গাজা: একটি পূর্বঘোষিত গণহত্যার বধ্যভূমি
গাধা যখন মোট বয়, তখনো যেমন গাধা, যখন বোঝা নামিয়ে রাখে তখনো সে গাধা। কথাটা ইসরায়েলের বেলাতেও সমান সত্য। যখন যুদ্ধে নামে আর যখন শান্তির কথা বলে, তখনো তা সমান আগ্রাসী।
গত শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের কথা। ফিলিস্তিন তখন ব্রিটিশ দখলাধীন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি খলিফার পরাজয়ের সুবাদে ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের এই অংশটি তাদের হাতেই আসে। সে সময় ফিলিস্তিনের বিভিন্ন শহরে দেয়ালে একটা পোস্টার সাঁটা থাকতে দেখা যেত। তাতে বিভিন্ন ব্যক্তির ছবির নিচে লেখা থাকত_‘সন্ত্রাসবাদী: ধরিয়ে দিন’। ওই সন্ত্রাসবাদীদের কয়েকজন পরে ইসরায়েল রাষ্ট্রের শীর্ষ রাষ্ট্রীয় পদ অর্জন করেন। তত দিনে দান উল্টে গেছে। ইউরোপে ইহুদি-নিধন চলছে। তার জেরে পাশ্চাত্য দুনিয়ায় ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতি দানা বাঁধছে। তার প্রভাবে ওই সব ইহুদি মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের বলা হতে থাকে ‘মুক্তিযোদ্ধা’। এই ‘মুক্তিযোদ্ধারাই’ পরে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে তাদের মাতৃভূমিতে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করে।
তত দিনে পিএলও দাঁড়িয়ে গেছে। আর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাতের নামের পাশে ‘সন্ত্রাসবাদী’ খেতাবও জুটে গেছে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর উইলিয়ম সাফায়্যারের ভাষায়, আরাফাত হলেন ‘সন্ত্রাসবাদের সর্দার’। এই দুর্নাম আমৃত্যু তাঁর ভূষণ ছিল। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি নিধনে পাকা জল্লাদ মেনেশিম বেগিন, আইজ্যাক রবিন ও শিমন পেরেজকে নোবেল পুরস্কারের বরমাল্য পরানো হয়। এরা সবাই ছিল সন্ত্রাসী খেতাবপ্রাপ্ত, পরে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী। শ্যারন তো কুখ্যাত শাবরা-শাতিলা গণহত্যাসহ আরও অনেক গণহত্যার নায়ক। নোবেল পুরস্কার তাদের আরো বেপরোয়া করে তোলে। প্রমাণ হয়, ফল পচে কিন্তু বিষ পচে না।
হিটলারের জার্মানিতে লাখ লাখ ইহুদি গণহত্যার শিকার হয়েছিল। ইহুদিরা তারপরও টিকে গেছে। ফ্যাসিবাদ কায়েমে হিটলার ব্যর্থ হলেও একটি বিষয়ে তিনি সফল। বেশিরভাগ ইহুদিদের মনের মধ্যে তিনি তাঁর ফ্যাসিবাদী ঘৃণার বীজ বুনে দিতে সম হন। এক হিটলারের জায়গায় পরের প্রজšে§র ইহুদিদের মধ্যে পুনর্জš§ নেয় লাখ লাখ হিটলার। তাদের সমর্থনেই ঘোষিত জায়নবাদী-বর্ণবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল হিটলারের কায়দাতেই ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এটাই তাদের রাষ্ট্রীয় আদর্শ এটাই তাদের অস্তিত্বের ভিত্তি। ঘোষিতভাবেই ইসরায়েলি নাগরিকত্বের শর্ত হলো ইহুদি হওয়া। আর এই নাগরিকদের জন্য চাই আরো আরো জমি। সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকেই তারা তাদের স্বপ্নের ধর্মরাষ্ট্র বানাতে চায়। বিপরীতে ফিলিস্তিনিরাও তাদের হারানো দেশ ফিরে পেতে মরিয়া। তাই, ইসরায়েলকে কেবলই ইহুদিদের রাষ্ট্র রাখতে চাইলে, সেই ইহুদিদের সবার জন্য জমি দিতে চাইলে এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ দমন করতে হলে, ক্রমাগত আগ্রাসন ও যুদ্ধ পরিস্থিতিই তাদের কাম্য। দুটো আগ্রাসী যুদ্ধের মধ্যে বিরতিপর্বটি তাই আর কিছু নয়, নতুন আরেকটা যুদ্ধে প্রবেশের প্রস্তুতিপর্ব। যে কারণে গাধা সব সময়ই গাধা, সেই একই কারণে ইসরায়েল সব সময়ই জায়নবাদী ও আগ্রাসী। এই প্রেতি থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের বর্তমান কার্যকলাপ বোঝা দরকার।
দুই.
গাজা আগ্রাসন ‘গাজা যুদ্ধ’ বলে প্রচার পেয়েছে বিশ্বের গণমাধ্যমে। গাজায় যা চলছে তা পরিষ্কারভাবেই আগ্রাসন। তা কেবল গাজার বিরুদ্ধে বা সেখানকার নিরীহ জনসাধারণের বিরুদ্ধে নয়, সমগ্র ফিলিস্তিনি জনগণেরই বিরুদ্ধেÑ পশ্চিম তীরেরও বিরুদ্ধে। সেখানে বাইরে থেকে হামলার দরকার না হওয়ার কারণ দুটি: ১. পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনারা আগে থেকেই মোতায়েন ছিল, ২. মাহমুদ আব্বাসের ফিলিস্তিনি কর্তৃপ ইসরায়েলি অস্ত্র ও অর্থপুষ্ট হয়ে হামাসকে আগেই নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। একইসঙ্গে নিষিদ্ধ ছিল হামাসকে সমর্থন। গ্রেপ্তার হয়েছে পাঁচ শতাধিক হামাস সমর্থক। ২০০৬-এর লেবানন আক্রমণের সময়েও একই প্রচারণা চালানো হয়েছিল। সবাই তখন ইসরায়েলের সুরেই বলেছিল, এই যুদ্ধ হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে। গাজার মতো সেবারও লেবাননের বেসামরিক জীবন ও সেখানকার সরকারি সামর্থ্যকে বোমাবর্ষণে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেবারেও হিজবুল্লাহ টিকে যায় এবং ইসরায়েল পিছু হটে। সেবারও নিহতদের তিন ভাগের এক ভাগই ছিল শিশু, বাদবাকিরা ছিল নিরীহ নারী ও পুরুষ। কত নিখুঁত সামর্থ্য ইসরায়েলের ধ্বংস-মেশিনের। গণিতের নিয়মে তারা মানুষ হত্যা করতে সম!
ইসরায়েল এখন একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করছে। দৃশ্যত হামাস নয়, ফিলিস্তিনের জাতীয় প্রতিরোধই বিজয়ী হয়েছে। ১৮ মাসের নিñিদ্র অবরোধ আর ২৩ দিনের টানা বোমাবর্ষণের পরও হামাস কেবল টিকেই যায়নি, বিপুল বৈশ্বিক সমর্থনও অর্জন করেছে। হামাস হয়ে উঠেছে আরব জাতীয়তাবাদের ভরকেন্দ্র। কেননা, আরব জাতীয়তাবাদের প্রাণভোমরা তো এই ফিলিস্তিনই। ঘা খেয়ে তার জাগ্রত হবার সম্ভাবনা তাই বাতিল করে দেয়া যায় না। সেই আরবে আজ একদিকে সৌদি আরব, মিসর ও জর্ডানের মতো ইসরায়েলপন্থী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেজুড় রাষ্ট্রগুলো। অন্যদিকে কাতার, সিরিয়া, সুদান ও ইরানের মতো জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র। ভেনেজুয়েলা ও বলিভিয়ার পর কাতার ও মৌরিতানিয়াও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। অনেক ইসরায়েলি নাগরিকও তাদের সরকারের আচরণে বিুব্ধ। বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে অজস্র মানুষ ইসরায়েলের প্রতি ধিক্কার জানাচ্ছে। আÍরার অধিকারের নামে ইসরায়েলের ধ্বংসের বাতিক বন্ধ করা এখন এক বৈশ্বিক দাবি। অথচ কী পরিহাস! আরবের থেকে লাতিন সরকারগুলোই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বেশি প্রতিবাদমুখর। এ সবই ইসরায়েলের নৈতিক পরাজয়ের প্রমাণ, বিশ্বে মার্কিন আধিপত্য আলগা হওয়ার লণ।
তাহলেও মার্কিন-ইসরায়েলি ঔপনিবেশিক দখলদারির পরিকল্পনা এখনো ভেস্তে যায়নি। ইসরায়েলের একতরফা যুদ্ধবিরতির মধ্যেই তার ইঙ্গিত মিলছে। হামাসের সঙ্গে সন্ধিতে রাজি না হওয়ার অর্থ, যেকোনো সময়ে একতরফাভাবে আগ্রাসনের মওকা খোলা রাখা। ঠিক যে মুহূর্তে ইসরায়েল গাজায় থমকে গেছে, সে মুহূর্তেও চলছে নতুন যুদ্ধের তোড়জোর। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস ও ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিপি লিভনির মধ্যে গত ১৬ জানুয়ারির চুক্তিটি কার্যত নতুন যুদ্ধের সামরিক সহযোগিতার চুক্তি। এরই মধ্যে তিন হাজার টন মার্কিন অস্ত্রের চালান ইসরায়েল অভিমুখে রওনা হয়েছে। একবারে এত বড় অস্ত্রের চালান খুবই বিরল।
গাজা আগ্রাসন কি তাহলে বড় আকারের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের হাতছানি? বাঘের আগে যেমন ফেউ আসে, এটাও কি তেমন? ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট গত জানুয়ারিতে সফররত ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজিকে বলেন, আজ গাজায় হামাসকে আক্রমণ করলেও কাল ঝাঁপিয়ে পড়া হবে লেবাননের হিজবুল্লাহর ওপর। এ ল্েয গত নভেম্বরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দুই ফ্রন্টে লেবানন ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের মহড়া দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সন্ত্রাসবাদবিরোধী বিভাগের প্রধান ডেল লি আরবিভাষী পত্রিকা আল-হায়াতকে বলেন, সিরিয়ার ওপর ইসরায়েলি আক্রমণ ‘আসন্ন’। জেরুজালেম পোস্ট-এ ইসরায়েলি জেনারেল বেন-বারুচ বলেন, ‘আগেরবার হিজবুল্লাহকে দুর্বল করতে চেয়েছি, এবারের যুদ্ধ হবে ধ্বংসের জন্য।’ ইসরায়েল বলেছে, কেবল হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে নয়, এবার যুদ্ধ হবে সমগ্র লেবাননকে শিা দেওয়ার জন্য। বিধি বাম, গতবার শিাটা ইসরায়েলই পেয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের চোখেও লেবানন সিরিয়া-ইরানের মতোই শত্র“ রাষ্ট্র। লেবাননও জানে, আগ্রাসন আসন্ন। প্রস্তুতি হিসেবে কাতারের রাজধানী দোহায় লেবাননের সব কটি দল মিলে জাতীয় প্রতিরানীতি প্রণয়ন করে। তাতে ইসরায়েলকে লেবাননের নিরাপত্তার এক নম্বর হুমকি গণ্য করা হয়। লেবানন এর মধ্যেই সিরিয়া, ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক যোগাযোগ বাড়িয়েছে। লেবানন ও সিরিয়ার মধ্যে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি রয়েছে। আর সিরিয়ার তা রয়েছে ইরানের সঙ্গে। ইরান আবার চীন ও রাশিয়ার সামরিক ও বাণিজ্যিক মিত্র। অন্যদিকে আমেরিকাসহ ইউরোপের কোনো কোনো দেশ বরাবরের মতো ইসরায়েলের যুদ্ধসঙ্গী। সুতরাং লেবানন ও সিরিয়া আক্রান্ত হলে তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়াবার সম্ভাবনা ফেলনা নয়।
৩.
দিনকে দিন ইসরায়েল ও তার মিত্ররা হয়ে উঠছে হাতলহীন তলোয়ারের মতো। এর যে দিকেই ধরা হোক না কেন, তা কাটবেই। সে কারণে ইসরায়েল তার শত্র“র জন্য যেমন মিত্রের জন্যও সমান বিপজ্জনক। মার্কিন-ব্রিটেন-ইসরায়েলের ইরাক-আফগানিস্তান ও ফিলিস্তিন গণহত্যা ও দখলদারিত্ব বিশ্বশান্তির আশাকে চুরমার করে দিয়েছে। উত্তর ও দণি গোলার্ধের অনেক মনীষীর বরাতে যুগের পর যুগ ধরে যে বৈশ্বিক মানবসমাজের স্বপ্ন রচিত হচ্ছিল, তা কাচের ঘরের মতো খান খান হয়ে ভেঙে পড়ছে। জাতিতে-জাতিতে, ধর্মে-ধর্মে, রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে বিরোধ এখন মড়কের মতো ছড়াচ্ছে। জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক সংস্থার সবল ভূমিকা না থাক, নিরপেতাও যেন মরীচিকা। কোটি কোটি নিপীড়িতের কাছে অস্ত্রই হয়ে উঠছে মুক্তির ভাষা। হিংসার জবাবে হিংসার পথ প্রশস্ত হচ্ছে। সেই পাল্টাপাল্টি হিংসার সমুদ্রে দুর্গরাষ্ট্র হয়ে নিরাপদ থাকার বাসনা যে-ই করুক, তা সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের মতোই ব্যর্থ হবে।
বিশ্বজয়ী রোমান সাম্রাজ্য কিংবা বাগদাদের আব্বাসীয় সাম্রাজ্য পতনের আগে এ রকমই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অন্ধ হলেই তো আর প্রলয় বন্ধ থাকে না। রোমান সাম্রাজ্য খানখান হয়ে গিয়েছিল রোমানদের চোখে অসভ্য বর্বর ভ্যান্ডাল, গথ প্রভৃতি জার্মানিক জাতিগুলোর আক্রমণে। আরবের বেদুইনরা তছনছ করে দিয়েছিল বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য। মঙ্গোলিয়ার যাযাবররাই ছারখার করে দিয়েছিল আব্বাসীয় রাজত্ব। ইতিহাস কখনো কখনো শক্তিমানের পে থাকে সত্য। কিন্তু কোনো শক্তিমানই চিরঞ্জীব নন।
তাই মধ্যপ্রাচ্যে মানবতার যে ধ্বংস চলছে, তা বিশ্বমানবতার জাগরণের প্রসব বেদনা হিসেবেই চিহ্নিত হবে ইতিহাসে। সেই ইতিহাসকে স্বাগতম
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০০৯ দুপুর ১:৩৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



