প্রতিটা মৃত্যু আমাদের চোখ আর্দ্র করে
হৃৎপিণ্ড ফালি ফালি করে
হোক সে আপন অথবা পর, প্রতিটা মৃত্যুসংবাদ
আমাদের বুকের ভেতর ছুরির ফলার মতো গেঁথে যায়।
মৃতব্যক্তি জানিয়ে যান- আমিও তোমাদের
রক্তের অংশ ছিলাম।
টেলিভিশনে ‘লাইভ’ কণ্ঠে ঝরে পড়ছিল অবিরল মধুরতা।
সস্ত্রীক আমি বুঁদ ছিলাম রাত্রিভূক স্নিগ্ধ মূর্ছনায়।
হায়, একদিন সকালে চমকে উঠলো বুক, তখনো মন জুড়ে
‘শুয়াচান পাখি’র মুহুর্মুহু সুরের রেশ, আর স্ক্রলে
দ্রুত ভেসে যাচ্ছে – ‘বারী সিদ্দিকী আর নেই’।
আমাদের রক্তসম্পর্কের কেউ তো নন তিনি, তবু কেন হায়,
হুহু করে বুক, চর চর করে পাঁজর ফেটে যায়!
এভাবে নিভৃতে কবিতায় ঘুমিয়ে পড়েন অনাত্মীয় বারী সিদ্দিকী,
অনাত্মীয় সকল সুজনেরা।
কখনো কি ভেবেছেন - মৃত্যু এত বেদনাময় কেন!
অর্থাৎ, কারো মৃত্যুতে আমরা কীজন্য কাঁদি!
যিনি চলে যান, চলে গেলেন যিনি, পৃথিবীতে আর
কোনোদিন তাঁর মুখ দেখা হবে না,
তাঁর হাসি আর ভাসবে না সকালের রোদে,
চাঁদের জোসনায়; তাঁর সুমিষ্ট ভাষ্যে কারো
হৃদয় বিগলিত হবে না। দিনে দিনে, জনে জনে
যত জড়িয়েছিলেন মায়া, বুনেছিলেন মমতার বীজ
অজস্র মননে - সকল বন্ধন ছিঁড়ে উড়ে যাবে পাখি
অনন্ত দূরের অসীম ভুবনে- আর কোনোদিনই ফিরবে না, হায়
যখন এরোপ্লেন বা টেলিফোন ছিল না,
হয়ত যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে প্রবাসী ছিল
মায়ের কোলছেঁড়া সন্তান; সর্ববিষণ্ণা জননী
সন্তানবিহনে সতত চোখ ক্ষয় করেন,
তবু তাঁর সান্ত্বনা - সর্বাঙ্গ আনন্দে
ঝলসে দিয়ে কোনো একদিন আদরের সন্তানেরা
খলবল করে নেচে উঠবে।
- মা একদা চিঠি পান, বহুকাল আগেই
শূন্যের সমীপে সমর্পিত হয়েছে কলজের ধন।
তাঁর আহাজারিতে পৃথিবী আকুল হয়, হায়,
আত্মার অংশেরা আর কোনোদিন আত্মার স্পর্শে ফিরবে না।
আমরা হাসি। আড়ালে দুঃখ কাঁদে।
অন্তরের খবর কতটুকু জানি?
আমরা হাসতে হাসতে ছুটে চলি
পরম গন্তব্যের দিকে- সে খবর রাখি না।
প্রতিটা মৃত্যু আমাদের জানিয়ে দেয় চিরায়ত
অমোঘ সত্য- জন্মের মতোই এ এক
অলঙ্ঘ্য নিয়তি- প্রতিটা বস্তু, জড় বা জীবন্ত প্রাণী,
সৃষ্টির পরই প্রতিনিয়ত ধাবিত হতে থাকে অনিবার্য
বিনাশের দিকে। মৃত্যুহীন বা অবিনশ্বর কিছুই
সৃষ্টি করেন নি তিনি।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডাক্তারেরাও কারো মৃত্যু ঠেকাতে পারে না,
পথের ধুলোয় সম্পদ মিশে যায়; মানুষ শূন্যহাতে জন্মায়,
ফিরে যায় শূন্য হাতে। সারা বিশ্ব জয় করে মহামতি আলেকজান্ডারও
শূন্যহাত দেখিয়ে মাটির গর্ভে নিমজ্জিত হলেন,
শীর্ষ ঐশ্বর্যশালী স্টিফ জবস তেমনি পাহাড়প্রমাণ সম্পদের চূড়া হতে
গড়িয়ে গড়িয়ে ভূপাতিত হলেন; তাঁর স্থাবর-অস্থাবর
সমুদয় বৈভব ভেসে যাচ্ছে সাগরের স্রোতে।
মৃত্যুর জন্য আমাদের প্রস্তুতির প্রয়োজন। পার্থিব সঞ্চয়
সঙ্গে যাবে না। এগুলো অপরে খাবে।
ইঁদুরে কাটবে। আগুনে পুড়বে।
কিছু কিছু সম্পদ হয়ত অভিশাপ দেবে।
বয়োক্লিষ্ট সোনাভান আলয় অভিমুখে অস্থির হাঁটছেন,
কুঞ্চিত চোখে পড়ন্ত সূর্যের দিকে তাকান। অল্প কিছু আলোর
পরই ছায়াহীন সন্ধ্যা, তারপর নিকষ রাত্রি। দীপহীন
ঘোর অন্ধকারে কে তাঁকে দেখাবে পথ!
চিন্তাগ্রস্ত সোনাভান অস্থির। অস্থির পায়ে আলয় অভিমুখে
ছুটছেন। তাঁর অন্তর জুড়ে বিগত দিনের শোচনা।
কতটুকুই বা তাঁর ‘সম্পদ’! আদৌ কি আছে কোনো সঞ্চয়!!
২৪ নভেম্বর ২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ২:২৩