করোনা, ডেঙ্গু, নিউমোনিয়া এবং জ্বর-শ্বাসকষ্ট-সর্দি-গলাব্যথা-কাশি রোগব্যাধি ইত্যাদির কারণে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিসহ অন্যদের চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে গেলে, সঞ্চয় কমবে, ঋণ বাড়াবে। একই সঙ্গে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির কর্মক্ষমতা হ্রাস পেলে অথবা তাদের শ্রমঘণ্টা অপচয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের দারিদ্র্য (২০.৫%) এবং অতিদারিদ্র্য (১০.৫%) হারের সংখ্যাগুলোর ঋণাত্মক পরিবর্তন হতে বাধ্য। অর্থাৎ সুনির্দিষ্টভাবে সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল, অর্থাৎ এসডিজি’র টার্গেট থেকে বাংলাদেশ দূরে সরে যাবে। ঠিক কতটা তা আমরা জানি না, এটা নির্ভর করে করোনার বিস্তার ও প্রস্তুতির ওপর। বিবিএসের সর্বশেষ খানার আয় ও ব্যয় নির্ধারণ জরিপের উপাত্ত ব্যবহার করে সানেমের গবেষণার প্রাথমিক হিসাবে দেখা যায়, এ রকম অর্থনৈতিক সংকটে পরিবারের আয়ের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রভাব পড়লে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ৪০ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছাবে। অর্থাৎ দরিদ্র্য ও অতি দরিদ্র্য মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৭৫ লক্ষ থেকে বেড়ে দ্বিগুণ অর্থাৎ সাড়ে সাত কোটিতে পৌঁছাবে যাদের দৈনিক আয় মাত্র ১,৯ ডলারের কম।
সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে, করোনা পরিস্থিতিতে শহরাঞ্চলে কর্মজীবী মানুষের আয় কমেছে ৮০ শতাংশ। গ্রামে এটা ৭৯ শতাংশ। আর নতুন সৃষ্ট দরিদ্র শ্রেণির ৭১ শতাংশ আয় কমে গেছে। ব্র্যাক জরিপে উঠে এসেছে, করোনায় চরম দারিদ্র্য বেড়েছে ৬০ শতাংশ। সানেমের গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল নির্দেশ করছে, চলমান সংকটের কারণে দেড় দশক জুড়ে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ যে সাফল্য দেখিয়েছে, তা নিষ্ফল হয়ে যেতে পারে। অনেক সময়, একটা ভিত্তিমান সংখ্যাকে প্রবৃদ্ধি কিংবা হ্রাসের হার দিয়ে গুণন (ফ্যাক্টরাইজ) করে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জনমিতির বিভিন্ন সূচকের পরিসংখ্যান বের করা হয়, তাই একটা মহামারীর পরে এই সংখ্যাগুলোর একই ধরনের ডিরাইভেশান সঠিক ফল দেবে না। অর্থাৎ করোনা, ডেঙ্গু, নিউমোনিয়া এবং জ্বর-শ্বাসকষ্ট-সর্দি-গলাব্যথা-কাশি রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব পরবর্তী সময়ে দেশের মানুষের ক্যালরি গ্রহণ, চিকিৎসা ব্যয়, পরিবার বা খানাভিত্তিক আয় এবং কর্মসংস্থানের হিসাব বের করার জন্য নতুন জরিপ লাগবে। অর্থাৎ সুস্পষ্টভাবে নতুন করে আয়-ব্যয়-খানা জরিপ এবং শ্রমশক্তি জরিপ করতে হবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতের চিকিৎসা খাতের মৌলিক প্রস্তুতির জন্য স্যাম্পল ভাইরাল সমীক্ষাকে হালনাগাদ করতে হবে। একটা মহামারী যে, কত ধরনের স্বল্প-মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমস্যা নিয়ে আসে তা অকল্পনীয়।
দুই. পুষ্টিহীনতা বাড়বে :
খাদ্য সংকটে সরকার ও মহানুভব নাগরিকরা এগিয়ে এসে যে সাহায্য দেবে তা নিতান্তই ন্যূনতম ক্যালরি (চাল-ডাল)। কিন্তু এতে বাদ পড়বে অতি গুরুত্বপূর্ণ অনেক পুষ্টি উপাদান। ফলে তিন বা ছয় মাসের পুষ্টিহীনতার পরে দেশের প্রান্তিক ও ভাসমান অর্থনৈতিক শ্রেণিগুলোর পরিবারের সন্তানদের ব্যাপক পুষ্টিহীনতা (ম্যাল নিউট্রিশান) দেখা দিতে পারে। জনস্বাস্থ্য ব্যয়ে দীর্ঘ মেয়াদে কী কী ম্যাসিভ সমস্যা তৈরি করে সেটা আমরা জানি না, এটা গবেষণার দাবি রাখে। আশা করব সরকার এই কাজে দেশের স্বনামধন্য পাবলিক হেলথ এক্সপার্ট এবং দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত বাংলাদেশি গবেষকদের অভিজ্ঞতা ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণাকে কাজে লাগাবেন।
তিন. শিক্ষায় ঝরে পড়া বাড়বে :
চিকিৎসা ব্যয়বৃদ্ধি, পরিবারের সঞ্চয় কমা, উপর্জনক্ষম সদস্যের অসুস্থতা কিংবা বেকারত্বজনিত কর্মহীনতা এবং সেই সঙ্গে খাদ্য সংকট ও পুষ্টিহীনতার করাল ছোবল পড়বে আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায়। অর্থাৎ আয়হীনতায় পড়ে শিক্ষায় ঝরে পড়া বাড়বে, কৃষি ও ভাসমান কাজে শিশুশ্রম বাড়বে। একই সঙ্গে প্রাইমারি, জুনিয়র স্কুল, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ঝরে পড়া বাড়বে এবং পাসের হারও কমে আসতে পারে। সুতরাং এই কঠিন সময়ে শিক্ষা উপবৃত্তির ও কৃষি ভর্তুকির দিকে নজর দেওয়ার জোর দাবি জানাই। বর্তমানের শিক্ষা উপবৃত্তি খুবই নগণ্য। এর তুলনায় শিশুশ্রমের মজুরি অন্তত কুড়ি গুণ বেশি। এখানে একটা ভারসাম্য আনতে হবে, যেতে উপবৃত্তি প্রণোদনা হিসেবে শিশুশ্রমের চাইতে বেশি আকর্ষণীয়।
সুতরাং এই কঠিন সময়ে শিক্ষা উপবৃত্তির ও কৃষি ভর্তুকির দিকে নজর দেয়ার জোর পরামর্শ দেই।
ক। বর্তমানের শিক্ষা উপবৃত্তি খুবই নগণ্য। এর তুলনায় শিশু শ্রমের মজুরি অন্তত কুড়ি গুণ বেশি। এখানে একটা ভারসাম্য আনতে হবে, যেতে উপবৃত্তি প্রণোদনা হিসেবে শিশু শ্রমের চাইতে বেশি আকর্ষনীয়।
খ। শিক্ষা উপবৃত্তিকে অন্তত ১৬ বা ১৮ বছরের সমসাময়িক শ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। শিক্ষার শ্রেণী হিসেবে এটা উচ্চ মাধ্যমিক।
গ। জেএসসি, এস এস সি এবং এইচএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশান এবং পরীক্ষা ফি সরকার উঠিয়ে নিক। এতে করে ঝরে পড়া বন্ধে একটা জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হবে।
ঘ। কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ কোন ভাবেই কমানো যাবে না, বরং সঠিক সময়ে সরকার নির্ধারিত মূল্যে সার বীজ কীটনাশক বালাইনাশক যাতে পাওয়া যায় তার তদারকি চালাতে হবে। মহামারির সময়ের কৃষি ও খাদ্য সংক্রান্ত যে কোন সমস্যা অন্য বহু সমস্যার সূত্রপাত করতে পারে।
ঙ। করোনার পরপরই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের পুষ্টিহীনতা রোধে সারাদেশে একযোগে স্কুলমিল চালুর উদ্যোগ নেয়া হোক।
চার. মনস্তাত্ত্বিক বাধা :
খাদ্য সংকটে পড়া শিশু ও কিশোর দীর্ঘ সময়ে ক্ষুধা তাড়নায় থাকলে দূরারোগ্য ব্যাধি এবং মনস্তাত্ত্বিক আঘাতে পড়ে পিছিয়ে পড়বে। স্বাভাবিক বিকাশ ও শিক্ষা পদ্ধতি এই শিশু-কিশোরদের জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এই বিশেষ শিশু-কিশোরদের বিকাশে বিশেষায়িত স্কুলিং ব্যবস্থাপনা লাগবে। সিডর আইলার মতো প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে পড়া, পিতা-মাতা ও পারিবারিক সহিংসতায় পড়া, সামাজিক অপরাধ ও সড়ক দুর্ঘটনায় ভোগা এবং নদী ভাঙার মতো পরিস্থতিতে বাংলাদেশে এমন শিশু-কিশোর শ্রেণি ইতিমধ্যেই রয়েছে। সরকারকে এই মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাগুলোর স্বীকৃতি দিতে হবে। এর জন্য বিশেষায়িত স্কুল করতে হবে। নামমাত্র প্রতিবন্ধীভাতার নাম করে এই গভীর সমস্যাকে উড়িয়ে দেওয়া চলবে না।
পাঁচ. অলস শ্রমের ঘনীভবন ও নতুন শ্রমবাজার :
১৯৭৪-এর মার্চ থেকে ডিসেম্বরে এক মর্মন্তুদ দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষকে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হিসেবে গণ্য করা হয়। ৭৪-এর এই দুর্ভিক্ষের কারণে গ্রামের মানুষ দলে দলে খাদ্যের জন্য শহরে ছুটে আসে, লঙ্গরখানায় ভিড় করে। গ্রামীণ শ্রমের শহরে ঘনীভূত হওয়ার এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার শেষে বাংলাদেশে অন্তত দুটি নতুন শ্রমবাজারের যাত্রা শুরু হয়, মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক অদক্ষ প্রবাসী শ্রম এবং তৈরি পোশাকের স্বল্প দক্ষ শ্রমবাজার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশে অতি সস্তায় অদক্ষ শ্রম বিক্রি শুরু করেন এবং দেশেও তৈরি পোশাকের একটা সস্তা শ্রমবাজারও তৈরির পদক্ষেপ নেন।
ঠিক এরকম আরেকটি নতুন শ্রমবাজারের সূচনা করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গ্রামীণ নারী ব্যাপকভাবে কৃষি ও কুটির শিল্পে জড়িত ছিলেন। পরে ক্ষুদ্রঋণের আগমনে গ্রামীণ নারী ছোট ছোট উদ্যোক্তার ভূমিকা নিয়েছেন। কৃষি বহুলাংশে কায়িক শ্রম কেন্দ্রিক থেকে যাওয়ায় এবং বছর বছর উৎপাদন মূল্য না মেলায় এই যুগে লোকে কৃষিশ্রমে আগ্রহ হারিয়েছে, কৃষিশ্রমের আবেদনও কমছে। আর্থিক প্রাপ্তির আবেদন বেশ ফুরিয়ে, আবাসন ও শিল্পের চাপে কৃষিজমির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিতে শ্রমের জোগানও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ফলে নারী শ্রমিকের বেকারত্ব একটা বড় আর্থসামাজিক বিষয় হয়েছে। অর্থাৎ শিল্পের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশজ উৎপাদনে কৃষির হিস্যা কমে যায়। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ কুটির শিল্প সংকূচিত হয়। এমতাবস্থায় ব্যাপক সংখ্যক গ্রামীণ নারী শ্রমিক অলস হয়ে পড়েন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে গৃহকর্মীর একটি অদক্ষ শ্রমবাজার তৈরিতে সক্ষম হন।
বর্তমানে একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনগত প্রভাব, বৈশ্বিক মন্দা, করোনা এবং সম্ভাব্য একটি পঙ্গপাল আক্রমণের বিপদ আমাদের সামনে। আগেই ছিল চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অটোমেশনের প্রভাব। প্যানডেমিক হিসেবে করোনা ভাইরাস বা এ জাতীয় সম্ভাব্য সংক্রমণের ফলে বিশ্বজুড়ে মানব সংস্পর্শ বিহীন অটোমেশন কর্মসূচিতে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গতি আসার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়ে গেছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক করোনাজনিত প্রাক্কলনে আনুষ্ঠানিক খাতের অন্তত নয় লাখ লোকের কাজহীনতার শঙ্কা জানিয়েছে। পাশাপাশি শ্রমশক্তির ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ বা ৫ কোটি ১৭ লাখ ৩৪ হাজার মানুষের শ্রমবাজারের অধিকাংশই কাজ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। বিজিএমইএ সূত্রমতে ২৫ মার্চ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তৈরি পোশাকশিল্পের ৯৩৬টি কারখানার ৮০০ দশমিক ১৮ মিলিয়ন পোশাক পণ্যের অর্ডার বাতিল ও স্থগিত হয়েছে, যার মূল্য ২ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ২১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা)। এসব কারখানায় প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক রয়েছেন।
বিশ্বমন্দার স্থায়িত্ব, তৈরি পোশাকের প্রতিযোগী দেশগুলোর করোনার নিয়ন্ত্রণে সাফল্য, অটোমেশান, মূল্য প্রতিযোগিতা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করবে তৈরি পোশাক শিল্পের অর্ডার কতটা ফিরে আসবে কিংবা আদৌ ফিরবে কি না! বলা হচ্ছে, এই মহামারী বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্র পরিবর্তন করে দিতে পারে। মহামারী ঠেকানোর সক্ষমতা, বীমা কোম্পানির আচরণ, সরকারের প্রণোদনা, অর্থনৈতিক সংস্কারের সাফল্য এবং শ্রমদক্ষতা ইত্যাদির ওপর আমাদের কর্মসংস্থানের বাজার নির্ভর করবে। এমতাবস্থায় সম্ভাব্য অলস ও কর্মহীন শ্রমের একটি নতুন আর্থসামাজিক ভিত্তি তৈরি হয়ে গেছে এবং বাংলাদেশকে নতুনভাবে একাধিক স্বল্প দক্ষ এবং দক্ষ শ্রমবাজার খুঁজতে হবে, এবার আর অদক্ষ শ্রমবাজারের নতুন সুযোগ বাংলাদেশ নাও পেতে পারে!
অর্থাৎ করোনার পরেই ‘ঘরে ফেরা’ কর্মসূচি শেষে অলস শ্রমের যে ঘনীভবন হবে, তার টেকসই শ্রমবাজারের গন্তব্য ও প্রস্তুতি নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০২০ রাত ১২:২৭