somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেষমেশে এসে বাবা আমাকে ত্যাজ্যই করে দিলেন....

২১ শে মার্চ, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আলো অকৃপন বলেই হয়তো মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট সংলগ্ন আর পাঁচটা বাড়ির মত ছোট বাড়িটার চিলে কোঠায় হাজির হয়েছে। এলাকার অনেক মানুষ তখনো ঘুমিয়ে। আজমল সাহেবের এ অভ্যাস কোনো দিনও নেই। বরং কাকভোরের আলোকে সম্ভাষণ করা তার জীবনে দৈনন্দিন ঘটনা।
এখনো শীত দাঁত ফোটাচ্ছে শহর জুড়ে। আজমল সাহেব বিছানা ছেড়ে নিয়ম মাফিকের মত জানালাটা খুলে দিলেন। একটু পরেই মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে গেল। বাড়িতে ছেলে, ছেলের বউ, একমাত্র স্কুল পড়ুয়া নাতনী তখনো তাদের বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। আজমল সাহেব বিপত্মীক ও রিটায়ার্ড মানুষ।

আজমল সাহেব সাড়ে সাতটায় মর্নিং ওয়াক থেকে বাড়ি ফেরেন। ততক্ষণে বাড়ির ঝি এসে যায়। রিয়াদের অফিস তাই মাধুরী ঝি-এর সাথে রান্নার কাজে ব্যস্ত। আজমল সাহেব ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসেন এবং ডেস্কের ড্রয়ার থেকে শিক্ষাশ্রমের ফাইলটা বের করে তার নথি ঘাঁটতে থাকে। পিছন থেকে ঝি এক কাপ চা নিয়ে সামনে টেবিলের একধারে রেখে বলে চাচা খেয়ে নেন।

আজমল সাহেব বাড়ি ফেরার পর মাধুরী আর রিয়াদের মধ্যে একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
মাধুরী বলে বসে- বাবাকে কথাটা বলবে না?

রিয়াদ চা-য়ে আলতো চুমু দিয়ে পালটা বলে- কথাটা তো তুমি বলতে পারো।

- দেখো বাবার হাবভাব আমার ভালোলাগে না, তুমি বরং বাবাকে একটু সময় দাও। এটা ওটা বলার ফাঁকে কথাটা বলে ফেলো।

- তুমি বললে অসুবিধা কোথায়?

- আমাকে যদি না করে দেন - এ অপমান 'আমি নিতে পারব না।

- এতে অপমানের কি আছে, ভালো লাগে টাকা দেবেন, না লাগলে না দেবেন।

- না, তুমিই বলো। আমি বরং বাবার পছন্দসই একটা খাবার বানাই। মাধুরী এক রকম ঠেলা দিয়ে রিয়াদকে বাবার ঘরে পাঠিয়ে দিল।

রিয়াদ ঘরে ঢুকে দেখলো বাবার ঘুম ছাড়া বিছানাটা অগোছালো। পোশাকগুলো বাদুড়ের মতো দেওয়ালের হুকে ঝুলছে; যার বেশ কয়েকটায় সাবান পানির ছোঁয়া প্রয়োজন। মাধুরী ঝি-কে দিয়ে আজমল সাহেবের পোশাক সাফ করায়। ঝি কখনো সখনো এ সপ্তাহের ধোয়া ও সপ্তাহে ফেলে রাখে। রিয়াদ দেখল বাবা একটা ফাইল খুলে কিছু দেখছে, পিছন থেকে এগিয়ে এসে সে বাবাকে জিজ্ঞেস করে - বাবা তুমি কি এখন ব্যস্ত আছো?

আজমল সাহেব আচমকা ঘাড় ফিরিয়ে উত্তর করেন - না, তেমন কিছু না। কেন কিছু বলবি?

- একটু কথা ছিল।

আজমল সাহেব ফাইল-টা বন্ধ করে বলে উঠেন - কিছু বলার থাকে বল, তোর সাথে আর কথা হয়ে ওঠো না। সকালে তোর অফিস । আমিও সন্ধ্যায় এখানে ওখানে বেড়িয়ে পড়ি। তা বল।

- তোমার বউমা কিছু টাকার কথা বলছিল।

আজমল সাহেব রিয়াদের দিকে এক দৃষ্টে তাকায় এবং জিজ্ঞেস করেন-কত টাকা?

আজমল সাহেবের প্রশ্নে রিয়াদ কিছুটা সংকোচ বোধ করে। টাকার অঙ্কটা বলতে তার দেরি হয়। ততক্ষণে মাধুরী আজমল সাহেবের জন্য খাবার নিয়ে এসে পড়ে। আজমল সাহেব বউমাকে দেখে তাকেই আবার জিজ্ঞেস করেন- বউমা তোমার কত টাকা চাই?

মাধুরী আজমল সাহেবের সামনে খাবারের প্লেট রাখতে রাখতে বলে, চার-লাখের মত হলে হবে।

আজমল সাহেব বেশ অবাক হন এবং জানতে চান- এত টাকা কি করবে?

- একটা ফোর হুইলার কিনবো তাই।

- ফোর হুইলার! কিন্তু এতো সবের দরকার কি?

মাধুরী তাকে বোঝাবার চেষ্টা করে-মৌমি’দের স্কুলে প্রায় সকলে নিজেদের গাড়িতে করে আসে। তা ছাড়া বাসে বাচ্চা নিয়ে যাতায়তে একদম যা-তা অবস্থা হয়, তাতে করে...

রিয়াদ কোনো কথা বলে না। তার শরীরে একটা সংকোচ ক্রমেই স্পষ্ট হয়। সে তুলনায় মাধুরী অনেক বেশি সপ্রতিভ।

আজমল সাহেব পাল্টা জবাব দেন- অনেকেইতো বাসে বাচ্চা নিয়ে নিরাপদে স্কুল যায়। যদি দেরি হয় মনে করো কিছুটা আগে বেরুলেই পারো।

রিয়াদ আজমল সাহেবকে কিছু একটা বলবে এই ইচ্ছায় মাধুরী পাল্টা কিছু বলে না। রিয়াদও পিছনে বাবার বিছানায় বাধ্য ছেলের মতো বসে পড়ে। অবস্থা বিপরীত দেখে মাধুরী হাল না ছেড়ে বলে- আপনার প্রভিডেণ্ড ফাণ্ডের এত টাকা নিয়ে আপনি কি করবেন। সেই তো আমাদেরই থাকবে। তাছাড়া আমরাইতো সবসময় আপনাকে দেখাশুনা করবো।

শেষের কথাগুলো আজমল সাহেবের গায়ে লাগে। তাড়াতাড়ি উত্তর দেন - ও টাকার কাজ আছে। মাত্র তো আট লাখ টাকা। তাছাড়া তোমার শ্বাশুড়ির চিকিৎসা আর বাড়ি মেরামতের কাজে আগেই ঐ টাকার একটা অংশ ব্যায় হয়ে গেছে। সে তো রিয়াদ জানে।

- তুমি এতগুলো টাকা রেখেই বা কি করবে? রিয়াদ এবার মুখ খোলে।

আজমল সাহেব একটু ভেবে নিয়ে বলেন- জানতে চাও। তা হলে শোনো। এ টাকার মধ্যে চার লাখ টাকা একটা অনাথ আশ্রমে দান করব বলে আশ্রমের কর্তৃপক্ষকে কথা দিয়েছি। কন্যা দায়গস্থ এক বাবাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেব ঠিক করেছি। বাকিটা নিজের টুকিটাকি খরচ হবে। তোমাদের দেবার মতো টাকা কোথায়। যদি চাও আমার খরচের জন্য টাকাটা তোমরা নিতে পারো। আমার আপত্তি নেই।

রিয়াদ আর ঠিক থাকতে পারে না, কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং বলে- এতগুলো টাকা তুমি অনাথ আশ্রমে দান করছো আমাদের বঞ্চিত করে।

সাথে সাথে মাধুরীও হতবাক হয়। তার চোখে মুখে একটা চাপা তীব্র ক্রোধ ফুটে ওঠে। সে বলে বসে- অদ্ভুদ ব্যাপার! ঘর-কে মেরে পরকে বাঁচানো।

আজমল সাহেব তাদেরকে শান্ত করার চেষ্টা করেন- তোমরা হয়তো রাগ করছো আমার ওপর। কিন্তু এই আশ্রমটার একটা ভালো স্কুল বিল্ডিং দরকার। অনেক অনাথ ছেলে মেয়ে ওখানে বেড়ার ঘরে পড়াশুনা করে। ঝড় বৃষ্টিতে ওরা কষ্ট পায়।

মাধুরী কিছুটা কাতর হয়ে বলে- কিন্তু টাকাটা তো এখনো দিয়ে দেন নি।

আজমল সাহেবের সদৃঢ় উত্তর- না, কিন্তু কথা যখন দিয়েছি, তখন দিতেই হবে।

রিয়াদ জোর দিয়ে বলে- তা, কিছু কম দিলে পার, এক লাখের মতো আমাদের তিন লাখ হলেও দাও।

আজমল সাহেবের উত্তর- স্কুলটা করতে সাত লাখের মতো ব্যায় হবে। আপাততঃ আমার চার লাখ ওদের মূল ভরসা।

মাধুরী আজমল সাহেবের কথা শোনা আর প্রয়োজন বোধ না করে সক্রোধে ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল। রিয়াদ ঘর থেকে বেরোবার আগে বলে গেল- তোমার টাকা তুমি বোঝো।

আজমল সাহেব যে ফাইলটা দেখছিল, সেটাতে গাজীপুরের একটা অনাথ আশ্রমের অ্যানুয়াল রিপোর্ট, অডিট রিপোর্ট, আশ্রমের বিভিন্ন কাজকর্মের ফটোকপি ইত্যাদি গোছানো। রিয়াদ চলে যাবার পর সেটা বন্ধ করে দেয়। পরে চেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেন সকালের আলো এখন অনেক বেশী পরিবেশকে ঢেকে দিয়েছে। পাশের কর্মব্যস্ত রাজপথে গাড়ী আর চলমান মানুষের স্রোত।
এখানে আজমল সাহেব যেটা অনুধাবন করেন- আকাশের নীচে এই মুক্ত আলো বাতাস মানুষ জগতের সবকিছু যেন একে অপরের পছন্দ অপছন্দ উপেক্ষা করে কেবলমাত্র নিজের স্বার্থপুরণে ব্যস্ত। ব্যস্ত মানুষের স্রোতের পিছনে স্বার্থপূরণের একটা ছুটন্ত লেজ। দেখতে দেখতে বেলা বেড়ে উঠছে। রিয়াদ নিজের কাজে বেরিয়ে গেল। বউমা বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে তার সাথে। একটু পরে ঝি মেয়েটি কেটে পড়বে। তখন আজমল সাহেবের জন্য টেবিলে ঢাকা খাবার-টায় কেবল অপেক্ষা করে তার জন্য।

স্কুল থেকে বাচ্চা নিয়ে মাধুরী যখন ঘরে ফেরে আজমল সাহেব তখন তার নিজের ঘরে শুয়ে। অন্যদিন মাধুরী এ সময়ে নিয়মমাপিক তার শ্বশুরকে চা আর কিছু হাল্কা খাবার দেয়। আজমল সাহেবও এ সময়ে তার একমাত্র নাতনীকে নিয়ে আদর আর হাসিঠাট্টা করে। মৌমি সে সময় দাদুর গা মাথা চড়ে নেয়। বউমা ও নাতনী ঘরে ফিরেছে দেখে আজমল সাহেব উঠে চেয়ারে বসেন। চা-নাস্তা আর নাতনীর হাজিরার বিলম্ব দেখে সে ড্রয়িং রুমে চলে আসেন। ততক্ষণ বউমা তার মেয়েকে নিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আজমল সাহেবের একটা খটকা লাগে। তিনি মাধুরীর ঘরের সামনে গিয়ে নাতনীকে ডাকে,- দাদুভাই বাইরে এসো।

আজমল সাহেবের ডাকের কোনো উত্তর আসে না। তিনি এবার দরজায় কয়েকবার ঘা দেয় আর নাতনীকে ডাকে। কিন্তু বউমা বা মৌমি কেউই সাড়া দিল না। আজমল সাহেব সকালের ঘটনা স্মৃতিচারণ করে কিছু একটা অশুভ অনুমান করেন। এবার তিনি বউমাকে ডাকেন,- বউমা সাড়া দিচ্ছ না কেন?
দাদুভাইকে আমার কাছে পাঠাও।
কিন্তু কোনো উত্তর না পেয়ে আজমল সাহেব নিজের ঘরে ফিরে যান।

এ পরিস্থিতিতে মানুষ কিছুটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। তাই আজমল সাহেব আর বাড়াবাড়ি না করে নিজের খাটে পা ঝুলিয়ে ঠায় রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। পরে আজ একটু আগে সন্ধ্যার আড্ডায় বেরিয়ে গেলেন। তবে মনটা অন্যদিনের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।

সন্ধ্যার পর রিয়াদ ফিরে এলে মাধুরী বলল- দেখো, এ সংসারে আর সুখ নেই। এতগুলো টাকা তোমার বাবা নয় ছয় করছেন।

- নয় ছয় করতে দাও, পরে বোঝাবো।

- দেখো, তোমার বাবাকে আমি আর সেবাযত্ন করতে পারব না।

- অসুবিধা মনে করলে বাবার সমস্ত কিছু ঝি-কে দিয়ে করাবে।

- কিন্তু এখানে থাকলে তো চোখাচোখি করতে হবে। আমার দ্বারা সম্ভব নয়।

- তা ছাড়া উপায় কী।

- অন্য কোথাও একটা ঘর নাও। চাও-তো তুমি তোমার বাবাকে এসে দেখে যাবে।

রিয়াদের মধ্যে একটা আলতো হতাশা ফুটে ওঠে সে বলে- কিন্তু আমরা যে অবস্থায় থাকি এ রকম ঘরের ভাড়া অনেক। আমার মতন একজন নিন্মমধ্যবিত্তের ক্ষেত্রে টানা কি সম্ভব? তা ছাড়া বাবার পেনশানের কিছুটা টাকা তো আমাদের সংসারে খরচ হয়। বাইরে গেলে সেটাও যাবে।

মাধুরী থামবার নয় সে জানিয়ে দেয়- তবে তুমি তোমার বাবাকে নিয়ে থাকো। আমি আমার বাবার কাছে যাচ্ছি। ওখান থেকে মৌমি’কে স্কুল করাবো।

রিয়াদের কিছু একটা চিন্তা করতে করতে মাধুরীকে বলে - দেখি বাবাকে আরেকবার বলে দেখি।

মাধুরী বাধা দেয় - আর দরকার নেই। তোমার বাবার যা শয়তানের জেদ। গাড়ির জন্য টাকা দেবে না।

রিয়াদ এখানেই থেমে যায়।।

পরের দিন থেকে আজমল সাহেবের সঙ্গে পরিবারের আর সকলের ঠারে ঠোরে একটা সম্বন্ধ চলতে থাকে। মাধুরী মৌমি’কে একরকম আটকে রাখে আজমল সাহেবের আয়ত্ব থেকে। রিয়াদ-ও তার বাবার সামনে এখন থেকে অনেক বেশী ব্যস্ততা দেখায়। এভাবেই কয়েক মাস কেটে যায়। আজমল সাহেব ঠিকই বুঝতে পারেন গাড়ীর জন্য টাকা দিলে এ ঝঞ্ঝাট মিটে যেত। কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্ত অনড়। সেই নির্ধারিত সময়ে তিনি আশ্রমের হাতে তার টাকা তুলে দেবার বন্দোবস্ত করে বসেন।


দেখতে দেখতে গ্রীষ্মকাল। আগুন ঝরছে শহর জুড়ে। এমন এক দুপুরে শহরের মানুষ যখন এক কোমর গরম ঠেলে নিজের তালে ছোটাছুটিতে ব্যস্ত, আজমল সাহেব নিজের কিছু জিনিষপত্র গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে প্রস্তুত। আজ শুক্রবার। সকলেই বাড়িই ছিল। আজমল সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে সেখানে রিয়াদ তার ছেলে, বউকে নিয়ে টিভি দেখছে সেখানেই এলো। সে রিয়াদ’কে বললেন - আমি সপ্তাদুয়েকের আশ্রমের কাজে গাজীপুর যাচ্ছি। আমি গেলে ওদের স্কুল বিল্ডিংটার কাজ শুরু হবে।

রিয়াদ বিশেষ কিছু বলে না - ঠিক আছে। শুধু এইটুকু বলে সে তার কথা শেষ করে নেয়।

আজমল সাহেব এবার মাধুরীকে বললেন - আসি বউমা।

সে মৌমি’কে বললে - আসি দাদুভাই। দুষ্টুমি করবে না।

মৌমি’ই শুধু ঘাড় নেড়ে তার শুভকামনা করে।

দিন পনের পর আজমল সাহেব গাজীপুর থেকে ফিরে আসে। সে দিন-ই রাতে রিয়াদ আজমল সাহেবের ঘরে এলো।
আজমল সাহেব ফাইল খুলে কিছু একটা দেখছিলেন। রিয়াদ পিছন থেকে ডাকল - বাবা।

- কে, রিয়াদ, কিছু বলবি? আজমল সাহেব জিজ্ঞাসা করে।

- সামনের মাসে আমরা অন্য বাসায় উঠে যাচ্ছি। এ বাসা ছেড়ে দিয়েছি।

আজমল সাহেবের মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠলো। হাতের কাগজগুলো হটাৎ ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। তিনি বলে ওঠেন - দিয়েছিস মানে ?

- হ্যাঁ ওখানে গেলে আমাদের কাজকর্ম সুবিধা হবে।

আজমল সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন - সেটা কোথায়?

- আজিমপুরের ওই দিকটায়। তাছাড়া তোমার বউমা আর এখানে থাকতে চাইছে না। আজমল সাহেব এবার বিষয়টা পুরোপুরি বুঝতে পারে। তিনি বুঝতে পারেন এই পনেরো দিনের মধ্যে বাড়ি বদলের সিদ্ধান্ত। তিনি বিষন্ন ভাবে বলে উঠেন - যেটায় তোদের সুখ সেটাই কর। আমি আর কি বলব। কিন্তু এখানে তোদের অসুবিধা কোথায় ?

- আসলে তুমি বউমাকে টাকাটা দিলে না......

আজমল সাহেব আর কিছু বললেন না, নিচু হয়ে মেঝের ছড়ানো নথিগুলো তুলতে থাকেন। নিজের কাজে মন দেন। রিয়াদও ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

বিপত্মীক আজমল সাহেবের জগৎ-টায় একটা দুর্ভাবনা যোগ হলেও তিনি নিজেকে সংযত রাখেন। ইতিমধ্যে তিনি একটা বিবেচ্য পথ খুজতে থাকেন। বিচ্ছেদটা পুরোপুরি হওয়া দরকার। হাতে মাত্র ত্রিশ দিন সময়।

সময় সামনে চলে বলেই রিয়াদের বাসা বদলের দিনটা আজমল সাহেবের সংসারে এসে হাজির। বোধহয় একটু তাড়াতাড়িই এলো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের প্যাকিং আর লাগেজ তৈরি। কয়েকজন মুটে কাজ করে চলছে, বাড়ির সামনে ছোট একটা পিক-আপ ভ্যান দাঁড়ানো। এগুলো নিয়েই বিদায় হবে। এদিন আজমল সাহেব আজ মর্নিং ওয়াকে যান নি। নিজের ঘরে বসে স্ত্রীর পুরানো ছবিটার ধুলো ঝাড়ছিল। রিয়াদ বাবাকে বলতে আসে, ইতস্তত করে বলে- আমরা যাচ্ছি।

আজমল সাহেব কোনো উত্তর না করে রিয়াদের পিছন পিছন ড্রয়িং রুমে আসে যেখানে বউমা আর নাতনী দাঁড়িয়ে, সেখানে এলো। তার হাতে ফোল্ড করা কাগজ।
এ মুহূর্তে নিজের অহং নিয়ে প্রত্যেকে এক-একটা চলমান গ্রহশক্তি। অথচ সবাই শব্দহীন, সবাই বোবা।
এ শব্দহীনতা ভেঙে হাতের কাগজটা খুলতে খুলতে আজমল সাহেব দৃঢ় গলায় বলে ওঠেন,- 'যাচ্ছ যখন এটাতে একটা সই করে যাও।'

- কি? রিয়াদ জানতে চাইল।

- এটাতে তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র করার কথা আছে। কোর্টের কাগজ।
ছাড়াছাড়িটা পুরোপুরি হওয়াই ভাল।

রিয়াদ যেন একটা ধাক্কা খেলো হাজার ভোল্টের। থমথমে চেহারার আর্তনাদ গিলতে গিলতে পাশে সোফার ওপর বসে পড়ে। মাধুরীও সংক্রমিত। সোফার এক কোণে বসে হাত দুটোর মধ্যে মাথা গুঁজে দেয়। মৌমি ছুটে এসে আজমল সাহেব হাতের কাগজটা ধরে বলল- দাদু, আমি সই করবো?

মৌমি মাধুরীর পাশে দাঁড়িয়ে দাদুর কথা শুনছিল। তাছাড়া সে দাদুর অনেক কথায় ঢুকে পড়ে। এ অবস্থায় আজমল সাহেব ডান হাত নাতনীর মাথায় রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন বাড়ির পশ্চিম’ধারের জানাল ছুঁয়ে বিকালের আলো তির্যকভাবে তার বৃদ্ধ শরীরটায় এসে পড়েছে।
তিনি নিজেকে ভাল করে একবার দেখেন, তিনি দেখলেন তিনি এখন অনেক বেশী আলোকিত।

ওদিকে পিক-আপ ভ্যান তৈরি। একজন মুটে আওয়াজ দিল- স্যার সবকিছু তুলে নিয়েছি।

স্যার আর উত্তর করে না। রিয়াদ তার ভেতরটায় সিক্ত অনুভব করে। খোলা দরজাটা এই-মুহূর্তে যেন আরো প্রশস্থ হয়েছে।

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১৩ ভোর ৪:৫৪
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×