১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে মুগল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন বলে বেশিরভাগ পণ্ডিত মনে করেন। ঐ সময়ে বঙ্গে শক বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হতো, যার প্রথম মাস ছিল চৈত্র। বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রথমে ‘তারিখ-ই-এলাহী’ বা ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল। ১৫৮৪ সালের ১০ বা ১১ মার্চ তারিখে এটি ‘বঙ্গাব্দ’ নামে প্রচলিত হয়। এ নতুন সালটি সম্রাট আকবরের রাজত্বের ২৯তম বর্ষে প্রবর্তিত হলেও তা গণনা করা হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে। সম্রাট আকবর ৯৬৩ হিজরী, ১০ রবিউল আউয়াল, রোজ শুক্রবার, ১৪৭৯ শাকাব্দ, ১৬১৪ বিক্রমাসম্ভাত, এবং ইংরেজি ১৫৫৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। একই বছর, অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর, এবং ৯৬৪ হিজরির ১ মুহররম তারিখে মাত্র ১৩ বছর বয়সে সম্রাট হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্যকে ২য় পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত করেন। পানিপথের যুদ্ধে সম্রাট আকবরের বিজয়কে মহিমান্বিত করে রাখবার জন্য, এবং অধিকতর পদ্ধতিগত উপায়ে রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশে এ বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়েছিল। সম্রাট যে মাসে সিংহাসনে অরোহণ করেন, তার নিকটতম হিজরি বছরের ১ম মাসকে ভিত্তি ধরা হয়। ৯৬৩ হিজরির ১ মহররম ছিল নিকটতম। ঐ বছর শকাব্দের ১ বৈশাখ এবং হিজরির ১ মহররম একই দিনে এসেছিল। বৈশাখ হলো শকাব্দের ২য় মাস, চৈত্র ১ম মাস। ৯৬৩ হিজরির ১ মহররমকে বাংলা ৯৬৩ সনের ১ বৈশাখ পরিচিহ্নিত করে বাংলা সন শুরু করা হয়। অর্থাৎ ১, ২, ৩ - এভাবে হিসেব না করে মূল হিজরি সনের চলতি বছর থেকেই বাংলা সনের গণনা শুরু হয়। ফলে জন্ম বছরেই বাংলা সন ৯৬৩ বৎসর বয়স নিয়ে যাত্রা শুরু করে। উল্লেখ্য, হিজরি সনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। মহানবী (সা.) স্বয়ং আনুষ্ঠানিকভাবে হিজরি সন চালু করেন নি। এটি প্রবর্তন করেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে। হিজরি সনের ক্ষেত্রে যে রকম হিজরতের দিন ও মাস (১২ রবিউল আউয়াল) সুনির্দিষ্টভাবে অবলম্বন না করে শুধুমাত্র সালটিকেই (৬২২ খ্রিস্টাব্দে) সংরক্ষণ করা হয়, বাংলা সনের ক্ষেত্রেও তেমনি সম্রাট আকবরের রাজ্যাভিষেকের দিন ও মাস (১৪ইং ফেব্রুয়ারি) অবলম্বন না করে শুধুমাত্র বৎসরটি (৯৬৩ হিজরি) সংরক্ষিত হয়। হিজরি সনের প্রথম দিন হলো পহেলা মহররম। বাংলা সনে তা পরিবর্তন করে পহেলা বৈশাখ করা হয়।
৯৬৩ হিজরির ১ মহররম তারিখ ছিল ৯৬৩ বাংলা সনের ১ বৈশাখ। কিন্তু, আজ হলো ১৪১৮ বাংলা সনের ১লা বৈশাখ, যে হিসেবে বাংলা সন প্রবর্তনের বয়স ১৪১৮ - ৯৬৩=৪৫৫ বছর। অথচ, বর্তমান হিজরি ১৪৩২ সনের হিসেবে ১৪৩২-৯৬৩=৪৬৯ বছর পার হয়ে গেছে বাংলা সন প্রবর্তনের তারিখ থেকে। ৪৬৯ - ৪৫৫=১৪ বছরের তারতম্য কেন হলো? কোথায় গেলো এই ১৪ বছর?
খুব সরল হিসাব। হিজরি সন চান্দ্রবছর ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে হয়, বাংলা সন ৩৬৫ দিন হিসাবে গোনা হয়। তাহলে বাংলা সন প্রবর্তনের ৪৫৫ কে ৩৬৫ দিয়ে গুণ করলে দাঁড়ায়, ৪৫৫x৩৬৫=১৬৬০৭৫ দিন। এবার এটাকে হিজরি বছরে কনভার্ট করুন ৩৫৪ দিয়ে ভাগ করে; ১৬৬০৭৫÷৩৫৪=৪৬৯ বছর। ৪৬৯ বছরকে ৯৬৩ সনের সাথে যোগ করলে আপনি বর্তমান হিজরি সন ১৪৩২ পেয়ে যাচ্ছেন।
৯৬৩ হিজরি সনে, অর্থাৎ ৯৬৩ বাংলা সনে ১৫৫৬ খ্রিস্টীয় সন ছিল। ১৫৫৬ – ৯৬৩= ৫৯৩। পার্থক্য ৫৯৩ বছরের। এখন ২০১২ খ্রিস্টীয় এবং আজ ১৪১৯ বাংলা সন। ২০১২ – ১৪১৯=৫৯৩। অর্থাৎ এখনো খ্রিস্টীয় এবং বাংলা সনের মধ্যে পার্থক্য ৫৯৩ বছর। পূর্বে ইংরেজি সনের মতো বাংলা সনে কোনো লিপ-ইয়ার ছিল না। ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি বঙ্গাব্দ সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। উক্ত কমিটি চার বছর পরপর চৈত্র মাস ৩০ দিনের পরিবর্তে ৩১ দিনে গণনা করার পরামর্শ দেয়।
উপরের অংশটুকু নিচের সূত্রাবলম্বনে লিখিত :
বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ :
৫ম খণ্ড - পহেলা বৈশাখ
৬ষ্ঠ খণ্ড - , বাংলা বর্ষপঞ্জি
সৈয়দ আশরাফ আলী
বাংলা নববর্ষের ইতিহাস : Click This Link
এবং (ইংরেজি) : Click This Link
উইকিপিডিয়া :
বাংলা ক্যালেন্ডার : http://en.wikipedia.org/wiki/Bengali_calendar
পহেলা বৈশাখ : http://en.wikipedia.org/wiki/Pohela_Boishakh
পহেলা বৈশাখ (বাংলায়) : Click This Link
হিজরি-ইংরেজি তারিখ কনভার্সন : http://www.islamicfinder.org/Hcal/index.php
বাংলা পঞ্জিকা
বাংলা পঞ্জিকা পূর্বে জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থ হিসাবে ব্যবহৃত হতো। এখন পঞ্জিকায় বর্ষফল, মাসফল, রাশিফল প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। বাংলায় পঞ্জিকা প্রকাশের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ধারণা করা হয় রঘুনন্দন প্রথম পঞ্জিকা গণনা করেন। এর পর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে পঞ্জিকা গণনা আরো প্রসারিত হয়। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা প্রথম মুদ্রিত হয়। এরপর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে পঞ্জিকা সংস্কার করে মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা। ১৯৫৭ সালে ভারত সরকারের অধীনে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সভাপতিত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে পঞ্জিকার সংস্কার হয় এবং এই সংস্কারপ্রাপ্ত পঞ্জিকা বা বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকাই ভারতের রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত হয়।
নবপ্রণীত পঞ্জিকা
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সকল পঞ্জিকাই প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ সূর্যসিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হতো। কিন্তু সূর্যসিদ্ধান্তের কিছু ত্রুটির কারণে সেই গ্রন্থ অনুসারে নির্ণীত তিথি, নক্ষত্র, ইত্যাদির সময়ের সাথে মহাকাশে ঘটিত প্রকৃত তিথি নক্ষত্রের সময়ের কিছু পার্থক্যের সৃষ্টি হচ্ছিল। তখন গণিতজ্ঞ মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সূর্যসিদ্ধান্তের সংস্কার ঘটিয়ে একটি সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত পঞ্জিকা নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা।
১৯৫২ সালে ভারত সরকারের উদ্যোগে গঠিত পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি (Calendar Reform Committee) ভারতীয় পঞ্জিকাগুলিতে সংস্কারসাধন করে যে নতুন রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ প্রণয়ন করে সেই পঞ্জিকার বিজ্ঞানভিত্তিক গণনার সাথে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার গণনা সম্পূর্ণ এক। উভয় পঞ্জিকাতেই নির্ভুল ভাবে তিথি, নক্ষত্র, ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই পঞ্জিকাকে স্বীকৃতি প্রদান করে এটি গ্রহণ করেছে। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সকল শাখা, অনুকূলচন্দ্র ঠাকুরের সৎসঙ্গ আশ্রম, তারকেশ্বর মন্দির, কাঞ্চী মঠ, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সমস্ত অনুষ্ঠান বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে পালিত হয়।
সহযোগী বর্ষপঞ্জি
বঙ্গাব্দ গণিত হয় হিন্দু সৌর পঞ্জিকানুসারে, যেটি আবার সূর্য সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। হিন্দু সৌর পঞ্জি শুরু হয় মধ্য এপ্রিলে। বাংলাদেশের (বাংলাদেশে সংশোধিত বঙ্গাব্দানুসারে নববর্ষ পালিত হয) বাইরে পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, কেরল,মণিপুর, নেপাল, ওড়িশা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু এবং ত্রিপুরায় এই বর্ষপঞ্জির প্রথম দিনকেই নতুন বর্ষের শুরু হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। নববর্ষ আবার মেষ সংক্রান্তি হিসেবেও পরিচিত।
ভাস্করাব্দ
ভাস্করাব্দ পূর্ব ভারতের অসমে প্রচলিত সৌর অব্দবিশেষ। এটির সঙ্গে বঙ্গাব্দের বিশেষ সাদৃশ্য আছে।
সৌর ভাস্করাব্দের বারটি মাস এবং তাদের দৈর্ঘ্য নিচে দেখুন:
ক্রম নাম অসমীয়া দিনসংখ্যা
১ বৈশাখ বহাগ ৩০/ ৩১
২ জ্যৈষ্ঠ জেঠ ৩১ / ৩২
৩ আষাঢ় আহাৰ ৩১ / ৩২
৪ শ্রাবণ শাওন ৩১ / ৩২
৫ ভাদ্র ভাদ ৩১ / ৩২
৬ আশ্বিন আহিন ৩০ / ৩১
৭ কার্তিক কাতি ২৯ / ৩০
৮ অগ্রহায়ণ অঘোণ ২৯ / ৩০
৯ পৌষ পুহ ২৯ / ৩০
১০ মাঘ মাঘ ২৯ / ৩০
১১ ফাল্গুন ফাগুন ২৯ / ৩০
১২ চৈত্র চ’ত ৩০ / ৩১
এই অব্দে নববর্ষারম্ভ হয় সৌর বৈশাখ মাসের প্রথম দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ। মহাসমারোহে এই দিন সমগ্র অসমে পালিত হয় বিহু উৎসব।
সূত্র : Click This Link
পহেলা বৈশাখ
বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে দু'টি মত চালু আছে৷ প্রথম মত অনুযায়ী - প্রাচীন বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খৃষ্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন৷ সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে শশাঙ্ক বঙ্গদেশের রাজচক্রবর্তী রাজা ছিলেন। আধুনিক ভারতের বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার অধিকাংশ এলাকা তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনুমান করা হয় যে, জুলিয়ান ক্যালেণ্ডারের সোমবার ১২ এপ্রিল ৫৯৪ এবং গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডারের সোমবার ১৪ এপ্রিল ৫৯৪ বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল।
দ্বিতীয় মত অনুসারে, মধ্যযুগে বাংলা সনের প্রচলনের আগে কৃষি ও ভূমি কর বা খাজনা আদায় করা হতো ইসলামিক হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে। কিন্তু চাষাবাদ করা হতো সৌর বছর অনুযায়ী। হিজরি বর্ষপঞ্জি চান্দ্রমাস নির্ভর বলে সব সময় কৃষি কর্মকাণ্ড অর্থবর্ষের সাথে মিলতো না। কারণ চন্দ্র ও সৌর বছরের মধ্যে ১১ বা ১২ দিনের পার্থক্য ছিল। ফলে ৩১ টি চন্দ্র বছর ৩০ টি সৌর বছর এর সমান হয়ে যেতো। তাতে কৃষিজীবীদের ফসলহীন ঋতুতে কর বা খাজনা দেবার জন্য বাধ্য করা হতো। সম্রাট আকবর তাঁর শাসনের প্রথমেই এই সমস্যা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং এর একটি বৈজ্ঞানিক কিন্তু কার্যকর সমাধান খুঁজছিলেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মহান মুঘল সম্রাট আকবর (শাসনকাল ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দ হতে ১৬০৫ খৃষ্টাব্দ) বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী ও রাজকীয় জ্যোর্তিবিদ আমির ফতেউল্লাহ্ সিরাজী চান্দ্রমাস নির্ভর হিজরি বর্ষপঞ্জি এবং সৌরমাস নির্ভর হিন্দু বর্ষপঞ্জি গবেষণা করে একটি নতুন বর্ষপঞ্জি প্রস্তাব করেন। এর ফলেই সূচনা হলো বাংলা বর্ষপঞ্জির বা বাংলা সনের। বাংলা সনের সূচনা হয় ফসল তোলার সময়ে যখন কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে বছরের অন্য সময়ের চাইতে সচ্ছল থাকে। নতুন বর্ষপঞ্জি প্রথম দিকে ফসলী সন হিসেবে পরিচিত ছিল।
সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ বা ৯৯২ হিজরিতে ফরমান জারি করেন নতুন ফসলি বা বাংলা সনের, কিন্তু ৯৬৩ সন থেকে কার্যকর করা হয়। ১০ রবিউল আওয়াল ৯৬৩ হিজরিতে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন, ৯৬৪ হিজরির ১/২ মহররমে ২য় পানিপথের যুদ্ধে বিজয় লাভ করেন। এ ঘটনাকে গৌরবান্বিত ও স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১০ রবিউল আউয়ালের নিকটতম হিজরি নতুন বছরের প্রথম দিনটি হয় ১ মহররম ৯৬৩। অতএব, ১ মহররম ৯৬৩ তারিখকে তারিখ-ই-ইলাহী সনের ১ম দিন ও ১ম মাস ধরা হয়। তখন শাকাব্দের বৈশাখ মাস চলমান ছিল, এবং বৈশাখ হলো শাকাব্দের ২য় মাস। এই বৈশাখ মাসকেই বাংলা বা ফসলি সনের ১ম মাস হিসেবে গননা করা হয়, এবং সন শুরু হয় 'শূন্য'র বদলে ৯৬৩ থেকে। (প্রশ্ন : তারিখ-ই-ইলাহী আর ফসলি সন একই কিনা। ১ বৈশাখ ৯৬৩ ফসলি তারিখে হিজরি তারিখ কতো ছিল তাহলে? কারাওদিন/ফারাওদিন কি বৈশাখ মাসের নাম, নাকি মহররম মাসের নাম রাখা হয়?)
অনেকের মতে শশাঙ্ক বাংলা সনের প্রবর্তক, যা শুরু হয় শশাঙ্কের রাজ্যভার গ্রহণের দিন থেকে। শশাঙ্কের রাজত্বকাল ৬০৬-৬১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে, কিন্তু বাংলা সন শুরু হয় ৫৯৩ বা ৫৯৪ থেকে। তবে, ঐ সময় আসামে ভাস্করাব্দ চলমান ছিল, যার মাসের নামগুলো বঙ্গাব্দের মতো। বাঙালিরা ভাস্করাব্দ অনুসরণ করে থাকতে পারেন। কিংবা এমনও হতে পারে, ভাস্করাব্দ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শশাঙ্ক রাজ্য শাসনভার গ্রহণের পর ভাস্করাব্দ অনুযায়ী বাংলা সন গণনার প্রচলন করেছিলেন। অনেকে আবার শশাঙ্কের কাল থেকে বাংলা সন শুরু হওয়ার কোনো শক্ত যুক্তি খুঁজে পান না। আমার মনে হয়, ৫৯৩ থেকেই শশাঙ্কের দ্বারা ভাস্করাব্দ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়, যার ফলে ১৫৮৪ সনে ফসলি সন ফরমানের কালে দেখা যায় আকবরের সিংহাসনে আরোহণ কালের হিজরি সন ৯৬৩ আশ্চর্যজনকভাবে ৯৬৩ বাংলা সনের সমান্তরালে চলে এসেছে, অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে হিজরি ও বাংলা উভয় সনই ৯৬৩ ছিল। সুতরাং, ১৫৮৪ খ্রিঃ বা ৯৯২-এর বদলে ৯৬৩ হিজরি ও ৯৬৩ বাংলা সনকে একত্র করে ৯৬৩-ই প্রারম্ভকাল ধরা হয়। আমার ধারণা, ৯৯২/৯৬৩ হিজরির যে কোনো ১টির সাথে শাকাব্দ মিলে গেলে শাকাব্দকেই নতুন ফসলি সন হিসেবে ধরা হতো। আকবরের সিংহাসনে আরোহণের কালে ১৪৭৯ শাকাব্দ এবং ১৬১৪ বিক্রমাসম্ভাত ছিল।
(সূত্র : Click This Link)
http://tanmoy.tripod.com/bengcal.html
এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমীর ডঃ তপন বাগচীকে (তিনি এ ব্লগের একজন ব্লগার) কিছু প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি ফেইসবুক মেসেজে যে জবাব দেন, তা নিম্নরূপ :
###
ডঃ তপন বাগচীর কাছ থেকে জানতে পেলাম : বাংলা সন নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন, তাঁরা হলেন মেঘনাথ সাহা, শামসুজ্জামান খান, সুখময় মুখোপাধ্যায়, সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়, কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল, অমর্ত্য সেন প্রমুখ।
সম্রাট আকবর যে বাংলা সন চালু করেছেন, এই ধারণাটিই এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। তবু এখনো খারিজ হয় নি। ৯৬৩ সন থেকে চালুর কোনো গাণিতিক কারণ ছিল বলে মনে হয় না। ফোকলোর পণ্ডিত শামসুজ্জামান খান জানিয়েছেন, ‘হিজরি থেকে বঙ্গাব্দ হয়েছে_ এই মত এসেছিল কয়েকজন আধুনিক ঐতিহাসিকের মাথা থেকে; তাঁদের মধ্যে যার কণ্ঠস্বর সবচেয়ে জোরালো ছিল, তাঁর নাম কেপি জয়সোয়াল। প্রধানত তাঁরই প্রচারের ফলে একটি কাল্পনিক মত আজ ঐতিহাসিক সত্যের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। কিন্তু এই কাল্পনিক মতের ভিত্তি কী? ভিত্তি একটি তুচ্ছ বিষয়। সেটি হলো এই : 'আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর ছিল ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ বা ৯৬৩ হিজরি এবং ৯৬৩ বঙ্গাব্দের সমান। এর থেকেই তাঁরা স্থির করলেন, হিজরি থেকে বঙ্গাব্দ চালু হয়েছে এবং তা চালু করেছিলেন আকবর।’
শশাঙ্ক বাংলা সনের প্রবর্তক- এই মতের সমর্থক অনেকে থাকলেও, তা খারিজ হয়ে গেছে অনেক আগেই। শামসুজ্জামান খানের অভিমত গ্রহণ করেই বলি, ‘আসলে ষষ্ঠ বা সপ্তম শতকে 'বঙ্গাব্দ', 'বাংলা সন' বা 'বাংলা সাল' ব্যবহৃত হওয়া অসম্ভব ছিল। অতো আগে বঙ্গ বা বাংলা বলে কোনো রাজ্য বা ভৌগোলিকভাবে সুসংবদ্ধ এলাকা গড়ে উঠেছিল- ইতিহাসে তার প্রমাণ নেই। তাই 'বঙ্গাব্দ'-র মতো আধুনিক শব্দের ব্যবহার যেমন সম্ভব ছিল না, তেমনি সঙ্গত কারণেই আরবি বা ফার্সি শব্দ 'সন' বা 'সাল'-এর ব্যবহার একেবারেই অকল্পনীয়। এসব কারণেই রাজা শশাঙ্কের সঙ্গে 'বঙ্গাব্দ' বা 'বাংলা সন'-এর সম্পর্ককে ইতিহাসসম্মত প্রত্যয় বলে মনে করা যায় না।’
‘কারাওদিন/ফারাওদিন কি বৈশাখ মাসের নাম, নাকি মহররম মাসের নাম রাখা হয় ’এই প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। সম্রাট আকবরের আমলে প্রচলিত তারিখ-ই-ইলাহী-র মাসের নামগুলি ছিল পারসি ভাষায়, যথা: ফারওয়াদিন, আর্দি, ভিহিসু, খোরদাদ, তির, আমারদাদ, শাহরিযার, আবান, আযুর, দাই, বহম এবং ইসক্নদার মিজ। খ্রিস্টাব্দের চেয়ে পুরনো পৃথিবীতে চলমান সন বর্তমানে আছে বলে আমার জানা নেই। খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকেই মাসের নাম জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, ইত্যাদি ছিল। এটিই সংস্কার করে গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা তৈরি হয়। তাৎক্ষণিক ধারণায় সকল তথ্যের যথাযথ ভাষ্য নির্মাণ কঠিন হয়ে পড়ে।
###
নিচের অংশটুকু সৈয়দ আশরাফ আলীর বাংলা নববর্ষের ইতিহাস রচনা থেকে নেয়া।
সূত্র
###
বাংলা সনের ইতিহাস ঘটনাবহুল ও বৈচিত্র্যময়। জন্মলগ্ন থেকেই বাংলা সন তারুণ্যদীপ্ত হয়ে ওঠে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলা সনের শৈশব উত্তীর্ণ হয় নি। জন্মের অব্যবহিত পরেই তার বয়স হয় ৯৬৩ বৎসর। অর্থাৎ বাংলা সনের প্রথম বৎসরটি যখন শেষ হয় তখন সে ৯৬৪ বৎসরের এক সবল, স্বাস্থ্যবান ‘তরুণ’।
আজগুবি বা হেঁয়ালি মনে হলেও এ দাবি কিন্তু ইতিহাস সমর্থিত। শুধু তাই নয়, বাংলা সনের প্রবর্তন যিনি করেন তিনি কোন বাংলাভাষী বা বাংলাদেশি নন। তিনি ছিলেন বিশ্বখ্যাত চেঙ্গিস খান ও মহাবীর তৈমুর লং-এর সুযোগ্য বংশধর বিশ্ববিখ্যাত মোঘল সম্রাট আকবর দি গ্রেট। সুদূর দিল্লীতে রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত থেকেই তিনি এ দেশে বাংলা সন প্রবর্তন করেন।
‘সন’ ও ‘তারিখ’ দুটিই আরবী শব্দ। প্রথমটির অর্থ হল ‘বর্ষ’ বা ‘বর্ষপঞ্জী’ এবং অন্যটির অর্থ ‘দিন’। ‘তারিখ’ বলতে আবার ইতিহাসও বোঝায়। ‘সাল’ হচ্ছে একটি ফারসী শব্দ, যার অর্থ হল বৎসর।
‘ইংরেজি’ তথা ‘গ্রেগরীয়ান’ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মক্কা থেকে মদীনায় ঐতিহাসিক হিজরত অবলম্বন করে প্রবর্তিত, এই হিজরী সন শুরু হয় ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৫/১৬ জুলাই তারিখ থেকে। বাংলা সনের মূলে হিজরী সন বিদ্যমান বিধায় হিজরী সালকেই সুকৌশলে বাংলা সনে রূপান্তরিত করা হয়।
মোঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে তাঁরই নির্দেশে ৯৯৮ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সনের প্রবর্তন হয়। বাদশাহ আকবর ৯৬৩ হিজরিতে অথাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে (১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে) দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনা চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ৯৬৩ হিজরি অবলম্বন করেই বাংলা সন চালু করা হয়। অর্থাৎ ১, ২, ৩-এভাবে হিসেব না করে মূল হিজরি সনের চলতি বছর থেকেই বাংলা সনের গণনা শুরু হয়। ফলে জন্ম বছরেই বাংলা সন ৯৬৩ বৎসর বয়স নিয়ে যাত্রা শুরু করে। উল্লেখ্য, হিজরি সনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। মহানবী (সা.) স্বয়ং আনুষ্ঠানিকভাবে হিজরি সন চালু করেন নি। এটি প্রবর্তন করেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে।
হিজরি সনের ক্ষেত্রে যে রকম হিজরতের দিন ও মাস (১২ রবিউল আউয়াল) সুনির্দিষ্টভাবে অবলম্বন না করে শুধুমাত্র সালটিকেই (৬২২ খ্রিস্টাব্দে) সংরক্ষণ করা হয়, বাংলা সনের ক্ষেত্রেও তেমনি সম্রাট আকবরের রাজ্যাভিষেকের দিন ও মাস (১৪ইং ফেব্রুয়ারি) অবলম্বন না করে শুধুমাত্র বৎসরটি (৯৬৩ হিজরি) সংরক্ষিত হয়।
হিজরি সনের প্রথম দিন হলো পহেলা মহররম। বাংলা সনে তা পরিবর্তন করে পহেলা বৈশাখ করা হয়। ৯৬৩ হিজরিতে মহররম মাস ও বৈশাখ মাস একই সঙ্গে আসে। ফলে, তদানীন্তন শাকাব্দের প্রথম মাসটি গ্রহণ না করে হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমের অর্থাৎ বৈশাখ মাসকেই বাংলা সনের মাস হিসাবে পরিচিহ্নিত করা হয়।
বাংলা সনের সৃষ্টি হয় ফসল তোলার সময় লক্ষ্য করে। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে সৌর বৎসর অবলম্বনে এই নতুন সন গণনা শুরু হয়। তাই, প্রাথমিক পর্যায়ে এটি ‘ফসলি সন’ নামে অভিহিত হতো। ‘বাংলা’র জন্য উদ্ভাবিত বলে এটি পরবর্তী পর্যায়ে ‘বাংলা সন’ নামে পরিচিহ্নিত হয়। উল্লেখ্য, একইভাবে ভারতের উড়িষ্যা ও মহারাষ্ট্র প্রদেশে যথাক্রমে ‘বিলায়তী’ ও ‘সুরসান’ নামে আঞ্চলিক সনের সৃষ্টি হয়। এসব সনেরও উৎস-সন হিসেবে হিজরি সনকেই গ্রহণ করা হয়।
সম্রাট আকবরের আমলে সুবা-এ-বাংলা (বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা) মোগল শাসনের আওতাভুক্ত হয়। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এক জটিল সমস্যা দেখা দেয়। প্রজাদের দেয় খাজনা ফসলের মাধ্যমে আদায় করতে হলে বছরে একটি সময় নির্দিষ্ট থাকা আবশ্যক। কিন্তু সে কালের রাজকীয় সন অর্থাৎ হিজরি সন চান্দ্র সন হওয়ার প্রতি বছর একই মাসে খাজনা আদায় সম্ভব হতো না। ফলে, সম্রাট আকবর একটি সৌরভিত্তিক সন প্রচলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। উল্লেখ্য, চান্দ্র বৎসর ৩৬৫ দিনের না হয়ে ৩৫৪ দিনের হয়ে থাকে। ফলে, চান্দ্রভিত্তিক আরবী মাস বৎসরের সৌরভিত্তিক ঋতুর সঙ্গে সুনির্দিষ্ট কোঅ সামঞ্জস্য বহন করে না।
সম্রাট আকবরের নির্দেশে প্রচলিত হিজরি সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজ-জ্যোতিষী আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী বহু ভাবনা-চিন্তার পর সনসমূহের উদ্ভাবন করেন তাদেরই একটি হচ্ছে 'ফসলি সন' বা ‘বাংলা সন’। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, ফসলের মওসুমের কথা বিবেচনায় রেখে এই নতুন সনের প্রবর্তন হয় বলে এর নাম ‘ফসলি সন’ হয়। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন অঞ্চলের নাম অনুযায়ী ‘ফসলি সন’ পরিবর্তিত রূপ ধারণ করে এবং বাংলাদেশে তা ‘বাংলা সন’ নামে অভিহিত হয়।
একটি কথা অবশ্য স্মরণে রাখতে হবে যে, হিজরি সনভিত্তিক হলেও, ‘বাংলা সন’ ও ‘হিজরি সন’ আদৌ একই ধরনের নয়। ‘হিজরি সন’ হচ্ছে চান্দ্র সন এবং ‘বাংলা সন’ সৌর সন। ফলে, একই সময়কাল থেকে যাত্রা শুরু করলেও (৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই তারিখে) ‘হিজরি’ ও ‘বাংলা’ সন দুটির বয়সে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে এই পার্থক্য এসে দাঁড়িয়েছে ১৪ বছরে। হিজরি সনের হিসাব অনুযায়ী এ বছরটি হল ১৪৩২ হিজরি। কিন্তু বাংলা সনের হিসেবে এটি হচ্ছে ১৪১৮। গত বুধবার (১৩/০৪/২০১১ইং) পর্যন্ত এটি ছিল ১৪১৭ (বাংলা সনানুযায়ী)। এই ১৪/১৫ বৎসরের পার্থক্য অতি স্বাভাবিক। কারণ চান্দ্র বৎসর এবং সৌর বৎসরের সময়কাল সমান নয়। দুটির মধ্যে পার্থক্য প্রায় এগারো দিনের। সৌর বৎসর হয় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ সেকেন্ড। চান্দ্র বৎসরের স্থিতি হলো ৩৫৪ দিন ৮ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট ৩৬ সেকেন্ড-এর। চান্দ্র বৎসরের সময়কাল সৌর বৎসর অপেক্ষা প্রায় ১১ দিন কম হওয়ার ‘হিজরি সন’ ‘বাংলা সন’ অপেক্ষা ১১ দিন প্রতি বৎসর এগিয়ে যায়। ফলে ৯৬৩ থেকে ১৪১৮ বাংলা সনের মধ্যে হিজরি সন এগিয়ে গিয়েছে ১৪ বৎসরেরও বেশি। স্বভাবতই, পহেলা বৈশাখ, ১৪১৮ সনের এই পার্থক্য হচ্ছে ১৪৩২-১৪১৮=১৪ বৎসর।
বাংলা সন মূলতঃ ইসলামী হিজরি সনের উপর নির্ভরশীল হলেও শাকাব্দের নিকটও সে কিঞ্চিৎ ঋণী। বাংলা সনে আমরা বর্তমানে দিন ও মাসের যে নামগুলো ব্যবহার করি সেগুলো শাকাব্দ থেকেই গৃহীত। সপ্তাহের নামগুলো রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ ইত্যাদি গৃহীত হয়েছে গ্রহপুঞ্জ ও সূর্য থেকে। মাসের নামগুলো, যেমন বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ইত্যাদি আমরা পেয়েছে নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে।
বর্তমান ভারতের জাতীয় সন হচ্ছে শাকাব্দ। রাজা চন্দ্রগুপ্ত ৩১৯ অব্দে গুপ্তাব্দ প্রবর্তন করেন। এই সন পরে ‘বিক্রমাব্দ’ নামে অভিহিত হয়। এই ‘অব্দ প্রথমে শুরু হতো চৈত্র মাস থেকে। পরবর্তী পযায়ে কার্তিক মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে পরিচিহ্নিত করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১৫ সালে ভারতে শক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। শক সনের স্মারক হিসেবে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে শাকাব্দ চালু করা হয়। সৌরভিত্তিক শাকাব্দের রবিমার্গের দ্বাদশ রাশির প্রথম মেঘ অন্তর্গত পূর্ণচন্দ্রিকাপ্রাপ্ত প্রথম নক্ষত্র বিশাখার নামানুসারে বৎসরের প্রথম মাসের নাম রাখা হয় বৈশাখ। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, নাক্ষত্রিক নিয়মে বাংলা সনের মাসগুলোর নাম নিম্নেবর্ণিত নক্ষত্রসমূহের নাম থেকে উদ্ভূত হয়েছে:
মাসের নাম সংশ্লিষ্ট নক্ষত্রের নাম
বৈশাখ বিশাখা
জ্যৈষ্ঠ জ্যেষ্ঠা
শ্রাবণ শ্রাবণা
ভাদ্র ভাদ্রপদা
আশ্বিন আশ্বিনী
কার্তিক কার্তিকা
অগ্রহায়ণ অগ্রহায়ণ
পৌষ পৌষা
মাঘ মঘা
ফাল্গুন ফাল্গুনী
চৈত্র চিত্রা
‘ফসলি সন’ যখন প্রবর্তিত হয়, তখন কিন্তু ১২ মাসের নাম ছিল : কারওয়াদিন, আরদি, ভিহিসু, খারদাদ, তীর, আমরারদাদ, শাহরিয়ার, মিহির, আবান, আয়ুব, দায়, বাহমান ও ইসকান্দার মিয। পরবর্তী পর্যায়ে সেগুলো বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ইত্যাদিতে রূপান্তরিত হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে বংলা সনের প্রথম মাস কোন্টি ছিল সে বিষয়ে কিঞ্চিৎ মতানৈক্য রয়েছে। অধিকাংশ ঐতিহাসিক অভিমত প্রকাশ করেন যে, অগ্রহায়ণ হলো অগ্রাধিকার বিধায়, অতীতে আমাদের নববর্ষের দিন ছিল পহেলা অগ্রহায়ণ। অর্থাৎ ‘হায়ণ’ বা বৎসরের প্রারম্ভে যায় যে মাস তার প্রথম দিন ছিল আমাদরে নববর্ষের দিন। কিন্তু ৯৬৩ হিজরিতে যখন ‘ফসলি সন’ বা ‘বাংলা সন’ শুরু করা হয়, তখন হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম বৈশাখ মাসের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে, এ দেশে ১লা বৈশাখই ‘নওরোজ’ বা ‘নববর্ষ’ হিসেবে পরিচিহ্নিত হয়। উল্লেখ্য, ‘ইংরেজি’ তথা গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডারের ক্ষেত্রেও প্রথমে ১লা মার্চ ছিল ‘নিউ ইয়ারস ডে’। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে পহেলা জানুয়ারি সে সম্মানজনক স্থান দখল করে নেয়।
সম্রাট আকবরের সময় মাসের প্রতিটি দিনের জন্য পৃথক পৃথক নাম ছিল। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে এ জটিল প্রথা পরিহার করে সপ্তাহের সাতটি দিনের জন্য সাতটি নাম নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে ব্যবহৃত ঐ সাতটি নামের সঙ্গে রোমান সাপ্তাহিক নামগুলোর সাদৃশ্য সহজেই পরিলক্ষিত হয়। অনুমিত হয় যে, বাদশাহ শাহজাহানের দরবারে আগত কোন ইউরোপীয় (সম্ভবত পর্তুগীজ) মনীষীর পরামর্শক্রমে মূলত গ্রহপুঞ্জ থেকে উদ্ভূত নিম্নবর্ণিত নামগুলোর প্রচলন করা হয় : (১) রবি (সূর্য)- ঝঁহ বা সূর্য থেকে, (২) সোম (চন্দ্র) গড়হধহ অর্থাৎ গড়ড়হ থেকে, (৩) মঙ্গল গধৎং বা মঙ্গল গ্রহ থেকে, (৪) বুধ গবৎপঁৎু বা বুধ গ্রহ থেকে, (৫) বৃহস্পতি ঔঁঢ়রঃবৎ বা বৃহস্পতি গ্রহ থেকে, (৬) শুক্র ঋৎরমম (বা ঠবহঁং ) থেকে এবং (৭) শনিবার ঝধঃঁৎহ বা শনি গ্রহ থেকে।
সংশোধিত এই বাংলা সন এ দেশ কিন্তু সহজে গ্রহণ করেনি। গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডারের স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় দেশগুলো যে রকম গড়িমসি করেছিল, বাংলা একাডেমি কর্তৃক সংশোধিত ‘বাংলা সন’ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশেও কিন্তু কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা যায়। ফলে, সংশোধনের প্রায় দুই যুগ পর ১৯৮৮ সালের ১৯ জুন তারিখে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘বাংলা সন’-এর সংশোধিত রূপ স্বীকৃত হয়।
সন হিসেবে ‘বাংলা সন’ নিঃসন্দেহে অতীব কার্যকর ও বিজ্ঞানসম্মত বলে বিবেচিত হয়। এর কারণ হল এটি একই সঙ্গে চান্দ্র (খঁহধৎ) ও সৌর (ঝড়ষধৎ) পদ্ধতির সার্থক উত্তরাধিকারী। এর প্রথমাংশ, অর্থাৎ ৯৬৩ বৎসর, সম্পূর্ণরূপে হিজরি সনভিত্তিক তথা চান্দ্র সন। পরবর্তী অংশ, অর্থাৎ ৯৬৩ থেকে অদ্যাবধি, সৌর ভিত্তিক। ফলে, বিশ্বে সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত ‘ইংরেজি’ তথা ‘গ্রেগরীয়ান’ ক্যালেন্ডারের সঙ্গে ‘বাংলা সন’ সামঞ্জস্য রেখে চলে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, ৯৬৩ বাংলা বর্ষে পহেলা বৈশাখ হয়েছিল ১১ই এপ্রিল, ১৫৫৬ তারিখে। এ বৎসর, অর্থাৎ ১৪১৮ বাংলা সনে, পহেলা বৈশাখ আমরা পাচ্ছি ১৪ই এপ্রিল। অর্থাৎ ১৪১৮-৯৬৩=৪৫২ বছরে পার্থক্য হয়েছে মাত্র ৩ দিন। আর, ভবিষ্যতে সে পার্থক্য এর চেয়ে একদিনের অধিক কখনও হবে না। বিজ্ঞানসম্মত এবং মুসলমান কর্তৃক প্রবর্তিত হিজরি ভিত্তিক এই ‘বাংলা সন’ নিঃসন্দেহে আমাদের গৌরব।
###
পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেন। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব। বিশ্বের সকল প্রান্তের সকল বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেন। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা একে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ্য হিসেবে বরণ করে নেন। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল অথবা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। আধুনিক বা প্রাচীন যে কোন পঞ্জিকাতেই এই বিষয়ে মিল রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এদিন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
বাংলা দিনপঞ্জীর সঙ্গে হিজরী ও খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সন ঘড়ির হিসাবে চলে। এ কারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে। ইংরেজি দিন শুর হয় মধ্যরাতে। আর বাংলা সনের দিন শুরু হয় ভোরে, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। কাজেই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুর হয় বাঙালির পহেলা বৈশাখের উৎসব।
ইতিহাস
হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারটি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরালা, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়ায় কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হতো।
ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলতো না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হতো। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল 'ফসলি সন', পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব-বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব-বই বন্ধ করে নতুন হিসাব-বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকনদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকাণ্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০১২ বিকাল ৫:৪৭