শুনেছ। বা স্বপ্নে কিছু দেখেছ।’
-‘না না। আমি ঠিকই শুনেছি।’
দুজনেই সেই শব্দ আবার শোনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। আলালুদ্দিন মাখন শেষমেষ বললো, ‘কড়ই গাছের ডালটা এসে পড়েছে দরজা বরাবর। বাতাসে ঐ ডাল দরজায় আছড়ে পড়লে থাপ্পড়ের মতোই শোনায়। ঘুমাও। ওসব বাজে চিন্তা মাথায় ঢোকালে ভয় আরো বাড়বে।’
কিন্তু শামিলা স্বামীর কথায় আশ্বস্ত হতে পারলো না। সে বার বার আলালুদ্দিন মাখনকে বাহু দিয়ে ধাক্কাতে লাগলো আর বলতে থাকলো, ‘তুমি ঘুমিয়ো না। জিনটা আবার আসবে, আমি নিশ্চিত। নানাজানের কথা মিথ্যা হতে পারে না।’
আলালুদ্দিন মাখন শামিলাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আল্লাহর নাম লও। ইনশাল্লাহ কিচ্ছু হবে না।’ ঠিক ঐ মুহূর্তে ছাদের উপর থেকে কড়ই গাছের ডালপালা মটমটিয়ে ভেঙেচুরে ঝপঝপ করে কী যেন নীচে পড়ে গেল – সেই সাথে গাছ থেকে কয়েকটা বিরাটকায় বস্তুর পাখা ঝাপটে আকাশে উড়ে যাওয়ার শব্দ হলো- আর শামিলা বিকট চিৎকারে আকিশাকে সাপটে ধরে আলালুদ্দিন মাখনের শরীর জড়িয়ে ধরলো। এই চিৎকারের শব্দে আকিশা যেমন কেঁদে উঠলো, রোশানও ঘুমের মধ্যে উঠে হতবিহ্ববল অবস্থায় বিছানায় বসে পড়লো।
ঘরে আলো জ্বেলে দিল। শামিলা তখনো থরথর করে কাঁপছে। আলালুদ্দিন মাখন বুঝতে পারছে না হঠাৎ কী হয়ে গেলো। এতক্ষণ শামিলার কথাকে অগ্রাহ্য করলেও নানাজানের কথা স্মরণে আসায় শামিলার কথাকে সে মনে মনে সায় দিল। আল্লাহ-বিল্লাহ করতে করতে, বার বার সুরা, কালিমা পড়ে ছেলেমেয়েদের শরীরে ফুঁক দিতে দিতে তারা রাত পার করলো এবং প্রতিজ্ঞা করলো, আগামী সপ্তাহখানেকের মধ্যেই যেমন করেই হোক তারা এই বাসা ত্যাগ করে অন্য বাসায় উঠবে।
সকালে সূর্য ওঠার পর শামিলার ভয় চলে গেলো। আলালুদ্দিন মাখন স্ত্রীর এই নির্ভীক ভাব দেখে অফিসে যেতে সাহস করলো।
দুপুরের দিকে শামিলার ফোন। ওর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। আলালুদ্দিন মাখন বার বার বলছে, ‘শামিলা, আমি বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছো। প্লিজ একটু দম নিয়ে আবার বলো।’
কিছুই বোঝাতে না পেরে শেষে বললো, ‘খুব খারাপ খবর। তুমি জলদি বাসায় চলে আসো।’
‘খুব খারাপ খবর’-এর কথা শুনে আলালুদ্দিন মাখনের বুক দুরু দুরু করে ওঠে। আকিশার কিছু হয় নি তো! সে দ্রুত বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
ঘটনা বুঝবার জন্য আলালুদ্দিন মাখনকে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ফ্ল্যাটে যেতে হলো না। বিল্ডিঙের পেছনের দিকে একটা নয়-দশ বছরের মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। মেয়েটার শরীর ফেটে গেছে, চারদিকে হাত-পা ছড়ানো, মুখ থেতলে গেছে। সবাই বলাবলি করছে, ছাদের উপর থেকে পড়ে মারা গেছে মেয়েটা।
পুলিশী তদন্তে ঘটনা বেরিয়ে এলো।
মেয়েটা অন্য বিল্ডিঙের একটা ফ্ল্যাটে কাজ করতো। ঘটনার দিন একটা প্লেট ভেঙে ফেলায় বাসার মহিলা ওকে বকাবকি করেন এবং একটা চড়ও দেন। এতে সে ভয় পেয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। সে এ বিল্ডিঙের ছাদে এসে লুকিয়েছিল। তৃতীয় তলার বুয়া বিকেলে ওকে এ ছাদে দেখেছিল। এখানে এসেছে কেন জানতে চাইলে বলেছিল, খেলতে এসেছে। মেয়েটা বাসা থেকে চলে আসার পর থেকেই ওকে খোঁজা হচ্ছিল। বাসার মানুষরা ভেবেছিলেন ও পালিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করেছে, যদিও সে একা বাড়িতে যেতে পারবে না, এবং পথে হারিয়ে যাবে বলে তারা জানতেন। তাই সম্ভাব্য সবগুলো রাস্তায় খোঁজা হয়েছিল, পরিচিত কয়েকটা বাসা, যেখানে আগে ও গিয়েছিল, সেখানেও খোঁজা হয়েছিল।
দালানের ছাদে একটা পানির ট্যাংকি আছে। পানির ট্যাংকিটা দালানের কিনার ঘেঁষে দাঁড়ানো। মেয়েটা কিছু না বুঝে, বা কোনো কারণ ছাড়া, কিংবা নিছক খেয়ালের বশে ছাদের কিনার থেকে ট্যাংকির উপরে ওঠার চেষ্টা করার সময় পা ফস্কে নীচে পড়ে যেয়ে থাকতে পারে, কিংবা ট্যাংকির উপরে ওঠার পর হয়ত পা ঝুলিয়ে বসেছিল এবং ঘুমের ভাব আসায় ভারসাম্য হারিয়ে নীচে পড়ে যায়।
ঘটনা শোনার পর আলালুদ্দিন মাখন আর শামিলা দুজনেই কষ্টে মুহ্যমান হয়ে পড়লো। আহারে, অবুঝ অসহায় মেয়েটা সেদিন কতই না কাতর ভাবে দরজা থাপড়াচ্ছিল খুলে দেয়ার জন্য। হায়! কীভাবে এত আহাম্মকী কাজটা তারা করতে পারলো? না জানি কত কষ্ট করেছিল মেয়েটা বৃষ্টি আর বাতাসের ঝাপটায়। কীভাবে ওর গরীব মা-বাবা ওর এই থেতলে যাওয়া মুখের কথা ভুলবে? তাদের অন্তর কি কোনোদিন শান্তি পাবে?
আলালুদ্দিন মাখন আর শামিলা মৃত মেয়েটার কথা ভাবে, বুক চাপড়ায়, কষ্টে ছেলেমেয়েদেরকে সাপটে ধরে, আর বুকের মানিক হারিয়ে গেলে কী যে কষ্ট, তা পলে পলে অনুভব করতে থাকে।
৩০ আগস্ট ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০২০ সকাল ১১:০৫