আমার লেখা জীবনের প্রথম চিঠিটির কথা আসলে মনে নেই, তবে, প্রথম চিঠি লেখার করুণ ও হৃদয়বিদারক বিব্রতকর অবস্থার কথা কখনো ভুলতে পারি না। সেটি আজ আপনাদের বলি।
এ ঘটনার আগে ক্লাসের বিভিন্ন পরীক্ষায় হয়ত চিঠিপত্র বা দরখাস্ত লিখে থাকবো, তবে মা-বাবা-চাচা-খালা, বন্ধু-প্রেমিকাকে কোনো পারিবারিক চিঠি লেখার সুযোগ হয় নি।
তখন 'কৃতিত্বের' সাথে ক্লাস ফাইভ পাশ করে হাইস্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছি। আমার স্কুল থেকে প্রথম বারের মতো প্রাইমারি বৃত্তি পাওয়ায় আমার 'ভালো ছাত্র' হওয়ার ঘটনাও অনেক ছড়িয়ে পড়েছিল
নানার চিঠির উদ্দেশ্য, ভাগ্নেকে কুশলাদি জানানো আর নানার ছেলে (অর্থাৎ আমার একমাত্র সুরুজ মামা) আর আমার জন্য 'সিকো' ঘড়ি পাঠানোর কথা বলা। এর দাম অবশ্য নানাই বহন করবেন। আমি প্রাইমারি বৃত্তি পাওয়ায় নানার পক্ষ থেকে এটা হবে আমার জন্য একটা উপহার। মা যখন আমাকে এ চিঠি লেখার কথা বললো, তখন আমার মাথায় অল্পের জন্য আকাশ ভেঙে পড়লো না। আমি বিষম চিন্তায় পড়ে গেলাম শুধু একটা বিষয় নিয়ে - চিঠির শুরুতে সম্বোধনটা কীভাবে লিখতে হবে! আপনারা হয়ত ভাবছেন, এত সাধারণ একটা বিষয়ে চিন্তার কী হলো, প্রিয় কফিল, হ্যালো কফিল, ইত্যাদি যে-কোনো একটা কিছু লিখে দিলেই তো হতো! হ্যাঁ, ও-বয়সে চিঠি লেখার কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় এই সাধারণ বিষয়টিই মাথায় আসে নি। চিন্তায় চিন্তায় আমি প্রথমে ঘাস, পরে কাঠ হতে শুরু করলাম। ক্লাসমেট কাউকে যে জিজ্ঞাসা করবো, এ কথাটাও মাথায় আসে নি।
পরের দিন মা জিজ্ঞাসা করলো, চিঠি লেখা হয়েছে কিনা। আমি হয়ত কিছু একটা জবাব দিয়েই চিন্তায় আরো কঠিন কাঠ হতে হতে নিজ ভুবনে চলে গেলাম।
এভাবে প্রায় ৫/৭দিন চলে গেছে। ইতিমধ্যে আমার নানাও চিঠি নেয়ার জন্য বার দুয়েক আমাদের বাড়িতে এসে ফিরে গেছেন।
পরের ঘটনাটা ছিল খুব মধুর এবং স্বস্তিদায়ক, বলতে পারেন relieving
বাবা কফিল,
আশা করি ভালো আছো। আমরাও খোদার ফজলে ভালো আছি। পর সমাচার এই যে, -----------। নিয়মিত খাওয়া দাওয়া করিবে। আল্লাহর নাম স্মরণ রাখিবে, ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়িবে। কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ করিবে না ------- খোদা হাফেজ।
ইতি-
তোমার মামা কালু মোল্লা
'বাবা কফিল' সম্বোধনটাই আমার চিঠির সম্বোধনের সব কাঠিন্য দূর করে দিল। অথচ, তার আগে আমার মাথায়ই ঢোকে নি এভাবে ভাগ্নেকে একটা সম্বোধন করা যেতে পারে।
এরপর ঐ বয়স থেকেই আমাকে অনেক চিঠি লিখে দিতে হয়েছে। বেশির ভাগই ছিল 'ভাবী' সম্পর্কের আর একজন ছিলেন 'খালা' সম্পর্কের। তবে, এদের সবার চিঠিই থাকতো তাদের হাজব্যান্ডদের প্রতি। কয়েকজনকে চিঠি লিখে দিতে হতো মিডল ইস্টে চাকরিরত তাদের ছেলেদের কাছে।
হাজব্যান্ডদের কাছে চিঠি লেখাটাও বেশ কঠিনই মনে হয়েছিল প্রথম দিকে। এ সমস্যাটাও মোটামুটি 'সম্বোধন' নিয়েই। তবে, চিঠি লেখার পর পড়ে শোনানো হলে তারা খুশিতে ডগমগ হয়ে যেতেন, আর তা থেকেই বুঝে নিতাম বেশ সরস একটা চিঠিই লিখে দিয়েছি।
হাজব্যান্ডদের কাছে লেখা চিঠির সম্বোধন ও ভাষা ছিল মোটামুটি এরকম :
প্রিয় স্বামী, বা, ওগো আমার স্বামী, বা, হে আমার প্রিয় স্বামী, বা, প্রিয়তম, ওগো প্রিয়তম,
আপনি আমার শতকোটি সালাম নিবেন। আশা করি আল্লাহর অসীম রহমতে আপনি ভালো আছেন। পর সমাচার এই যে, আপনার জন্য সর্বদাই আমার মন ছটফট করে। অনেকদিন গত হইল আপনার সাথে আমার দেখা নাই। তাই আপনার জন্য আমার মন কাঁদিতেছে। জানি না, আবার কবে আপনার সাথে সাক্ষাৎ হইবে। ----- এ পর্যন্ত লেখা কথাগুলো ছিল আমার নিজের কথা
এরপর জীবনে অনেক চিঠি লেখা হয়েছে। সে-সব চিঠির কথা মাঝেমাঝে এক-আধটু লিখেছি বিভিন্ন কমেন্টে। সেগুলোর অনেক চিঠিই শুধু চিঠিই ছিল না, ছিল তার চাইতেও অধিক কিছু। চিঠি লেখার সে-সব দিনের কথা মনে পড়লে যুগপৎ আনন্দ ও বেদনারা এসে ভিড় করে আমার সমস্তটা জুড়ে।
সবার জন্য শুভ কামনা রইল।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১:০৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



