পাঠকের জ্ঞাতার্থে ব্লগার অপি আক্তার সম্পর্কে যৎসামান্য উপক্রমণিকা দিতে হচ্ছে। ২১০৯ সালের ২১ জুন তারিখে সামহোয়্যারইন ব্লগে অপি আক্তার নিকনেইম ধারণ করে তিনি রেজিস্ট্রেশন করেন। দীর্ঘ এক যুগেরও অধিককাল সময়ে তিনি একটি মাত্র পোস্ট লিখেছেন, যেটি রেজিস্ট্রেশনের দিনই পাবলিশ করা হয়। খুব ছোট্ট কিন্তু এই ঐতিহাসিক পোস্টটিও সহৃদয় পাঠকের অবগতির জন্য নিম্নে কপি-পেস্ট করা হলো :
সবাইকে শুভেচ্ছা
২১ শে জুন, ২১০৯ রাত ১১:১০
আমি ব্লগে নতুন। কিছু লিখতে পারবো কিনা জানি না। লেখার মতো মাথা নেই। তবে পড়বো। আর লেখার চেষ্টা করবো। সবাইকে আবার শুভেচ্ছা। সবাই ভাল থাকবেন ।
পোস্টটি ২২,৭৯৩ বার পঠিত; তাতে ১১৭টি লাইক পড়েছে এবং ৯৩টি শেয়ার হয়েছে। এ পোস্টে তিনি ১৪১৮টি মন্তব্য পেয়েছেন, এবং ৬২০টি কমেন্টের উত্তর দিয়েছেন। তিনি অন্য ব্লগারদের পোস্টে ৩৩৬টি কমেন্ট করেছেন।
ব্লগার নোমান নমি’র ০৯ ই জানুয়ারি, ২১১৫ রাত ৩:০৩ ঘটিকায় প্রকাশিত ‘আমার ব্লগাব্লগি’ শীর্ষক পোস্টে তিনি সর্বশেষ ৪৯ নম্বর কমেন্টটি করেছিলেন :
৪৯. ০৬ ই এপ্রিল, ২১১৫ দুপুর ১:৪৯
অপি আক্তার বলেছেন: অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা ।
১৫ ই জুলাই, ২১১৫ রাত ১২:৪৩
লেখক নোমান নমি বলেছেন: আমার ব্লগে আপনার মন্তব্য বিশেষ কিছু। আমার ব্লগ জীবনের একটা অর্জন। আফসোস মন্তব্যটা এতদিন পর দেখলাম
২১ জুন ২১০৯ তারিখে রাত ১১:১০-এ অপি আক্তারের পোস্টটি পাবলিশ হওয়ার পর একই তারিখে ১১:১৬-তে প্রথম কমেন্টটি করেছিলেন গায়ক ব্লগার পাপন :
পাপন : আপনিও ভালো থাকবেন।
জবাবে ২৬ মিনিট পর অপি আক্তার নরম করে লিখলেন : আচ্ছা।
৬ নাম্বার কমেন্টে ব্লগার শয়তান হন্তারক বলেছেন: লিখতে লিখতে লেখক, গাইতে গাইতে গায়েন আর মারতে মারতে মার্ডারার।
শয়তান হন্তারকের কমেন্টের জবাবে অপি আক্তার বলেছেন: ভাল লিখেছেন।
লিখতে লিখতে লেখক, গাইতে গাইতে গায়েন আর মারতে মারতে মার্ডারার।
ধন্যবাদ ।
জীবনে তার মতো ভাগ্যবান আর কেউ নাই, যারা ব্লগার অপি আক্তারের পোস্টে কমেন্ট করতে পেরেছেন।
এদের চাইতেও ভাগ্যবান ব্যক্তি হলেন তারা, যারা অপি আক্তারের পোস্টে কমেন্টের রিপ্লাই পেয়েছেন।
কিন্তু, তারাই কেবল বলতে পারেন, তাদের মানব-জন্ম, আই মিন ব্লগিং জীবন সার্থক, যাদের পোস্টে স্বয়ং অপি আক্তার কমেন্ট করেছেন।
--
ডিজিটাল যুগে যা হয়, বই প্রকাশের আগেই ব্লগ, ফেইসবুক, টুইটারসহ ইউটিউবে এর উপর সচিত্র প্রমোশনাল ভিডিও পাবলিশ করা হলো। প্রথম দিকে এগুলোর ভিউসংখ্যা ছিল স্বাভাবিক। এবং এ বই খুব প্রচার পাবে, ভাইরাল হবে সুন্দরী ব্লগার অপি আক্তারের ছবিসহ আমার বইয়ের কভারটি, সে নিয়ে মনের মধ্যে সূক্ষ্ম একটুখানি বাসনা থাকলেও তা কোনোদিন মুখে প্রকাশ করি নি। বইটি যাতে ভাইরাল হয়, তার জন্য আমি অবশ্য একটু কৌশলের আশ্রয় নিয়ে ছিলাম। নিন্দুকেরা এটাকে ‘কৌশল’ না বলে ‘চাতুর্য’ আখ্যা দিতে পারেন, আমার নৈতিকতার প্রতি কটাক্ষ করে।
ফেইসবুকে বা ব্লগে সুন্দরী যুবতীর আকর্ষণীয় প্রোফাইল পিক্শ্চার দেখে কে না আকর্ষিত ও ধাবিত হয়ে থাকে তার দিকে? বইয়ের মলাটেও যদি অপরূপা কোনো যুবতীর খুনি চোখের চাহনিভরা ভুবনমোহিনী অবয়বখানি জুড়ে দেয়া যায়, তাহলে সে বইয়ের কাটতি এমন হবে যে, প্রতিদিনই একটা নতুন সংস্করণ বের করার প্রয়োজন পড়বে।
অপি আক্তার সতিই খুব সুন্দরী। তার প্রোফাইল পিক্শ্চারে সেই যে তিনি ১৮-১৯ বছরে ব্লগে ঢুকেছিলেন, আজও সেই লাবণ্যময় ১৮-১৯শেই পড়ে আছেন। আমি কভার পেইজের জন্য তার এই প্রোফাইল পিক্শ্চারটাই বেছে নিলাম।
কভার পেইজের জন্য বিশেষ কোনো কষ্ট করতে হলো না। বিশিষ্ট চিত্রকর, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার, আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের মতো ড্যাশিং হিরো টাইপ ব্লগার ও ব্লগ অ্যাডমিনিস্ট্রের বাস্তবিক_ভালোবাসাকে সবিনয় অনুরোধ করার পর তিনি এটাকে যথাযথ এডিটিঙের পর কভার পেইজ হিসাবে রেডি করে দিলেন।
কভার পেইজ ছাপা হবার পর ঝকঝকে ছবি দেখে আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। সাক্ষাৎ অপ্সরা। এখন বাজারে ভিউকার্ড পাওয়া যায় কিনা জানি না; কিন্তু কৈশোর ও তারুণ্যে দেশখ্যাত ও বিশ্ববিখ্যাত সুন্দরী সেলিব্রেটিদের অনেক ভিউকার্ড দেখেছি; ওগুলো কিনেছি; পড়ার টেবিলে গ্লাসের নীচে, কখনো বা শৌখিন ফটোফ্রেমে অলিভিয়া, ববিতা, শ্রীদেবী, মাধুরী, জয়াপ্রদা’র ভিউকার্ড থরে থরে সাজিয়ে রেখেছি। বই খুলে পড়ার দিকে না তাকিয়ে তাদের চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকেছি; বইয়ের পাতায়ও তাদের চোখ-ঝলসানো রূপ ভেসে থাকতো সারাক্ষণ। সেইদিন কোথায় গেল!! আর কি ফিরে পাব স্বর্ণালি রূপালি সেই দিন!!
আরেন্নাহ! আরো উজ্জ্বল দিন যাচ্ছে এখন। অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, এলিজাবেথ টেলর, টাইটানিক সুন্দরী কেট উইন্সলেট, নাতালি পাতালি, আরো কত নাম, অড্রে হেপবার্ন, জেনিফার লোপেজ, শাকিরা, এলিজি – তখন কি আমরা এই সুন্দরীদের দেখেছি? এখন তো গুগুল মামিকে বলামাত্রই মুহূর্তে সামনে এনে হাজির করে সবাইকে। যা চাই, তা পাই। তাতে কোনো ভুল নাই।
বইমেলা শুরুর সপ্তম দিনে, এক ছুটির শুক্রবার বিকেল ৪টায় বইমেলার নজরুল মঞ্চে আমার বিখ্যাত উপন্যাস ‘অপি আক্তার’-এর মোড়ক উন্মোচন করা হলো। একজন ব্লগারের নামে উপন্যাসটি হওয়ায়, এবং আমি নিজে একজন ব্লগার হওয়ায় স্বভাবতই ব্লগারদেরকে সেখানে সবান্ধব/সবান্ধবী
আমন্ত্রণ জানানো হলো। এ নিয়ে ব্লগে একটা ‘আমন্ত্রণ পোস্ট – ‘অপি আক্তার’ উপন্যাসের মোড়ক উন্মোচন শীর্ষক একটা পোস্ট লেখা হলে ব্লগ অথোরিটি অত্যন্ত সদয় হয়ে সেটি সাড়ে তিন দিনের জন্য স্টিকি করেছিল, যাতে প্রায় শতেক দেড়শ কমেন্ট পড়ে। অনেক ব্লগারই উচ্ছ্বসিত, বইটি কিনতে চান বলে উল্লেখ করলেন। ব্লগের ফেইসবুক গ্রুপে একটা পোস্ট লেখা হলে সেটাতে আরো বেশি সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। মোড়ক উন্মোচনের দিন আমাদের দোহারের বিশ্ববিখ্যাত রসগোল্লা ও কালাইয়ের আমিত্তি আনার পরিকল্পনা ছিল আগে থেকেই। ব্লগারদের মধ্যে এত বেশি সাড়া পড়তে দেখে আমি একটু ভড়কে গেলাম – উপস্থিতির সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে তো রসগোল্লা আর আমিত্তি কম পড়ে যাবে। কীয়েক্টাবিদিকিচ্ছিরাবস্থায় পড়ে গেলে যাচ্ছেতাইশরমংকটাবস্থার সৃষ্টি হবে। ‘যা থাকে কপালে’ বলে ১০ কেজি রসগোল্লা আর ৮ কেজি আমিত্তি আনিয়েছিলাম- এক্কেবারে ফ্রেশ, আমার এক শ্যালক চুলার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করেছে। সুদৃশ্য মোড়কে মোড়ানো 'সুন্দরী ব্লগার অপি আক্তার' উপন্যাসের বান্ডিলগুলো একপাশে এক টেবিলের উপর, আরেকপাশে অন্য একটা টেবিলের উপর ১৮ কেজি রসগোল্লা ও আমিত্তির মনোহরী ১৮টি প্যাকেট সাজানো ছিল; এতে পুরো অনুষ্ঠানস্থলটি বেজায় উৎসবমুখর দেখাচ্ছিল।
যথাসময়ে মোড়ক উন্মোচন করা হলো। আমি ব্যক্তিগতভাবে মোবাইল করে ব্লগার খায়রুল আহসান, ড: এম এ আলী, আহমেদ জী এস, ঠাকুর মাহমুদ, কলাবরিষ্ঠা শায়মা হক, জুল ভার্ন, শাহ আজিজ ভাই, ম্যাভেরিক ওরফে মামুন অর রশিদ ভাই, কানাডা-ফেরত সোহানী আপা, নীল আকাশ, সাড়ে চুয়াত্তর, মনিরা সুলতানা আর বইমেলা উপলক্ষে অস্ট্রেলিয়া থেকে ৩৩ দিনের ছুটিতে আসা ডলি আপা ওরফে মিডলকে আমন্ত্রণ করেছিলাম। আমার ধারণা ছিল, সর্বকালের সেরা এই হাই-প্রোফাইল ব্লগারগণ আমার মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে হয়ত আসবেন না। কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে তারা সবাই যথাসময়ের অনেক আগেই মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে এসে উপস্থিত হলেন। তাদের উপস্থিতি আমাকে উদ্বেলিত করলো। কিন্তু ব্লগার রাজীব নুর, স্বপ্নবাজ সৌরভ, মরুভূমির জলদস্যু, মডেলহান্টার গোফরান ভাই, অপু তানভীর, মফিজ ভুইয়া, আখেনাটেন, পদ্মপুকুর, কামাল৮০ ভাই, নূর মোহাম্মদ নূরু ভাই, ফাতেমা ছবি আপা, আমার দেশের জুন আপা ও সেলিম আনোয়ার ভাইয়ের উপস্থিতি আমাকে আরো বেশি আনন্দ দিল। দুই ‘শূন্য’, সাবেক নিশাত ও বর্তমান ভার্চুয়াল তাসনিম, সৈয়দ মশিউর রহমান, পুরাতন ও নতুন নকিব, মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ভাই আসবেন, এটাও আমার ধারণার অতীত ছিল। তাদের মোবাইল নাম্বার না থাকায় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি। যোগাযোগ করলেও তারা যে ব্লগ ছেড়ে অফলাইন মঞ্চে আসবেন, সেটাও একটা সুদূরপরাহত সম্ভাবনা ছিল। তাদের দেখে আমি আনন্দে গদগদ হয়ে উঠলাম।
অনন্যসাধারণ এ ঘটনাটি আমাকে বিস্ময়াভিভূত করলো – যখন দেখলাম সুদূর কলকাতা থেকে পদাতিক চৌধুরী ভাই এসে হাস্যোজ্বল মুখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছেন- তার দিকে চোখ পড়তেই সামনে এগিয়ে এসে বুকে বুক মিলিয়ে বললেন, কেমন আছেন, সোনাভাই? আনন্দে কিছুক্ষণ আমার মুখে কোনো কথা ফুটলো না।
কিন্তু, আমার জন্য আরো বড়ো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। এক সুপুরুষ, সৌম্য চেহারার সুদর্শন, প্রেমিক বাবনিক, সমস্ত অবয়বে ঝলমলে হাসি ছড়িয়ে সুমধুর ছন্দে চরণ ফেলে এগিয়ে আসছিলেন। আমি যেন উড়ে গিয়ে তার সাথে বুক মেলালাম। আপনি কীভাবে এলেন, ইউক্রেনের যুদ্ধের আগুন পেরিয়ে? শেরজা তপন ভাই তার লেখার মতোই ঝরঝরে হাসির ঝরনা ছেড়ে দিয়ে বললেন, সোনা ভাই, আপনার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হবে, আর আমি তাতে শামিল হবো না, তা কি কখনো হতে পারে?
বাস্তবিক_ভালোবাসা ভাইয়াকে বিনীত অনুরোধ করেছিলাম, মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করার জন্য। তিনি তাতে সদয় সম্মতি দিয়েছিলেন। তার সুগ্রন্থিত, সাবলীল, ক্ষুরধার ও টু দ্য পয়েন্ট কমেন্টগুলোর মতোই সুস্পষ্ট, স্বতঃস্ফূর্ত ও সপ্রতিভ বাচনভঙ্গি ও বাগ্মিতায় উপস্থিত অডিয়েন্স সর্বদাই মুগ্ধ ও প্রীত। যে-কোনো অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত করে তোলার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তার।
তবে, সব মিলিয়ে ২৫-৩০ জন ব্লগার উপস্থিত হলেন। ব্লগারদের বাইরে আমার কয়েকজন শ্যালক-শ্যালিকা, তদীয় স্ত্রী ও স্বামীবর্গ, আমার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব উপস্থিত হলো। যত বড়ো জমায়েত হবে বলে ভেবেছিলাম, তত বড়ো হলো না ঠিক, কিন্তু ব্লগারদের ওজন বা শ্রেষ্ঠত্বের কথা চিন্তা করলে বলা যায়, পুরো ব্লগই মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন।
মহাসমারোহে, অতি ধুমধাম করে মোড়ক উন্মোচন শেষ হলে বইয়ের বান্ডিল খুলে একে একে সবার হাতে একটা করে বই দিতে লাগলাম। শ’ খানেক বই এনেছি মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে সৌজন্য কপি হিসাবে গিফট করার জন্য। সব ব্লগারের হাতে বই পৌঁছে দেয়ার মহান দায়িত্বটি হাতে তুলে নিলেন মেধাবী ব্লগার আর ইউ আর জনপ্রিয় ব্লগার রাজীব নুর। তারা একে একে ৩৭জন ব্লগার ও ১১ জন অন্যান্য অতিথির মধ্যে বইটি গিফট করলেন।
এরপরই রসগোল্লা ও আমিত্তি খাওয়ার পালা। আমার শ্যালক-শ্যালিকার সাথে মাইদুল ভাই যুক্ত হলেন রসগোল্লা আপ্যায়নে। আমি কৈশোর ও তারুণ্যে সহজেই ১০-১২টা আমিত্তি, রসগোল্লা, খেজুর বা বালুশাই খেতে পারতাম। অনেকে হয়ত আশ্চর্য হবেন, কিন্তু আমাদের এলাকায় পাটের মৌসুমে পাট বিক্রি করে রসগোল্লা খাওয়ার একটা চল ছিল, তাতে অনেকের কথাই শুনতাম, মাত্র দুই বা আড়াই সের রসগোল্লা খেয়েছে, এবং পাট বিক্রির প্রায় পুরো টাকাই চলে গেছে রসগোল্লা খেতে। আমাদের সামাদ মাদবর চাচার ছোটো ছেলে আবুল কালাম ১০-১২ বছর বয়সে এক বসায় আড়াই সের রসগোল্লা খেয়ে ফেলতো। আমার ঘনিষ্ঠতম ক্লাসমেট জসীম একবার বাজি ধরে আমাকে আমিত্তি খাওয়ানো শুরু করলো; আমি ১ সের খেতে পারি নি, ২ ছটাক কম ছিল, অর্থাৎ ১৪ ছটাক খেতে পেরেছিলাম। এরপর জসীমকে দেখলে ভয় পেতাম। ও যদি এবার প্ল্যান করে আমাকে আড়াই সের রসগোল্লা খাওয়ানোর অ্যাটেম্পট নেয়, তাইলে আমাকে খাটে করে জয়পাড়া বাজার থেকে বাড়িতে আনতে হবে।
কিন্তু মিষ্টি খাওয়ায় অতিথিদের পারফরমেন্স দেখে আমি অত্যন্ত মর্মাহত ও হতাশ হলাম। অনেকেই মিষ্টি খেলেন না; যারা খেলেন, তাদের কেউ কেউ মাত্র এক টুকরো করে খেলেন, কেউ কেউ আমিত্তির এক অংশ ভেঙে মুখে দিলেন। যিনি মিষ্টির বিরাট খাদক বলে নিজেকে প্রচার করেন, সেই বিখ্যাত জুল ভার্ন ভাই দেড়খানা রসগোল্লা আর আধখানা আমিত্তি খেয়ে মুখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বললেন, ‘অসাধারণ! অসাধারণ! সৈয়দ মুজ্তবা আলীর রসগোল্লা তো জয়পাড়ার রসগোল্লার কাছে কিছুই না দেখছি। আফসোস, তিনি এই রসগোল্লা খান নাই, খেলে তার গল্পটা আরো বেশি ‘সুস্বাদু’ হতো’।
সবাইকে খাওয়ানোর পরও ১৮ কেজি রসগোল্লা ও আমিত্তি থেকে পুরো ১৬টি প্যাকেটই আস্ত পড়ে রইল আমাদের সামনে। বইয়ের বান্ডিলের চাইতে তিনগুণ উঁচু হয়ে আছে মিষ্টির প্যাকেটের স্তূপ। আগের দিনে যে-কোনো উপলক্ষ পেলেই মানুষকে মিষ্টি মুখ করানো হতো। কিন্তু, আজকাল ডায়াবেটিস ও অন্যান্য কারণে মানুষ এত বেশি সচেতন যে, মিষ্টি মুখ করার তেজ ও আগ্রহ আর আগের মতো নেই। সবাই ঝাল মুখ চান; কেউ কেউ পারেন তো তিনবেলাই না খেয়ে থাকতে চান। আমি মনে মনে প্রিয় কবি সেলিম আনোয়ার ভাইকে খুঁজছিলাম; এই অঢেল মিষ্টি পরিস্থিতির মধ্যে তিনি কিছু মিষ্টি খেয়ে নিলে সারপ্লাসের পরিমাণটা কমতো। আমি গভীর দুঃখভারাক্রান্ত চোখে মিষ্টিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি - হায়, এগুলো কি এতই দুর্ভাগা, কারো উদরে এদের ঠাঁই মিলছে না! আহা! আমার জয়পাড়ার বিশ্ববিখ্যাত রসগোল্লারা না জানি মনে কত বেদনা ও আকুতি নিয়ে প্যাকেটের ভেতর ডুকরে ডুকরে কাঁদছে এখন!
'কী ভাবছেন, সোনাভাই!' ডানদিকে তাকিয়ে দেখি স্বপ্নবাজ সৌরভ।
'মিষ্টি নিয়া ভাবছেন? কোনো সমস্যা নাই। আমরা এগুলো এখনোই ডিসপোজ অফ করছি।' এ তো দেখি মাইন্ডরিডারও বটে! তিনি পাশে ঘুরে সাসুম আর রানা ভাইয়ের সাথে নীচু স্বরে কী যেন আলোচনা করলেন। মুহূর্তের মধ্যে ৭-৮ জনে একটা-দুটা করে প্যাকেট নিয়ে বের হয়ে গেলেন। ঘণ্টাখানেক পরেই ফিরে এসে বললেন, মিষ্টি কোনোদিন বেশি হয় নাকি? বইমেলার প্রত্যেকটা স্টলে মিষ্টি খাওয়াইছি, আর বইয়ের বিজ্ঞাপন দিয়েছি। এক কামে দুই কাম সারা - মিষ্টিও শেষ, বইয়েরও প্রচার হইল। আমি তো অবাক। এ বুদ্ধি নিশ্চয়ই সাসুম ভাইয়ের ছিল!
‘জটিলবাদ! জটিলবাদ!’
জটলার এক কোনা থেকে কে যেন মিষ্টি মধুর স্বরে কথাটা বলে উঠলেন। সবাই একযোগে সেদিকে তাকাতেই জটিল ভাই বলে উঠলেন, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। তারপর বলা নেই কওয়া নেই, গান গেয়ে উঠলেন – সোনাভাই আপনে আমারে করলেন যে দিওয়ানা …… আমি গানের মাঝখানে ফাঁক পেয়ে বললাম, ইয়ে জটিল ভাই, আমার নাম না নিয়ে গাইলে হয় না? একটু থেমে চোখ পিটপিট করে তাকালেন, আমিও যেভাবে হঠাৎ কোনো নতুন বুদ্ধি মাথায় এলে ভাবে পুলকিত হয়ে উঠি। ‘ইউরেকা’ বলেই তিনি তার লেখা ও আমার সুর করা গানটা গেয়ে উঠলেন… গান শেষে সবাই হাততালি দিতে থাকলো অনেকক্ষণ। আবেগে বেশি জোরে হাততালি দিতে যেয়ে ডলি আপা তার হাতের তালু ফাডাইয়া ফালাইলেন। ঢুকিচেপা তাড়াতাড়ি একটা রুমাল দিয়ে সেই হাত-ফাডার রক্ত বন্ধ করলেন।
অনেক গসিপ হলো এরপর। কেউ কেউ প্রকাশকের স্টলে জড়ো হলেন; কেউ কেউ ছোটো ছোটো দলে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ালেন। ব্লগারদের একটা মিলনমেলা যেন। এর মাঝে আরো কয়েকজন ব্লগার এসে যোগ দিয়েছেন, বইও নিয়েছেন। প্রামানিক ভাই আর 'কী যে করি ভেবে না পাই' সুর করে কোরাসে ছড়া কাটছিলেন। শাহাদাৎ উদরাজী ভাই নায়িকাদের মতো সুশ্রী ভাবীকে নিয়ে এসেছেন, এবং তিনি নারকেল দিয়ে স্যুপ ও লাউয়ের খাট্টা বানানোর রেসিপি বর্ণনা করছিলেন, কয়েকজন প্রমীলা ব্লগার খুব আগ্রহ নিয়ে সেই রেসিপি শুনছিলেন।
একটা ছেলে টি-শার্ট পরা, মাঝখানে সুন্দরী মেয়ের ছবি আঁকা, ঠোঁটজোড়া পুরো ও চওড়া, ছবিটা কিছুটা অ্যাডাল্ট হলেও দারুণ আর্টিস্টিক। বলুন তো, এ কবির নাম কী? হতে পারেন রূপক বিধৌত সাধু, হতে পারেন বিজন রায়, কিংবা স্প্যানকড। আপনারাই বলুন, তিনি কে! এটুকু ক্লু দিই, তিনি আলমগীর সরকার লিটন, কিংবা ইসিয়াক ভাই নন!
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে বিদায়ের জন্য আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি। স্টলে দু-তিনজন ব্লগার বসা ছিলেন। বাকিরা যে যার মতো ঘোরাঘুরি শেষ করে চলে গেছেন। আমি গোটা দশেক বইয়ের একটা বান্ডিল হাতে নিয়ে উপস্থিত ব্লগারদের কাছে শেষ শুভেচ্ছা জানাতে হাত বাড়ালাম। ডলি আপা বললেন, ওয়েট ধুলো, ইউ কা’ন্ট গো নাউ, ওয়েট ফর এ হোয়াইল।
হোয়াট! এইডা কোনো কথা অইলো! ওয়েট করবো কার লাইগ্যা? কেন, হোয়াই?
‘এই যে আমরা এসে গেছি সোনাবীজ ভাই।’ ঠাকুর মাহমুদ ভাইয়ের কণ্ঠ। পেছনে তাকিয়ে দেখি খায়রুল আহসান স্যার, ড: আলী ভাই, আহমেদ জী এস ভাইসহ প্রায় সব ব্লগার এসে জড়ো হয়েছেন।
খায়রুল আহসান স্যার বললেন, আমরা প্রত্যেকেই আপনার বইয়ের একটা করে কপি নিয়েছি। কেউ কেউ অবশ্য একাধিক কপিও নিয়েছেন। আমরা আপনার ‘সৌজন্য কপি’ই আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছি। তবে, বইয়ের মূল্য নয়, আপনার বইটা ছাপাতে যা খরচ হয়েছে, সেই খরচের ক্ষুদ্র একটা অংশ নিজেদের মধ্যেও ভাগ করে নিচ্ছি। আমি জানি, এটার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই আপনার। কিন্তু আপনি এটা গ্রহণ করলে আমরা খুব সম্মানিত বোধ করবো, এবং আমরা একটা দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি মনে করে খুব স্বস্তি বোধ করবো। তারপর তিনি একটা খাম আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এটা একটা ধরুন প্লিজ। এখানে ১৫ হাজার টাকা আছে।
সত্যি বলছি, আমার এ টাকার কোনো প্রয়োজন নেই। বইগুলো ছাপাতে আমার ৩৫ হাজার টাকা খরচ গেছে। প্রকাশক নিয়মানুযায়ী প্রতি বইয়ের মূল্য ২১০ টাকা করতে চেয়েছিলেন, আমি মোটামুটি জোর করেই এর দাম ধরেছি ১২০ টাকা, যাতে বেশিরভাগ পাঠক বইটি কেনার সুযোগ পান। আমি আরো ৫-৭ হাজার টাকা খরচ করে বিভিন্ন পাঠক বা ব্লগার বা ফেইসবুক ফ্রেন্ডের কাছে সৌজন্যসংখ্যা পাঠাব। বিভিন্ন লাইব্রেরিতে পাঠাব। বই বিক্রি থেকে আমি কোনো রিটার্ন কখনোই আশা করি না। আল্লাহ আমাকে এতটুকু সামর্থ দিয়েছেন। কিন্তু সবার তো এ সামর্থ নেই! নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে বই ছাপানোর পর বই বিক্রির রিটার্নের জন্য লেখকরা আকাশ সমান আকাঙ্ক্ষা বক্ষে ধারণ করে অপেক্ষা করতে থাকেন- ঠিক সেই সময়ে ব্লগারদের এরকম সম্মিলিত একটা প্রয়াস ঐ লেখকের বাসনা পূরণে ও মনোবল চাঙ্গা করতে কী পরিমাণ কাজে লাগবে, তা অনুধাবন করে ভক্তিতে এই ব্লগারদের প্রতি আমার মাথা নত হয়ে এলো, এবং আমার চোখ ভিজে যেতে থাকলো। সর্বাসাকুল্যে হয়ত ৫০টার মতো বই গিফট করা হয়েছে, ২০% কমিশন বাদে এগুলোর মূল্য ৫ হাজার টাকার মতো হয়; কিন্তু তারা আমাকে তিনগুণ টাকা বেশি দিচ্ছেন, ১৫ হাজার। নিশ্চয়ই এটা ব্লগারদের সম্মিলিত গোপন এবং মহৎ একটা পরিকল্পনার অংশ। আমার চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো ব্লগারদের এই বিরল ভালোবাসা ও আন্তরিকতা দেখে।
চলবে…
শুধু গেস করুন, পরের পর্বে কী হতে পারে!
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৫:৩৯