somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবি

২৭ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১০:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কবি

“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?'
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”

অডিটোরিয়ামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় থমকে যাই কবিতাটা শুনে । এমন ভরাট গলার আবৃত্তি অনেকদিন শুনি না । শেষবার শুনেছিলাম রাফির মুখে । আজ এই কবি আমাকে নতুন করে রাফির কথা মনে করিয়ে দিলো । কবির নাম জানার আগ্রহকে গলা টিপে হত্যা করে অডি পার হওয়ার জন্য দ্রুত হাঁটা শুরু করলাম । কেন জানিনা , যে জিনিসটা আমি সব সময় এড়িয়ে যেতে চাই ঠিক সেটাই আমার ঘাড়ে এসে জুড়ে বসে । কোথা থেকে কথা নাই বার্তা নাই অদ্রি ছুটে এলো ।

অদ্রি ওরফে অদ্রিতা চৌধুরী , আমার অতি ঘনিষ্ঠ বান্ধবী । কথা একটু বেশি বলে, কিন্তু মনটা অনেক ভালো । আমার সুখ-দুঃখের সময়ে ওর উপস্থিতি যেন আমার জন্য এক অত্যাবশ্যকীয় জ্বালানী ।

অদ্রিঃ কিরে ? আজ কবিতা মঞ্চের আসর ছিল, আর তুই কিনা অডির বাইরে?? কি হয়েছে তোর ?

আমিঃ কিছু নারে, মাথাটা খুব ধরেছে তো তাই তাড়াতাড়ি হলে যাচ্ছিলাম ।

অদ্রিঃ মাত্র বনলতা সেনের কবিতাটা যে ছেলেটা পড়লো ওর নাম রুদ্র । ইইই তে পড়ে । এত্ত সুন্দর আবৃত্তি করে না ছেলেটা , ইশ!! শুনলেই মনে হয় আবার প্রেমে পড়ি ।

“ওহ, রুদ্র । বাহ! বেশ সুন্দর নাম তো । নাম শুনলেই মনে হয় এ কবি না হয়ে অন্য কিছু হলে একে মানাত না । ” –কয়েক সেকেন্ডেই মনের ভিতর ভাবনাগুলো উঁকি দিয়ে গেল ।

আমিঃ তা পড় না , কে মানা করেছে ?? তোর প্রেমিক তো তোকে ছাড়তে পারলেই বাঁচে ।

অদ্রিঃ কিইইইইই!!!!

দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠি আমরা ।


***

রাফি ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র ছিল । আমার ২ বছরের সিনিওর ছিল ও । ঢাকাতে গিয়েছিলাম এডমিশন কোচিং করতে । তখন ওর সাথে আমার পরিচয় । যেমন সুন্দর করে পড়াতে পারতো , ঠিক তেমনি সুন্দর আবৃত্তিও করতে পারতো । আমার বড় আপু পড়ত ঢাকাতে । তার সাথেই একদিন এক কবিতার আসরে গিয়ে রাফির সাথে দেখা আমার । অবাক হয়েছিলাম এতো সুন্দর আবৃত্তি শুনে । পদার্থের ছাত্রের মুখে এতো ভালো আবৃত্তি শুনে একটু খটকা লেগেছিল বইকি । কিন্তু খটকাটি বহিঃপ্রকাশ হলেও অন্তরে মুগ্ধতার কমতি ছিল না এতোটুকুও । বরং ক্লাস করার নিমিত্তে মুগ্ধতা নিরন্তর বৃদ্ধি-প্রাপ্ত হচ্ছিলো ।

এভাবে এডমিশন কোচিং করার ফাঁকেই একদিন ও প্রস্তাব দিলো আমার ফ্রি টাইম থাকলে আমাকে একটু ঢাকাটা ঘুরিয়ে দেখাবে । কি জানি কিসের টানে রাজি হয়েছিলাম আমি ওর প্রস্তাবে । তখনও বুঝিনি আমার কিশোরী মনে এই মুগ্ধতাই প্রেমের জন্ম দিচ্ছে । (**)

অতঃপর কাঙ্ক্ষিত দিনটি এলো । ওর জন্মদিন ছিল সেদিন । কেন জানিনা নিজেকে নীল শাড়ীতে জড়িয়ে নিতে বড্ড ইচ্ছে করছিল । কিন্তু দ্বিধা-ভয়ও ছিল মনে । শেষপর্যন্ত ইচ্ছেরই জয় হল । নীল শাড়ীতে সাদা সুতার কাজ, হাতে নীল চুড়ি , কানে নীল ঝুমকো আর কপালে নীল টিপ । সাধাসিধে সাজের মধ্যে একটু উপরে । কিন্তু এই সাজেই যখন গেটের বাইরে এক পা দিলাম , আমার সারাটা মন শিহরিত হল এক অদ্ভুত ভাবনায় । সে কি আমায় দেখে মুগ্ধ হবে ??
তার খোঁজে সামনে তাকাতেই আশ্চর্য হতে হল । কি অদ্ভুত ব্যাপার !! সেও নীল পাঞ্জাবী পড়ে এসেছে । আমি তন্ময় হয়ে আমার স্বপ্নপুরুষটিকে দেখছিলাম । হঠাৎ তার ডাকে আমার ভাবনার ছন্দ-পতন হল । দেখি সে রিকশায় বসে আমায় ডাকছে ।
কিভাবে রিকশায় উঠেছি আর কিভাবেই বা লেকে পৌঁছেছি জানিনা । জানলাম যখন সে আমার হাত ধরে আমায় নামতে সাহায্য করলো তখন । শুধু এটুকুই মনে আছে , রিকশায় ওঠার পর একটিবারের জন্যও তার দুচোখ থেকে আমার চোখদুটি সরেনি । অপলক চেয়ে ছিলাম সারাটা পথ ।
লেকের পাড়ে বসেও অনেকক্ষণ কোন কথাই হয়নি । গোধূলি-লগ্নে আবারো তার ভরাট গলার আবৃত্তি ,

“সুরন্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা অই যুবকের সাথে
ফিরে এসো সুরন্জনা :
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে ;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে ;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার ;
দূর থেকে দূরে-----আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর ।”

জানতাম জীবনানন্দই ওর প্রিয় কবি , তাই আমিও নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি । আমিও আমাকে বিলিয়ে দিয়েছিলাম কবিতার পরতে ।

“আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;
বলেছিলোঃ 'এ নদীর জল
তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল;
সব ক্লান্তি রক্তের থেকে
স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;
এই নদী তুমি।'

'এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?'
মাছরাঙাদের বললাম;
গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম।”
এই কবিতা থেকেই রাফি আর আমার প্রেমের সূচনা । বহুদুরের পথ একসাথেই পাড়ি দিবো বলে কথা দিয়েছিলাম । মেডিক্যালের পরীক্ষা পিছানোর দরুন আমার পড়াশোনাও কিছুটা ঢিল হয়ে গেল । ভাগ্যিস একসাথে ভার্সিটি কোচিংও করতাম । কি ভাগ্য !! এতো ভার্সিটির মধ্যে কিনা কুয়েটেই চান্স হল । খুব মন খারাপ হয়েছিল । কিন্তু রাফি আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে খুলনায় পাঠাল ।
এখানে এসে বন্ধুদের পেয়ে কষ্ট কিছুটা হলেও ভুলে থাকতাম । কেননা, রাতের আকাশের তারা গোনার পাশাপাশি আমার আর রাফির স্বপ্ন বুননও চলত সমান তালে । ওর কথাতেই এখানকার কবিতা মঞ্চের সাথে যুক্তও হয়ে পড়লাম । এখানে আসার পর একটা বছর কিভাবে স্বপ্নের মতো কেটে গিয়েছিলো জানিনা । কিন্তু একবছর পরেই আমাদের মধ্যে টানাপড়েনটা বাড়া অবধি কমেনি । তুচ্ছ কিছু কারণে আমাদের সেই স্বপ্ন কাঁচের মতো টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিলো নিমিষেই । সবকিছুর মধ্যে অবাক করা বিষয় ছিল এই একটাই । এইদিনও ওর জন্মদিন ছিল ।

***

রাফির সাথে সম্পর্কের ইতি ঘটার পর ৬ টা মাস কেটে গেছে । ওকে ভোলা সম্ভব না জানতাম, কিন্তু ইচ্ছে করেই অনেক কষ্ট লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম । আমার এই দুঃসময়েই অদ্রির আগমন । আমার মন ভালো করার জন্য এহেন সুকর্ম দুষ্কর্ম নেই যা সে করেনি । জোর করে কবিতা মঞ্চেও নিয়ে যেত ও আমায় । আজ রুদ্রের ভরাট কণ্ঠের আবৃত্তি শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি আমি । ভাসিয়ে দিয়েছিলাম বৃষ্টির জলে । হুম, সেদিন আকাশটা কেঁদেছিল খুব ।




_____________________________________________________________
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×