১৯৮৯ সালে একটা হিন্দি ছবি দেখেছিলাম - নাম 'প্রহর'। মূল চরিত্রে নানা পাটেকার। ওটা দেখে আমি এতটাই মুগ্ধ ও অভিভূত হয়েছিলাম যে, আমি পণ করেছিলাম, ভবিষ্যতে আমি এ ধরনের একটা ফিল্ম বানাব বাংলাদেশে এবং মনে মনে আমার বন্ধু সহকর্মী রুশোকে নায়ক হিসাবে নমিনেট করে রেখেছিলাম। আমি বেসিক্যালি ফিল্ম লাইনের লোক নই, তাই আমার কেরিয়ারও ওভাবে গড়ে ওঠে নি এবং ফিল্ম মেকিঙের ইচ্ছেটা কোনো এক সময় ফেড আউট হয়ে যায়, আমি অধিকতর মনোযোগী হয়ে উঠি লেখালেখি, ব্লগিং, ফেইসবুকিং ও শেষমেষ ইউটিউবিং ও মিউজিক এডিটিঙে।
স্কুল ও কলেজ লাইফে আমি ছবি দেখার পাগল ছিলাম, অবশ্যই বাংলা ছবি। আমাদের দোহার থানায় তখন একমাত্র সিনেমাহল 'জয়পাড়া সিনেমা', যাতে এক ছবি দীর্ঘদিন চলতো। ঐ সময়ে (স্কুলে পড়ি তখন) খুব আফসোস হতো, ইশ, যদি ঢাকায় থাকতাম, তাহলে প্রতিদিনই অন্তত একটা করে ছবি দেখতে পারতাম। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম। ছবি দেখেছি, তবে আগের তুলনায় অনেক কম, কারণটা হলো ছবি দেখার জন্য টিকেট কেনার পর্যাপ্ত টাকা তখন ছিল না।
বাংলাদেশে ডিশ কালচার শুরু হওয়ার পর, বিশেষ করে 2005 সালের দিকে যখন বাংলাদেশী চ্যানেলের সংখ্যা বেড়ে যায়, আমার সিনেমা দেখার নেশা তখন একেবারেই কমে আসে। প্রতিদিনই প্রায় সবগুলো চ্যানেলেই সিনেমা হচ্ছে। সকাল ১০টার পর থেকে যে চ্যানেলেই শিফট করি, দেখা যায় কোনো না কোনো ছবি চলছে। কিন্তু দেখার ইচ্ছে নেই। আবার, সিনেমায় ডিপজল, মুনমুন, প্রমুখ 'নিম্ন শ্রেণির' ও 'রুচি-বিবর্জিত' অভিনেতা-অভিনেত্রীর আবির্ভাবে ছবির জগতও হয়ে গেছে অনেক নোংরা। ভালো লাগে না। এর মধ্যেও কিছু ছবি, যেমন হুমায়ূন আহমেদ, মোরশেদুল ইসলাম, গিয়াস উদ্দিন সেলিম, অমিতাভ রেজা, তৌকির আহমেদ, অনন্ত জলিল প্রমুখ পরিচালকের ছবি দেখেছি, ভালো লেগেছে।
সাম্প্রতিক কালে ছবির জগতে একটা নতুন আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ভালো ছবি হচ্ছে। অল্পকিছু গতানুগতিক সিনেমা হলের সাথে চাকচিক্যময় সিনেপ্লেক্সে দেখানো হচ্ছে ছবি, যাতে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। সেই সাথে বিভিন্ন অ্যাপস, যেমন হইচই, চরকি, আইস্ক্রিন, নেটফ্লিক্স, ইত্যাদিতেও যখন-তখন, যেখানে-সেখানে, যেভাবে খুশি, ছবি দেখা যাচ্ছে খুব সহজে এবং আনন্দের সাথে।
কিছুদিন আগে সিনেপ্লেক্সে যেয়ে 'পরাণ' ও 'প্রিয়তমা' ছবি দেখে এসেছি। বহুদিন পর বড়ো পর্দায় ছবি দেখে প্রকৃত অর্থেই প্রচুর উপভোগ করেছি। এরপর 'আইস্ক্রিন' সাবস্ক্রাইব করে 'হাওয়া' দেখা শুরু করেছিলাম। খুব ভালো লাগছিল, তবে কাজের ব্যস্ততার জন্য দুইদিন ধরে ঘণ্টাখানেকের মতো দেখেছিলাম। গতকাল (২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩) আবার 'হাওয়া' দেখতে যেয়ে দেখি, ওটা আর পিসিতে বা স্মার্ট টিভিতে যেখা যাবে না, আইওএস বা অ্যান্ড্রয়েডে দেখতে হবে। 'আইস্ক্রিন'-এ অন্যান্য ভিডিও সার্চ করতে করতে যে ছবিটায় ক্লিক করলাম, সেটার নাম 'অপারেশন সুন্দরবন'।
শুরু করলাম দেখা 'অপারেশন সুন্দরবন'। যতই দেখছি, আমি বিস্মিত হচ্ছি এবং মুগ্ধ হচ্ছি। সুন্দরবন যেন ডাকাত বা জলদস্যুদের এক অভয়ারণ্য। কত মানুষ সেখানে জিম্মি হচ্ছে! কত মানুষকে প্রাণ দিতে হচ্ছে। এই নৈরাজ্য দূরীকরণে র্যাব বাহিনীর অসীম সাহসিকতাপূর্ণ সফল অভিযানকেই রূপ দেয়া হয়েছে সেলুলয়েডের রূপালি ফিতায়। আমার সেই তারুণ্যের বাসনা, 'প্রহর'-এর মতো একটা ছবি বানাবো, এ যেন সেই আমার ইচ্ছারই প্রতিফলন। এটাকে ঠিক 'প্রহর' জনারের ছবি বলা যায় না হয়ত, তবে, আমি ছবি বানালে এরকমই বানাতাম হয়ত-বা। 'অপারেশন সুন্দরবন' ছবির কোনো অ্যাড দিচ্ছি না আমি, আমি শুধু আমার অভিব্যক্তিই বর্ণনা করছি। অনেক ট্যাকটিক্যাল এরর আছে ছবিতে, যা থাকা খুবই স্বাভাবিক, কারণ, এ ছবি কোনো মিলিটারি ব্যাকগ্রাউন্ডের ব্যক্তির বানানো নয়, যার ফলে ট্যাকটিক্যাল বিষয়গুলো সেভাবে আড্রেস করা হয় নি; আমি বানালেও যে সেটা ট্যাকটিক্যালি পারফেক্ট হতো তাও কিন্তু বলছি না। কিন্তু আমাকে মুগ্ধ করেছে ফিল্ম মেকিঙের ধারণাটি। ফিল্ম মেকিঙের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম অনন্ত জলিলের 'খোঁজ, দ্য সার্চ' দেখে; ওটা আমার পিসিতে দেখছিলাম, আর ভাবছিলাম, বাংলাদেশে এমন ছবি বানানো সম্ভব হলো কীভাবে! এমনকি, আমার আশেপাশে যারা ঘোরাঘুরি করছিলেন এবং মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছিলেন, তারাও অবাক হয়ে এটা কী ছবি, কোন দেশের ছবি, ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করছিলেন। এবার আমার সেই বিস্ময়ে যুক্ত হলো আরেকটি নাম - 'অপারেশন সুন্দরবন'। আমাকে আরো একটা জিনিস খুবই মুগ্ধ করলো, তা হলো সিজিআই-এর ব্যবহার (সিজিআই - কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজারি। ইংলিশ মুভি 2012, Maleficent, Life of Pie, Avatar, ইত্যাদি ছবিতে সিজিআই, ভিএফএক্স, ইত্যাদির ব্যবহার আছে। ইংলিশ মুভিগুলোতে আজকাল সিজিআই-এর ব্যবহার খুবই সাধারণ ফেনোমেনা হয়ে গেছে)। এ ছবিতে সিজিআই দিয়ে 'বাঘ' বানানো হয়েছে; কিছু বানরের লাফালাফি দেখলাম, কিছু পাখি, নিশ্চিত নই ওগুলো নেচারাল, নাকি সিজিআই। আমি জানি না, এর আগে বাংলাদেশে কোনো ছবিতে সিজিআই ব্যবহার করা হয়েছে কিনা। তবে, বাংলাদেশে ফিল্ম মেকিঙে সিজিআই-এর ব্যবহার নিঃসন্দেহে একটা মাইলফলক।
এ ছবির গল্পে একটু পর পরই টুইস্ট লাগানো হয়েছে। বেশি টুইস্টের ফলে দর্শকরা একটু বিরক্ত হতে পারেন, আবার আকৃষ্টও হতে পারেন। নুশরাত ফারিয়ার কোনো ছবি পুরোপুরি আগে দেখা হয় নি, কিন্তু এ ছবিতে তাকেই মনে হয়েছে সবচাইতে স্মার্ট, স্টানিং ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তার অভিনয় খুবই নজরকাড়া। আরমান পারভেজ মুরাদ, রওনক হাসান, সিয়াম আহমেদ, মনোজ কুমার প্রামানিক, নরেশ ভুইয়া, দর্শনা বণিক, তাসকিন রহমান এবং জিয়াউল রোশান ভালো অভিনয় করেছেন। তবে 'বারবনিতা' চরিত্রটিতে যে মেয়েটি অভিনয় করেছেন, তার ঔজ্জ্বল্য নুশরাত ফারিয়াকেও ছাপিয়ে গেছে কোথাও কোথাও। রিয়াজ ছিলেন অনেকটাই আর্টিফিশিয়াল, জড়তাগ্রস্থ এবং গতানুগতিক।
২ ঘণ্টা ২০ মিনিটের ছবি ১ ঘণ্টা ২৯ মিনিট পর্যন্ত দেখার পর এ পোস্টটি লিখে ফেইসবুকে শেয়ার করেছিলাম। খেলা দেখা ও মিউজিক এডিটিং এবং প্রায় ৩ মাস পর ডাক্তার কন্যা বাসায় আসায় তাকে সময় দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে ছবিটি দেখছিলাম। ছবি শেষ করার আগেই অনুভূতি প্রকাশের জন্য ছটফট করছিলাম। আজকের ২য় ওডিআইতে বাংলাদেশ বোলিং ডিপার্টমেন্ট ভালো করেও ব্যাটিঙে খারাপ করায় বেশ বাজে ভাবে ৮৬ রানের বড়ো মার্জিনে হেরে গেছে (নিউজিল্যান্ড ২৫৪, বাংলাদেশ ১৬৮)। মনটা খারাপ ছিল। বিষণ্ণতা কাটানোর জন্য ছবির বাকি অংশ শেষ করলাম।
ছবির কাহিনি আর বলছি না। ওভারঅল ফিল্ম মেকিংটা আমার কাছে 'অসাধারণ' লেগেছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র 'ডিপজল-মুনমুন'দের নোংরা যুগ থেকে এক নতুন দিগন্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তা দেখে খুব ভালো লাগছে। দ্য বিউটি সার্কাস, পরাণ, হাওয়া, প্রিয়তমা, সুড়ঙ্গ, অপারেশন সুন্দরবন - অল্প সময়ের ব্যবধানে এ ক'টা ভালো ছবির নাম বলা গেল। আরো কিছু নাম হয়ত আপনারা জানেন (আমার মনে পড়ছে না), যেগুলোতে হয়ত গল্পের নূতনত্ব বা বৈচিত্র তেমন একটা পাবেন না, কিন্তু গল্পকার/চিত্রনাট্যকারের গল্প বলার স্টাইলটাতে অবশ্যই কিছু ভিন্নতা ও ভিন্নমাত্রা আপনারা পাবেন, যা খুবই আশাব্যঞ্জক।
পরিচালক : দীপংকর সেনগুপ্ত দীপন
প্রযোজক : থ্রি হুইলারস লিমিটেড, র্যাব ওয়েলফেয়ার কোওপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড
রচয়িতা : গবেষণা উন্নয়ন একটি দল (আরডিটি)
চিত্রনাট্যকার : দীপংকর সেনগুপ্ত দীপন ও নাজিম-উদ-দৌলা
শেষমেষ বলবো, এটি একটি অসাধারণ ও মেধাবী পরিচালনা ও মেধাবী ফিল্ম মেকিং। দীপঙ্কর সেনগুপ্ত দীপন। তার আরেকটা ছবি 'ঢাকা অ্যাটাক'-এর অনেক প্রশংসা শুনেছি। 'অপারেশন সুন্দরবন' শেষ করলাম, এখান সেটাও দেখার ইচ্ছা রইল। এ মেধাবী পরিচালকের প্রতি অনেক অনেক শুভ কামনা।
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:১৫