somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিশি আমায় ভালোবাসে কিনা জানিনা....

১৮ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১১:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সন্ধ্যার বিষণ্ণতা আমায় কুরে কুরে খায়। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর হাল্কা হিমেল হাওয়া যেন প্রলয়ের সংকেত বয়ে আনে। বাস ট্যাক্সি মিনি প্রতিটি যাত্রীযানই পরিপূর্ণ। নিত্য অফিস যাত্রীরা দিশাহারা। জীবনযুদ্ধের এ দৃশ্যপট আমার ক্লান্তি আরও গাঢ়তর করে। বাড়ি ফেরার কোন তাগিদ আমি অনুভব করি না। চঞ্চলা বালিকা, আধুনিকা যুবতী আর অতি আধুনিকা প্রৌঢ়ার দল নিজ নিজ দ্বীপের সীমানা মুছে আজ নতুন দ্বীপের সীমানা রচনায় ব্যাস্ত-আসন্ন বিপদের আশঙ্কায়। এক একটি যাত্রীবাহন আসে-থামে-যায়। বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার দৃশ্যপট পাল্টে যায়। নতুন বৃত্ত রচনা হয়, নতুন দ্বীপ জেগে ওঠে।

হঠাৎই আমার দ্বীপে আবিষ্কার করি তাকে। এক প্রায় বৃদ্ধ লোকের ছাতার তলে নিশি। সময়ের ব্যবধানের স্বাক্ষর সারা দেহে। চোখে ক্লান্তি, দেহ শিথিল। মুখের কমনীয়তায় এসেছে বয়সের প্রজ্ঞা।

চোখে চোখ পড়ে। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সে। প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে জিজ্ঞাসা করে-আপনি?

আমি বলি-তুমি?

সেকেন্ড কাটে, মিনিট কাটে, ঘন্টা কাটে-তারপর কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ পরে সে জিজ্ঞাসা করে-এখানে?

শব্দের জন্ম হয়। লিপি-ভাষা-ব্যাকরণ-অভিধান। আমি প্রয়োজনীয় শব্দ খুঁজে পাই না। পরীরা আসতে শুরু করে। লাল পরী আসত নেচে নেচে পেখম মেলে আগুন রঙা উড়নি গায়ে। মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি করত নীল পরী। আর সবশেষে আসত হলুদ পরী-ঠিক ভোর বেলায়। তখন লাল আর নীলের চোখে ঘুমের ছোঁয়া। তীব্র সুন্দরী হলুদ পরী ঝাঁঝালো আলোয় আলোকিত করে তুলত জলার মাঠ । আমার গ্রন্থিরাশি আস্তে আস্তে আলগা হয়ে আসত। সিক্ত স্বপনে আমি আবিষ্কার করতাম হলুদ পরীর মুখ-সে ছিল নিশি।

আমি বলতেই লাফিয়ে উঠল ইমতিয়াজ। বলল-তুই লোভে পড়েছিলি। প্রথমে আস্বীকার করি। দেহে এক অজানা অনুরণন আসে। মুখ নীচু করি।

একে লোভ বলে, দেখ তোর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। মাহাবুব বিজ্ঞের মত মন্তব্য করে।

আমি সাংঘাতিক ভয় পাই। বাবার মুখটা ভেসে আসে। পরিণামের কথা চিন্তা করে দেহ শক্ত হয়।

তখন আমাদের ছোট শহরে একমাত্র পরিচিত প্রেমিক ছিলেন আজাদ ভাই। বছর পঁচিশ বয়স। সুপুরুষ। পেশায় শিক্ষক। ওনার প্রেম শহরের তাপমাত্রা অনেকদিন উঁচু স্কেলে বেঁধে রেখেছিল। আমাদের মত নতুন গোঁফ-ওঠা কিশোরদের কাছে আজাদ ভাই ছিলেন আদর্শ। যখন সন্ধ্যা বেলা সদ্য ভাঙা তুষাররঙা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে তিনি আমাদের পাশ দিয়ে যেতেন, আমরা ভাষা হারিয়ে ফেলতাম। ফেলে যাওয়া হাল্কা সেন্টের গন্ধ আমাদের অবিষ্ট করত। ইমতিয়াজ বলত-টিউশনি যাচ্ছেন। আমি বলতাম-স্মৃতির কাছে। স্মৃতি ছিল আজাদ ভাইয়ের প্রেমিকা। লম্বা বিনুনীর এক ভীরু বালিকা। বাবা শহরের নামকরা মোক্তার। ব্যাপারটা তিনি জানতেন। হয়ত নীরব সমর্থনও ছিল। যা কিছু আপত্তি ছিল আজাদ ভাইয়ের বাড়ির থেকে। ঠিক যেমন নাটকে হয়। ঘটনার টানাপড়েনে পাড়ায় মাঝে মাঝেই ঢেউ উঠত।

আজাদ ভাইয়ের একছত্র প্রেমের রাজত্বে আর একজন দ্বিতীয় প্রেমিকের প্রবেশ যে শহরকে তোলপাড় করে দেবে তা আমি জানতাম। আসলে সময়টা তখন এত জটিল ছিল না। দূষণ শব্দটি নেহাতই প্রয়োজনে ব্যবহার হত। অর্থাৎ জল, বায়ু, শব্দ এমনকি সংস্কৃতির পরে এটিকে লাগানোর দরকার পড়ত না। কিশোর জগৎ তখন রিয়াজ/শাবনুর এবং সালমান শাহ/শাবনুরের দখলে। ইমতিয়াজ আর মাহাবুব স্কুল পালিয়ে অসংখ্যবার দেখে এসেছে। সেই অসাধারণ প্রেমের বর্ণনায় আমি দিশাহারা। আমরা ক্লাস টেনে পড়ি। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে মাহাবুব তার অননুকরণীয় কন্ঠে মৃদুস্বরে গান শোনাল- 'ওগো তুমি যে আমার'। তারপর একটা চোখ টিপে অর্থবোধক হাসি হাসল। আমি সমঝদারের ভঙ্গীতে আর একটা চোখ টিপে উত্তর দিলাম।

হঠাৎ গলায় চিৎকার-চমকে উঠি - রিয়াদ স্ট্যান্ড আপ। পদার্থ বিজ্ঞানের স্যার বিমানবাবু আগুন ঝরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। উঠে দাঁড়ালাম।

-আপেক্ষিক তত্ত্ব কাকে বলে?

সব তত্ত্বের সংজ্ঞাই আমার জানা ছিল। কিন্তু এর মধ্যে যে কোনটি আপেক্ষিক তত্ত্ব তা আমি কল্পনায় আনতে পারলাম না


- গায়কটি কে?

- মাহাবুব স্যার। ইমতিয়াজ আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয়। কথাটার মধ্যে অবিশ্বাসের কিছু ছিল না। কারন ক্লাসের মধ্যে মাহাবুব আর সুজনই ছিল প্রতিষ্ঠিত গায়ক।

-মাহাবুব। নিল ডাউন ফর রেস্ট অফ দা পিরিয়ড। তারপর বিমানবাবু আমার কল্পনাকে খান খান করে দিয়ে আপেক্ষিকতা তথা তত্ত্ব বোঝাতে লাগলেন।

তুই প্রেমে পড়েছিস- ইমতিয়াজ আবার বলল। কি সাঙ্গঘাতিক ব্যাপার! উকিলদের পারার ডাক্তার বাড়ির দুধরঙের মেয়ে নিশিকে প্রেম। আমার মাথা রিমঝিম করে। এ ধরনের চিন্তা আমার মত নশহুরে কিশোরের পরিপাক করা শক্ত ছিল। কারন তখন সামান্য উপকরনই আমার যৌন চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। পরিচিতা, অথবা কোন নায়িকার অন্তর্বাসের এক ঝিলিক দেখা, গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকার বৃহৎ রাঙামুলোর বিঙ্গাপন কিংবা বই পাল্টানোর সময় কোন মেয়ে সহপাঠী আঙ্গুলের একটু ছোঁয়া আমার কাছে অজানা রাজত্বের চাবিকাঠি ছিল। কিন্তু গোটা রাজত্বের অধিকার সম্বন্ধে আমি নিজেই সন্দিহান ছিলাম। বললাম তাই হয় নাকি? এতো স্বপ্ন। যে কেউ দেখতে পারে।

ইমতিয়াজ রেগে গেল। বলল- জগতে এত মেয়ে থাকতে তুমি নিশিকেই বা স্বপ্নে দেখতে গেলে কেন? ন্যাকামি ছাড় তো। ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছে?

- ধর তুই পূর্ণিমাকে স্বপ্নে দেখলি, তার মানে পূর্ণিমা তোর লাভার হয়ে গেল।

- বোকা, বোকার ডিম। পূর্ণিমা হিরোইন। হাজার হাজার লোক স্বপ্নে দেখে। কিন্তু নিশি? নিশিকে একমাত্র স্বপ্নে দেখে আমাদের রিয়াদ। পাশে বসা সুজন প্রান খুলে হাসতে থাকে।

-ইমতিয়াজের রাগ কমে আসে।

তুই ঘাবড়াচ্ছিস কেন? যাতে একটা হিল্লে হয় দেখছি। মাহাবুবের সাথে একটা প্লান করতে দে। ইমতিয়াজের গলা আত্মবিশ্বাসে ভরপুর।

ইমতিয়াজ ভাল মানুষের মত বলল-ক'দিন রোদে বেরোস না, আর মৃদুলদার সেলুনে গিয়ে ঘাড়টা গোল করে ছেটে আয়।

আমি খোলসে প্রবেশ করি, যাতে স্মরণে-মননে হলুদ পরী হারিয়ে না যায়। বিকেলে খেলার মাঠে যাওয়া ছেড়ে দিলাম। লাল কর্ডের প্যান্টটা বার করলাম। সঙ্গে চেক সার্ট। উকিলদের পাড়ার মোড়ের সরকারী পুলের উপর দাঁড়াই।

বালিকা বিদ্যালয়ের ইউনিফর্মের একটা দল পুলের দিকে এগিয়ে আসে এ পাড়ার অর্ধেক সুন্দরীকে নিয়ে। নীলরঙের স্কুল বালিকারা একে একে পাশকাটিয়ে নামতে থাকে। মুখে ছুটির আনন্দ। সবশেষে আসে আমার নিশি। কচি কলাপাতা রঙের একটা জামা ভীরু চোখে এস্ত হরিণীর মত যাত্রা করে বাড়ির দিকে। কোনদিকে দৃষ্টিপাত না করে। ইমতিয়াজ বলল ও আজ স্কুলে যায়নি প্রাইভেট থেকে আসছে।

এক কিশোর মুগ্ধ বিস্ময়ের স্থবির হয়ে যায়। তারপর ভয়ংকর বয়সের অস্থির যন্ত্রণায় সে ছটফট করে। সে যন্ত্রণা পোষাকের বাধা মানে না। সভ্যতা, ভব্যতা, নীতি, রুচি ইত্যাদি শব্দগুলোকে কামান দাগতে থাকে। মনে হয় শহরের সব কটা মাইক ভাড়া করে উকিলদের পাড়ায় লাগিয়ে দিই। বলতে শুরু করে-নিশি-নিশি-রিয়াদের নিশি।

বৃষ্টির তেজ কমে আসে। আমি জিজ্ঞাসা করি-তুমি এখানে? নিশির চোখে নিভন্ত প্রদীপের আলো। জবাব দেয়-মতিঝিলে একটা ব্যাংকে আছি আজ একটু বেশী দেরি হয়ে গেলো। বৃষ্টিতে আটকে গেছি। আমি বলি আশ্চর্য! আমিও তো মতিঝিলের সোনালী ব্যাংকে চাকরি করি। একদিনও তো তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি।

পৃথিবীতে তো কত আশ্চয়ই থাকে, আমি-আপনি কতটুকুই বা জানি? নিশি ম্লান হেসে জবাব দেয়। তারপর বলে-প্রায় একঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি, কোন বাসে উঠতে পারছি না। আমায় একটু পৌঁছে দেবেন! কোন সুদূর অজানা দেশ থেকে ইহার তরঙ্গে ভেসে আসে-আমায় একটু পৌঁছে দেবেন। আমি নিশিকে নিয়ে চলতে থাকি। জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করি না-কোথায়?

সকালে শহরে হৈ চৈ পড়ে যায়। কারা যেন সারা শহর দেওয়ালে লিখনে ভরে দিয়েছে। রিয়াদ+নিশি। কোথাও বাদ রাখেনি। নিশিদের বাড়ির সামনে মসজিদের দেয়ালে, বালিকা বিদ্যালয়ের দেয়ালে, ঐ পুলের খুঁটিতে, এমনকি নিশিদের বাড়ির দেওয়াল। একঘন্টার মধ্যে খ্যাতির পাদপ্রদীপে চলে আসি। বাবা দুগালে সপাটে চপেটাঘাত করেন। ক্রন্দনরত মা আমার কর্ডের প্যান্ট আর চেক শার্ট আলমারি বন্দী করেন। নাপিত এসে আমার মাথায় রোলার চালিয়ে দেয়।

বিকালে মাহাবুব আর ইমতিয়াজ এসে হাজির হয়। আমি কান্নাভেজা কন্ঠে বলি - তোরা বন্ধু হয়ে এত বড় সর্বনাশ করলি। মাহাবুব অবাক হওয়ার ভান করে- উপকার বল! ভিত আমরা করে দিয়েছি। মহল গড়ার দায়িত্ব তোর। ইমতিয়াজ বলে- নিশি এখন জানে তুই ওকে ভালোবাসিস। এবার তোর জিনিষ তুই বুঝে নে। আমি রাগত সুরে বলি- আমি আর এসব ব্যাপারে নেই। তোদের জন্য আমার এই বদনাম। মাহাবুব ক্ষেপে গিয়ে বলে- বদনাম। প্রেম করবে বদনাম হবে না, ক্ষির খাবে- গোঁফে দাগ লাগবেনা, তবে শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে যাত্রা নাচো। ইমতিয়াজ বলে- আমরাও এর মধ্যে নেই, আর কোনদিন আমাদের কাছে মিনমিন করতে আসবিনা।

স্বাভাবিক নিয়মেই ক'দিন পর ঢেউয়ের তীব্রতা কমে আসে। বিকেল হলেই উকিলদের পাড়া আমায় নেশার মত টানে। একদিন নানা গুপ্তচরের চোখ এড়িয়ে চলে আসি। এক্টু দুরে দাড়িয়ে সময়ের অঙ্ক কষি। হটাৎ এক ঝাঁক মুনিয়ার ডাকে চমকে যাই। ওরা বাস থেকে একে একে উড়ে আসে। নিশিকে দেখি। ও আমায় দেখে। দৃষ্টির শীতলতায় আমার ব্যারমিটারের প্যাঁরা দ্রুত নামতে থাকে। ক'হাত দুরে আবিষ্কার করি নিশির মাকে। চোখে বাঘিনীর হিংস্রতা। যে কোন মুহুর্তে রক্তপাত হতে পারে। একপাটি হাওয়াই ছিটকে চলে যায় নর্দমায়। আর একপাটি নিয়ে গা ঢাকা দিই মসজিদের আড়ালে।

আমাকে অবাক করে একদিন শহরের প্রতিষ্ঠিত প্রেমিক আজাদ ভাই জিঞ্জাসা করলেন- তোমার নাম রিয়াদ না ? আমি মুখ নিচু করে জবাব দিই- হ্যাঁ। তারপর কোন ভুমিকা ছাড়াই বললেন- তুমি নিশিকে ভালবাসো? চুপ করে থাকি, কি জবাব দেব ভেবে পাই না।

- তুমি ভালবাস। তোমার মুখ তাই বলে। তারপর কি ভেবে আবার প্রশ্ন করেন- নিশিকে জানিয়েছ, তোমার মনের কথা?
- না
- কেন ?
- লজ্জা করে, ভয় লাগে।
- ভয় পেলে প্রেম করা চলে না, মেয়েরা সাহসী ছেলে পছন্দ করে।
- বাবা বলেছেন বাড়ি থেকে বার করে দেবেন।
- তা হলে তোমার প্রেম করা উচিত হয়নি।
- কিন্তু আমার যে নিশিকে ভাল লাগে!
- বেচারা! আজাদ ভাই মৃদু হেসে পিঠ চাপড়ে দেন। তারপর বলেন,
- দেখি তোমার জন্য কি করতে পারি।

কি আশ্চর্য! দু-মাস পরে দেখি আজাদ ভাই নিশিকে পড়াতে আরম্ভ করেছেন। মাহাবুব বলে- এবার তোর একটা হিল্লে হবেই। এ ব্যাপারে আজাদ ভাইয়ের প্রচুর অভিজ্ঞতা। ভরসা রাখা যায়।

আমি ভরসা রাখি। দিন যায়। ইমতিয়াজ মাঝে মাঝে খবর আনে। প্রায়ই সন্ধ্যাবেলা পাঁচিলের ধার থেকে আজাদ ভাইয়ের পড়া দেখে। একদিন এসে বলে- আজ দেখলাম আজাদ ভাই রোমিও-জুলিয়েট পড়াচ্ছেন।

কি অপুর্ব আবৃত্তি। সারা ঘর গম গম করছিল।
- আর নিশি? আমি প্রশ্ন করি।
- নিশি? নিশি এক মনে বাঁম গালে হাতদিয়ে শুনছিল।

আর একদিন এসে বলে- আজ বৈষ্ণব পদাবলি শুনলাম। রাধার মানভঞ্জন।

ইমতিয়াজ আশ্চর্য হয়ে বলে- আজকালের ক্লাশ এইটে এ সব পড়ানো হয় নাকি? আমি বলি- হয় হয় সব হয়। ভাল মেয়েরা রেফারেন্স হিসাবে সব কিছু পড়ে।

আবার খবর আনে। নিশিকে সে কাঁদতে দেখেছে। আজাদ ভাই তাকে বকেছে। বোধ হয় পড়া পারেনি। আমি ব্যাথিত হই। আজাদ ভাই বকেছে। নিশি নিশ্চয় রাতে কিছু খায়নি। আমি সে রাতে এক গ্লাস জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম। মা বারবার ডাকাডাকি করল।
- শরীর খারাপ, বিরক্ত কর না, বলে পাশ ফিরলাম।

একদিন বাজারে আজাদ ভাইকে পাকড়াও করি।
- আজাদ ভাইকে, আমার কি হল?
- আরে রিয়াদ না? বলে আমার কাঁধে হাত রাখেন।
- অনেক দিন হয়ে গেল, কি খবর আজাদ ভাই?
আমার করুন কন্ঠে আর্তি।
- ও নিশি? তাই বল। এত তাড়াহুড়ো করলে কি সবকিছু হয় ভাই? সময় লাগে, সময় লাগে।
- আর কতদিন আজাদ ভাই- আমি আর্তনাদ করি।
- বোকা। এটা বেগুনী-আলুর চপ নাকি? দোকানে গেলে আর কিনে আনলে। এর নাম প্রেম। শুধু জমি তৈরি করতেই বছর ঘুরে যায়।
- জমি? অবাক হই।
- হ্যাঁ জমি! আমি তৈরি করি তুমি ফসল তুলো। আজাদ ভাই প্রান খুলে হাসতে শুরু করেন।

আমি বোকার মত চেয়ে থাকি। আজাদ ভাই বলেন- এ সব তুমি বুঝবে না, শাস্ত্রীয় ব্যাপার। সময় হলে সব জানাব।

সব শুনে মহাবুব ক্ষেপে গেল। চেঁচাতে লাগল- আমার এ সব ভাল লাগছেনা। আজাদ ভাই কিছু চাল চেলেছে।
- আমার ও তাই মনে হয়, ইমতিয়াজ বলে।
- তুই আজাদ ভাইয়ের কাঁধে মই দিয়েছিলি কেন? পুরুষ মানুষ একা লড়তে পারিস না? ইমতিয়াজ রাগে ফুঁসতে থাকে।
- তুই যদি সত্যি ভালবাসিস, নিশিকে সোজাসুজি জানা। আমি দপ করে জ্বলে উঠি - জানাবটা কি করে? মাত্র দুবার বাড়ির বাইরে দেখি। একবার স্কুলে যাবার সময় আর একবার ফেরার সময়। আর সব সময় ওই মেয়েমানুষটা ঘিরে ঘিরে রাখে আরো কতগুলো মেয়ে মাঝে মাঝে ওর মাকেও দেখি।
- রিয়াদ। ইমতিয়াজ ধমক দেয়। তারপর বলে- নিজের গুরুজন সম্বন্ধে ওরকম অসভ্য কথা বলতে নেই। শোন, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলেছে। নিশি রোজ রাত নটা নাগাদ পুবের বারান্দায় আসে। চুল আঁচড়ায়। আমি মসজিদের পুকুরে যেতে গিয়ে দেখেছি।
- তাতে কি? মাহাবুব বিরক্ত হয়।
- আমাকে বলতে দে, তারপর রিয়াদ একটা চিঠিতে ওর মনের সব কথা জানাবে। আর চিঠিটা গুলতিতে একটা ঢিলের সঙ্গে বেঁধে ফেলে দিলেই চলবে। ইমতিয়াজ ঝড়ের বেগে কথাগুলো বলে যায়।
- কেল্লা ফতে- মাহাবুব চিৎকার করে ওঠে।

প্রিয়তমা নিশি। দুবার কাটাকুটি করি। না, শুধু নিশিই থাক। সারা জীবন তমার ক্ষতিই করে গেলাম। বিশ্বাস কর, আমি যা করেছি তা শুধু তোমায় ভালবেসে। জানি, তুমি আমায় ভালবাস না। কিন্তু আমি তো বাসি, চিরকালই বাসব। সেই যবে আমার ভুরু হবে তোমার গায়ের রঙের মত- সেদিনও তোমায় ভালবাসব। আমার দিকে একটু তাকিও। না অমন করে নয়, ঠিক হলুদ পরী যেমন করে তাকায় তেমনি করে। অবাক লাগছে না? যদি কোন দিন সুযোগ পাই খুলে বলব। না হয় হলুদ পরীকেই জিজ্ঞেস কোরো। একটু বাদেই তো পরীর দেশে যাবে। শুভরাত্রি- রিয়াদ ।

ঠিক রাত্রি সাড়ে আটটায় আমরা 'অভিযান- হলুদ পরী' বেড়িয়ে পড়ি। ইমতিয়াজের সাইকেলে চড়ে। উকিলপাড়ার শেষ সীমায় এ জায়গাটা প্রায় নির্জন। রাস্তার মোড়ের একটা টিমটিমে আলো ঘন অন্ধকারকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। নিজের অজান্তে ইমতিয়াজের হাত চেপে ধরি। ও নিঃশব্দে আমার হাতে গুলতি তুলে দেয়। আমাকে রেখে ওদিকে দেখতে যায়। আমি অন্ধকারে গোঁজ হয়ে বসে থাকি। মশার কামড় খাই কিন্তু মারতে সাহস হয় না- পাছে আওয়াজ হয়। ইমতিয়াজ ছুটতে ছুটতে আসে। তারপর বলে নিশি এসে গেছে।

অস্ত্রে শাণ দিই। একটা গোলমত ইঁট তুলে নিই। যত্ন করে চিঠিটা ইঁটে জড়াই। তারপর আস্তে আস্তে রওনা দিই নিশিসুন্দরীর দিকে। আজকের অভিযানে ভয় পাই না। কারন পাওয়া কিংবা না পাওয়া এই সরল অথচ আপাত জটিল সমস্যার সমাধান করে দেবে এ অভিযান। আমি নির্বিকার চিত্তে এগিয়ে যাই।

পুবের বারান্দায় নিশি দাড়িয়ে। পরনে হলুদ রঙের জামা। অপরুপ ভঙ্গির সেই কেশ প্রসাধনে ফুটে উঠে নৃত্যের মুদ্রা। আমি স্তব্ধ হই। জোনাকিরা মিটিমিটি আল জ্বেলে পুজো করে- তাদের প্রিয় দেবীকে। প্রানভরে পান করি সেই অপার্থিব রুপসুধা। আমার মরনে খুঁজে পাই জীবনের সব সুখ। ভুলে যাই আমার অভিযান। আর এগিয়ে গেটের কাছে চলে আসি। ভাল করে দেখার জন্য।

হটাৎ নিশি আমাকে দেখতে পায়। চিৎকার করে ওঠে কে? কে ওখানে?
আমি গুলতিতে টান দিই। আর্তনাদ ভেসে আসে- মাগো! মেরে ফেলল! দেখি নিশি মুখ ঢেকে বসে পড়েছে। অনেক কন্ঠের চিৎকার ভেসে আসে।

দৌড়ের মত চেষ্টা করি সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ইমতিয়াজ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। আমি কাছে এসে বলি- পালা, নিশিকে মেরে ফেলেছি। ওকে হতচকিত করে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আবার দৌড়ের চেষ্টায় থাকি। পেছনে অস্পস্ট কোলাহল শুনতে পাই। সাঁ সাঁ করে সাইকেল আমাদের নিয়ে চলতে থাকে।

আমার কোন গন্তব্যস্থল নেই। কোন লক্ষ্য নেই। নিজের অজান্তে কখন হাজির হই আজাদ ভাইয়ের বাড়িতে। এতরাত্রে আমায় দেখে আজাদ ভাই অবাক হন। তারপর জিজ্ঞাসা করেন- হাঁফাচ্ছ কেন? কি হয়েছে?

- আমি নিশিকে মেরে ফেলেছি। ভয়ে কুঁকড়ে যাই। আজাদ ভাই একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন- কি হয়েছে, ঠিক ঠিক করে বল।

গোটা ব্যাপারটা বলি। সব কিছু। কিছু বাদ না দিয়ে।
- তুমি এখানে বস। আমি যতক্ষন না আসি বাইরে পা দেবে না। আজাদ ভাই ইমতিয়াজের সাইকেলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যান।

আমি অকৃতকার্য। আমার কোন অনুভুতি নেই। ফেল করার ভয়ে আর আমাকে কুঁকড়ে থাকতে হবে না। কিছু হারানোর ভয় নেই। কারন আমি হারিয়ে ফেলেছি। নিজের অজান্তে আজাদ ভাইয়ের বিছানায় দেহটা এলিয়ে দিই। কতক্ষন ঘুমিয়ে ছিলাম জানিনা, আজাদ ভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙে।
- উঠে বস। নিশির কপালে তিনটে স্টিচ হয়েছে। চোখটা খুব জোর বেঁচে গেছে।

আমি শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি।
- তোমার চিঠি নিশির মা পেয়েছে। কাল থানায় ডায়েরি করবে।

আমি গ্রিক ভাষা বুঝি না। কোন দিন শিখিনি।
- তোমার বাবাকে খবর দিয়েছি। সকালে বাড়ি যেও।
আমি ফ্রেঞ্চ জানি না। আমি ক্লান্ত, শুয়ে পড়ি।

বাবার ব্যক্তিগত মুচলেখা, নিশিদের বাড়িতে মায়ের ঘন ঘন গমন এবং ক্ষমা প্রার্থনা- আমার কোর্ট ঘর থেকে বাঁচিয়ে দিল। আমি প্রেমরোগ মুক্ত হলাম। ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হলাম।

এর পরের দৃশ্যগুলি খুব দ্রুত অভিনীত হতে লাগল। স্নাতক হয়ে গিয়েছি এতদিনে। খুব সহসা নিজের ব্যক্তিগত আয় বাণিজ্যে ঢুকে পড়তে হবে বাবা সেকথায় বলল।

একবার ঈদে বাড়ি এসে শুনলাম নিশির বিয়ে আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে। অবশ্য নতুন কিছু খবর নয়। এটা জানতাম। শাস্ত্রজ্ঞ প্রেমিক আজাদ ভাইকে ধরা রাখার ক্ষমতা স্মৃতি নাম্নী ভীরু বালিকার ছিল না।

পথে ঘাটে মাঝে মধ্যে ওদের দেখতাম। নিশি সুখি বিড়ালীর মত স্ফীত হতে লাগল। বাতাসে সুগন্ধ ছড়িয়ে রিক্সায় দুজনে হুস করে চলে যেত। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবতাম এ রকমই বুঝি সুখের চেহারা। আমার মনে কোন দুঃখ ছিল না। দেবদাস হবার ইচ্ছাও ছিল না। অক্ষমতার ক্রোধ সময়ের ব্যবধানে তেজ হারিয়ে ফেলেছিল।

তার পরের বছর গরমের ছুটিতে এসে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ইমতিয়াজ বলল- আজাদ ভাই একটা স্কাউন্ড্রেল। আমি চমকে উঠি। আজাদ ভাই নাকি আবার স্মৃতির কাছে যাতায়াত শুরু করেছে। এ নিয়ে খুব অশান্তি। নিশির বাবা আর বেঁচে নেয়। নিশিরা ছিল দুইবোন বড়বোন বিবাহিত চট্টগ্রামে। ওর মাও চট্টগ্রামে থাকে। নিশি নাকি প্রায় ওর মায়ের কাছে চলে যায়।
তারপর থেকে বাড়ি এলেই নিশির খোঁজ করতাম মাহাবুব কিংবা ইমতিয়াজের কাছে।

ইমতিয়াজ বলল- তুই জানিস না? নিশি আর এখানে থাকে না। ও নাকি চট্টগ্রামে থাকে ঐখানেরই কোন প্রাইভেটে এমবিএ করছে। এদিকে আজাদ মাস্টার নাকি ফের স্মৃতিকে বিয়ে করেছে।

বৃষ্টি থেমে গেছে। সন্ধ্যার বিষন্নতা কেটে এখন আকাশ মেঘমুক্ত। চাঁদ প্রলয়ের স্মৃতি মুছে দিতে মিটি মিটি হাসে। কখন নিশি হাত আমার হাতে ধরা দিয়েছে আমি নিজেই জানি না। আমি এগিয়ে চলি।

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১১:১৩
১১টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×