somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাজার বছরের বৈশাখী উৎসব এবং নব্য সংযোজিত ও বিতর্কিত মঙ্গল শোভাযাত্রা

১৫ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১১:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার ছোটোবেলা থেকেই আমি ১লা বৈশাখ উদ্‌যাপিত হতে দেখে আসছি। তবে, এটা এখনকার মতো ছিল না। তখন আমরা এটাকে ১লা বৈশাখও বলতাম না। হালখাতা (আরেকটা কী যেন আঞ্চলিক নাম ছিল বলে ঝাপসা মনে পড়ে) এবং চৈত্রসংক্রান্তি বলেই জানতাম। ১লা বৈশাখের দিন সারা বাজার জুড়ে হালখাতার আমেজ থাকতো। মানুষের যত বকেয়া আছে, তা দোকানে গিয়ে পরিশোধ করতো, আর দোকানি তাদের মিষ্টি মুখ করাতো।



ছবি : উইকিপিডিয়া

আমার যদ্দূর মনে পড়ে, চৈত্র সংক্রান্তির দিন (চৈত্র মাসের শেষ দিন) ও হালখতার দিন (১লা বৈশাখ) - এই দুইদিনই গ্রামে গ্রামে মেলা বসতো। বড়ো মেলা, ছোটো মেলা। আমাদের এলাকায় সেই সময় বড়ো বড়ো গৃহস্থ বাড়িতে পাগলা ষাঁড় পোষা হতো চৈত্র সংক্রান্তির দিনে বড়ো মেলায় কাছি (রশি) ছেঁড়ানোর জন্য (কাছি ছেঁড়ানোর আরেকটা দিন ছিল কোরবানি ইদের দিন)। আর ছিল ঘোড়দৌড়। আমরা দলে দলে পাগলা ষাঁড়কে দাবড়ে নিয়ে যেতাম মেলার দিকে, আর ছিল গগনবিদারী শ্লোগান। যে ষাঁড় যত মোটা রশি ছিঁড়তে পারতো, সেই ষাঁড়ের মালিকের নাম তত বেশি প্রচার পেত। আমাদের গ্রামে হালিম মামাদের বাড়িতে এক দুর্দান্ত পাগলা ষাঁড় ছিল। চৈত্র সংক্রান্তির দিন আমাদের এলাকার বিখ্যাত নূরপুরের মাঠে বিরাট মেলা বসতো। সেই মেলায় পাগলা ষাঁড়ের কাছি ছেঁড়ার প্রতিযোগিতা হতো। মাঠের মাঝখানে মাটিতে গর্ত করে গাড়া হতো মোটা একটা খুঁটি। পাগলা ষাঁড়ের রশিটি বাঁধা হতো সেই খুঁটির গোড়ায়। তারপর ষাঁড়ের চোখের সামনে লাল কাপড় দেখিয়ে কিংবা পেছন থেকে একযোগে চিৎকার করে ষাঁড়কে দাবড়ানি দেয়া হতো; ষাঁড়টা প্রচণ্ড জোরে দৌড় দিত এবং এক দৌড়েই কাছি ছিঁড়ে গেলে সবাই আনন্দে শোরগোল করে উঠতো। হালিম মামাদের ষাঁড়ের সাথে নূরপুরের মাঠ, নারিশা মাঠ, এমনকি কোমরগঞ্জেও একবার গিয়েছিলাম আমরা। মাঠের অন্যদিকে লম্বালম্বি একটা জায়গায় ঘোড়দৌড় হতো। এক মাথা থেকে আরেক মাথায় তেজী ঘোড়া দাবড়ে নিয়ে যেত ঘোড়সওয়ার; ওটাও খুব মজা করে দেখতাম।

মেলা বসতো দুপুরের পর থেকে। কিছু মেলা সকাল থেকেই শুরু হতো।

কলেজ জীবনে ঢাকায় অবশ্য আজকের মতো এমন সাড়ম্বরে ১লা বৈশাখ উদ্‌যাপন হতে দেখি নি (আমি ১৯৮৪ সালে ঢাকা আসি, ঢাকা কলেজ)। তবে, ১৯৮৫-তে শিল্পকলা একাডেমীর সন্ধ্যার অনুষ্ঠান, বিকালে বাংলা একাডেমীর বটতলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এখনো আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল ফুটে আছে। বাংলা একাডেমীর অনুষ্ঠানে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গান সামনে দর্শক-সারিতে বসে প্রথম শুনি। সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমীতে দেখা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি আমার জীবনের সেরা অনুষ্ঠানের একটি। 'হিটলার নিপাত যাক' নামক একটা অসাধারণ নাটক হয়েছিল, এরশাদবিধ্বংসী নাটক, যার সিকোয়েন্সগুলোও মনে পড়ে।

২০০৪ বা ২০০৫ সালে রমনায় ১লা বৈশাখের মেলায় যাই। মানুষের সমুদ্র। পা ফেলার জায়গা নাই। আর কখনো গিয়েছিলাম কিনা মনে পড়ে না। এ সময়ে ঢাকা শহরের অন্যান্য জায়গায়ও মেলা হতে দেখেছি, তবে, সেগুলো সবই গ্রামীণ মেলার আদলে আয়োজিত মেলা ছিল।

আমাদের গ্রামাঞ্চলে এভাবেই বৈশাখ উদ্‌যাপিত হতে দেখেছি। বিভিন্ন গবেষণা ও স্টাডিপত্র থেকে বাংলার ১লা বৈশাখের হাজার বছরের ঐতিহ্য এ রকমই ছিল, বর্তমানে যেভাবে করা হচ্ছে এটা হাজার বছরের ঐতিহ্য না।

১লা বৈশাখ উপলক্ষে ঘরে ঘরে নানান পদের খাবার, বা পান্তা ভাতে ভাজা ইলিশ খাওয়ার কোনো রেওয়াজ আমি কোথাও কোনোদিন দেখি নি। এই যে ১লা বোশেখের দিন সকালবেলা পান্তাভাত রান্না করে ভাজা ইলিশ দিয়ে খাওয়া - এই উদ্ভট খাদ্যাভাস কোনোদিনই বাঙালির ছিল না। পৌষ-মাঘ-ফাল্গুন-চৈত্রে নদীতে পানি কমে যায়, ইলিশ ধরা পড়ে খুবই অল্প, বর্তমান কালে বঙ্গোপসাগরের ইলিশের প্রাচূর্যের যুগেও যেখানে ইলিশ সব মানুষের নাগালের মধ্যে নেই, সেই যুগে এত অল্প পরিমাণ ইলিশ কখনোই সাধারণ মানুষের আয়ত্তে ছিল না (তখন বঙ্গোপসাগরের ইলিশ এত ব্যাপক হারে ধরা হতো না, সারাদেশে সাপ্লাইও হতো না)। শুকনো মৌসুমে বাজারে অন্যান্য মাছেরও প্রাচূর্য ছিল না, কারণ, তখন আজকের মতো মাছ চাষ হতো না। তো, এমন মৎস সংকটের যুগে সাধারণ মাছ কিনে খাওয়াই যেখানে সাধারণ মানুষের পক্ষে ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার, সেখানে নিয়মিত ইলিশ মাছ খাওয়া, তার উপর সকালবেলা পান্তাভাতের সাথে ইলিশ ভাজা খাওয়া ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। তবে, সচ্ছল পরিবারের কথা আলাদা। আমাদের মতো অসচ্ছল পরিবারের মানুষও যে কোনোদিন সকালবেলা পান্তার সাথে ভাজা ইলিশ খায় নি, ব্যাপারটা তেমন না, তবে, তা হয়ত কালেভদ্রে ঘটে যেত, কিন্তু তা অবশ্যই নিয়মিত অভ্যাসের মধ্যে পড়ে না এবং তা কখনো বাঙালিদের হাজার বছরের ঐতিহ্য হতে পারে না।

এই কৃত্রিম পান্তা-ইলিশ কালচারের বয়সও খুব বেশিদিন হয় নি। আমি সর্বপ্রথম সকালবেলার পান্তা ইলিশের দাওয়াত পাই ২০০৮ সালে। জনৈক ইউএনও মহোদয় একদিন হুট করেই আমার অফিসে এসে উপস্থিত, তিনি ১লা বোশেখে পান্তা-ইলিশের আয়োজন করেছেন, আমি সেখানে চিফ গেস্ট, আমাকে যেতেই হবে। ততদিনে অবশ্য বাংলাদেশে ডিশ অ্যান্টেনা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে; তার কয়েক বছর আগে থেকেই ১লা বোশেখের ইলিশ-পান্তা ও ১লা বোশেখ ব্যাপকভাবে উদ্‌যাপনের খবরাখবর ডিশ চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে আসছে। ... পরদিন যথাসময়ে পান্তা-ইলিশ-ভোজ অনুষ্ঠানে যেয়ে দেখি বিরাট ব্যাপার। মাটির বাসনে নিটোল তরল পানিতে ঝকঝকে সাদা ভাত টলটল করে ভাসছে। বাসনের এক ধারে একখানি ভাজা ইলিশ পান্তায় অর্ধেক ডুবে আছে।

সেকালে সচ্ছল পরিবার এবং যে-পরিবারে সদস্যসংখ্যা বেশি ছিল, তাদের হয়ত প্রতিবেলাই রান্নাবান্না করতে হতো। কিন্তু অসচ্ছল পরিবারে বিকালে রেঁধে বিকালে ও রাতে খাওয়া হতো; অবশিষ্ট ভাতে পানি দিয়ে রাখা হতো সকালে খাওয়ার জন্য। ভাতে পানি দিলে ভাত নষ্ট হতো না বা পঁচতো না। তখন রেফ্রিজারেটর ছিল না বলে এ কাজ করা হতো।

আমাদের মতো সাধারণ ও অসচ্ছল পরিবারে দেখেছি, সকাল বেলার জন্য সামান্য একটু তরকারি, লাউ মেশানো ডাল, বা টক হয়ে যাওয়া ডাল অবশিষ্ট থাকে; এ দিয়ে সবটুকু পান্তা খাওয়া যায় না। তখন প্রয়োজন পড়ে কাঁচামরিচ, শুকনা মরিচ পোড়া, লবণ আর পেঁয়াজ। সম্ভব হলে আলুভর্তা বা বেগুন ভর্তা, কিংবা ধইন্যাপাতা ভর্তা।

পান্তা ভাতের সাথে পেঁয়াজ, লবণ আর কাঁচামরিচ বা শুকনামরিচ পোড়া মাখালে যে তা স্বাদ লাগে বা উপাদেয় হয়, এ জিনিসটা যিনি আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি খুব মহান ব্যক্তি বা ব্যক্তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহে। এ খাবারটা এত স্বাদের বলেই আবহমান কাল ধরে অসচ্ছল, কিংবা সচ্ছল বাঙালিরা এটা খেয়ে আসছিলেন এবং জনপ্রিয়তাও লাভ করেছিল।

বর্তমানে ১লা বৈশাখে ঢাকায় যে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়, তা শুরু হয়েছে ১৯৮৯ সালের দিকে। শুরুতে এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। হাজার বছর ধরে দুই বাংলায় ১লা বৈশাখ, হালখাতা বা চৈত্র সংক্রান্তিতে মেলা, গান-বাজনা, ইত্যাদি সহযোগে নববর্ষ উদ্‌যাপনের ইতিহাস থাকলেও বহুল বিতর্কিত ও অধুনা সংযোজিত আনন্দ শোভাযাত্রা, বৈশাখী শোভাযাত্রা বা মঙ্গল শোভাযাত্রার কোনো ইতিহাস নেই। উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায় যে, ১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরূদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একইসঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম আনন্দ শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। ঐ বছরই ঢাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এই আনন্দ শোভাযাত্রা। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এই আনন্দ শোভাযাত্রা বের করার উদ্যোগ প্রতি বছর অব্যাহত রাখে।

শোভাযাত্রার অনতম আকর্ষণ - বিশালকায় চারুকর্ম পুতুল, হাতি, কুমীর, লক্ষ্মীপেঁচা, ঘোড়াসহ বিচিত্র মুখোশ এবং সাজসজ্জ্বা, বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য। পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু থেকেই জনপ্রিয়তা পেয়ে আসছে। পরের বছরও চারুকলার সামনে থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়। তবে সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী জানা যায়, ঐ বছর চারুশিল্পী সংসদ নববর্ষের সকালে চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে বর্ণাঢ্য আনন্দ মিছিল বের করে। শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না।

মাহবুব জামাল শামীম নামক শুরুরদিকের একজন অংশগ্রহণকারীর কাছ থেকে জানা যায়, পূর্বে এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। সেই সময়ের সংবাদপত্রের খবর থেকেও এমনটা নিশ্চিত হওয়া যায়। সংবাদপত্র থেকে যতোটা ধারণা পাওয়া যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম লাভ করে।

১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে চারুপীঠ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল - পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যযন্ত্রসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে।

১৯৮৯ সালে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের আনন্দ শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিল্পীদের উদ্যোগে হওয়া সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পীগণ-সহ সাধারণ নাগরিকরা অংশ নেয়।

শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশখচিত প্ল্যাকার্ড। মিছিলটি নাচে গানে উৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দ শোভাযাত্রার সম্মুখে রং বেরংয়ের পোশাক পরিহিত ছাত্র-ছাত্রীদের কাঁধে ছিল বিরাট আকারের কুমির। বাঁশ এবং বহু বর্ণের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল কুমিরটি। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘১৪০০ সাল উদ্‌যাপন কমিটি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর চারুকলা ইন্সটিটিউটের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রার আকর্ষণ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। চারুকলার সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় দিয়ে শিশু একাডেমি হয়ে পুনরায় চারুকলায় এসে শেষ হয়।

২০১৭ সাল থেকে কলকাতার ‘বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন পরিষদ’-এর উদ্যোগে কলকাতায় মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২১ সালেও আয়োজন করা হয়। কলকাতার গাঙ্গুলিবাগান থেকে শুরু হয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাপীঠ ময়দানে যেয়ে শেষ হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। এছাড়াও বেশ কয়েকটি মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। দুই বাংলার শিল্পীদের আকা নানান জিনিস থাকে সেই শোভযাত্রায়।

বাংলা নববর্ষ পালনের রেওয়াজ সুদূর অতীত হতে চলে আসছে কলকাতায়। তবে বাংলাদেশে যেভাবে ঘটা করে বাংলা নববর্ষ পালন হয়, সেভাবে কলকাতায় হতো না। এখন হচ্ছে। বাংলাদেশে যে প্রাণের ছোঁয়া আর আবেগ ভরা অনুষ্ঠান ও নববর্ষের মেলা হয়, ইলিশ-পান্তা থেকে চিড়া-মুড়ি-বাতাসা আর দই-মিষ্টি খাওয়ার রেওয়াজ। সেটি এখন কলকাতায়ও শুরু হয়েছে।

২০২৩ সালে ০৯ এপ্রিল একজন বাংলাদেশী আইনজীবী মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে আইনি নোটিশ দেন। তিনি ‘মঙ্গল’ শব্দটি একটি ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট শব্দ এবং বৃহৎ আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার দাবি করেন।
এ আইনি নোটিশের প্রেক্ষিতেই এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রা বিতর্কিত হয়ে পড়ে, যদিও আগের বছরগুলোতেও এ শোভাযাত্রা বা যে-কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনেই কিছু মুসলমান ধর্মাবলম্বী আপত্তি তুলে আসছিলেন। এ মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে পুরো বাংলাদেশে এখন প্রধানত দুইটি মতামত বা দল মুখোমুখী দাঁড়িয়ে গেছে। একদল এ মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য বলে এটা অবশ্যই পালন করতে হবে, এমন দৃঢ়চেতা ও যুদ্ধংদেহী মূর্তি ধারণ করেছেন। আমাদের সনাতন ধর্মের বন্ধুরা মুখে এটাকে হাজার বছরের ঐতিহ্য বললেও অন্তরে অন্তরে এটাকে তাদের নিজ ধর্ম পালনের একটা উৎসব বলে মনে করতে থাকেন। মুসলমানদের মধ্যে আবার মোটামুটি তিনটা দল দেখা যায় - একদল এটাকে কোনোভাবেই সমর্থন করছেন না, হোক সেটা মঙ্গল শোভাযাত্রা, কিংবা বৈশাখী মেলা বা বৈশাখী অনুষ্ঠানমালা, এগুলো পালন করা ইসলাম ধর্মমতে নাজায়েজ বলে তারা এটা পালন করতে দিতে চান না। আরেকদল - যা খুশি তাই হোক, আমার ইচ্ছে হলে আমি যাব, ইচ্ছা না হলে আমি যাব না। এরা আসলে মডারেট গোষ্ঠী (সত্যি বলতে কী, আমি এই দলেই)। আরেক দল আছে, তাদের কথাবার্তা শুনে কখনো মনে হয় বলদ, আবার কখনো মনে হয় তারা কারো পক্ষে বুঝে অথবা না বুঝে দালালি করছেন। এরা কোথায় যে পাইছে 'হাজার বছরের সংস্কৃতি' নামক একটা শব্দ, তা না বুঝেই গড়গড় করে এই বুলি ছাড়তে থাকে, আর 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' পালনের জন্য যে-কোনো মূল্যে তারা প্রস্তুত। আমাদের সনাতনী বন্ধুদের একটা মাত্র দল - তারা এ টু জেড এ 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' বাস্তবায়ন করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, এটা বাস্তবায়ন করার জন্য তারা যেন যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছেন এবং সফল না হওয়া পর্যন্ত এ সংগ্রাম তারা চালিয়ে যেতেই থাকবেন, এতখানিই উগ্র মনোভাব তাদের মধ্যে দেখা গেল, কারণ, এটা তাদের ধর্মীয় রিচুয়াল পালনের অংশ। আমাদের স্বধর্মীয় দালাল শ্রেণির বন্ধুরা স্বধর্মীয় মৌলবাদীদের প্রতিহত করতে যেয়ে নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে নিজেদের অজান্তেই সনাতনী মৌলবাদীদের ধর্মীয় রীতিতে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছেন, এটা বুঝতেই পারছেন না।

আমাদের যা খুশি তাই পালনের স্বাধীনতা আছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা বা আনন্দ শোভাযাত্রায় শামিল হওয়ার ইচ্ছা যদি আমার হয়, আমি যাব, যার ইচ্ছা হবে না, সে যাবে না। কিন্তু দুইদিনের একটা শোভযাত্রাকে হাজার বছরের ঐতিহ্য বলা শুধু বলদামিই না, ভণ্ডামি এবং অন্যায়ও। তেমনি এক ধর্মের মৌলবাদীদের প্রতিহত করতে যেয়ে আপনি অন্য ধর্মের মৌলবাদীদের ধর্মীয় রীতিতে ডুবে যাচ্ছেন, আর সেটাকে বাঙালি সংস্কৃতি বলছেন, এটাও তেমনি বলদামি ও অন্যায়। এর অর্থ হলো, আপনি মৌলবাদীদের বিরুদ্ধাচরণ করতে যেয়ে নিজেই মৌলবাদী হয়ে যাচ্ছেন।

নিজের সার্বজনীন বাঙালি অস্তিত্ব নিয়ে বাঁচতে শিখুন।

সূত্র : উইকিপিডিয়া - মঙ্গল শোভাযাত্রা




চাইলে পড়তে পারেন :

পহেলা বৈশাখ – আমাদের আসল খাদ্যসংস্কৃতি বনাম কৃত্রিম ইলিশ-সংস্কৃতি। ব্লগার ও ফেইসবুকারদের মতামত ভিত্তিক সমীক্ষা

শূন্য থেকে বাংলা সন শুরু হয় নি। ৯৬৩ হিজরির ১ মহররম=৯৬৩ বাংলা সনের ১ বৈশাখ
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৩ সকাল ১১:১৪
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা শহর ইতিমধ্যে পচে গেছে।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



স্থান: গুলিস্থান, ঢাকা।

ঢাকার মধ্যে গুলিস্থান কোন লেভেলের নোংড়া সেটার বিবরন আপনাদের দেয়া লাগবে না। সেটা আপনারা জানেন। যেখানে সেখানে প্রসাবের গন্ধ। কোথাও কোথাও গু/পায়খানার গন্ধ। ড্রেন থেকে আসছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×