দেশ ডিজিটাল হচ্ছে শুনে দেশের নাগরিক হিসেবে আনন্দ হবার কথা উল্লাস করার কথা। সবকিছুতেই আধুনিতার ছোয়ায় মনে প্রশান্তি আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রীর শিক্ষা ব্যবস্থায় ডিজিটাল করতে গিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের যে হয়রানি করা হচ্ছে তাতে আনন্দের চেয়ে দুঃখই বেশি দিচ্ছে।
একাদশে ভর্তির রেজাল্ট দিতে গিয়ে নির্ধারিত তারিখ থেকে সাত-আট দিন পরে রেজাল্ট দিয়েও ভোগান্তি শেষ করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
ভর্তির সময় শেষ হলেও অনেক শিক্ষার্থী ডিজিটালে গ্যারাকলে পরে এখনো ভর্তি হতে পারেনি। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী কোন কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় নি। ছাত্রের জন্য আসন নেই এমন কলেজে ছাত্র ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আবার ছাত্রীর জন্য আসন নেই এমন কলেজেও ছাত্রী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
আবার বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী মানবিকে আর মানবিকের শিক্ষার্থী বিজ্ঞানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দিয়েছে ভুলে ভরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল সিস্টেম।
ভর্তির রেজাল্ট দিতে গিয়ে শিক্ষা মন্ত্রী বলে ফেললেন রেজাল্ট দিক আর না দিক ১ তারিখ থেকে ক্লাস শুরু। এই বক্তিতা শিক্ষার্থীদের যতটুকু না সাহস দিয়েছে তার চেয়ে চিন্তিত বেশি করেছে।
এ নিয়ে দৈনিক ইনকিলাব আজ একটি রিপোর্ট ছেপেছে। তা হুবহু শেয়ার করা হলো-
নওশাদ খান নীরব একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির স্মার্ট সিস্টেমে আবেদনে নাম দিয়েছিল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের। প্রকাশিত তালিকায় তাকে ভর্তির জন্য মনোনয়ন দেয়া হয় ইউ ডট ইউ ল্যাবরেটরি কলেজে। স্বাভাবিকভাবেই তালিকা পেয়েই খুশি হন নীরব। মনে করেছিলেন, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরিতেই চান্স পেয়েছেন। ভর্তিও হতে গিয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি কলেজে। কিন্তু কলেজে গিয়ে দেখেন সেই কলেজের তালিকায় তার নাম নেই।
বিষয়টি নিয়ে বোর্ডে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, ওই কলেজ উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে। উত্তরায় অনেক খোঁজাখুঁজি করে ওই নামে কোন কলেজ খুঁজে পায়নি নীরব ও তার অভিভাবকরা। দুইদিন খোঁজাখুঁজির পর জানতে পারে, উত্তরার রবীন্দ্র সরণির ওই কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে এক বছর আগে। আর গুগল ম্যাপে (মানচিত্রে) এই কলেজটিকে দেখানো হচ্ছে আন্ডার কনস্ট্রাকশন। ভর্তির শেষ সময়ে এসে এই অবস্থায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে নওশাদ খান নীরব।
একই অবস্থা কক্সবাজারের চকরিয়া কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় থেকে পাস করা এক শিক্ষার্থীর। ওই শিক্ষার্থীর ভাই এডভোকেট তৌহিদুল এহসান জানান, তার ছোট ভাই জিপিএ-৫ পেয়ে ৫টি কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করে। সে যেসব কলেজে আবেদন করেছে তার মধ্যে ছিল রাজধানীর বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজ। কিন্তু আবেদন করা কলেজগুলোর কোনটিতেই তার না হয়ে প্রকাশিত তালিকায় দেয়া হয়েছে যশোরের সরকারি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজে। বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে যোগাযোগ করলে কোন সমাধান দিতে পারেনি। বরং ভর্তি হয়ে যেতে বলেছে কর্মকর্তারা। হাতে মাত্র একদিন সময় নিয়ে এখন কিভাবে ছোট ভাইকে ভর্তি করাবেন, তা নিয়ে দিশেহারা তৌহিদুল এহসান।
ফেনী সেন্ট্রাল হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৪ দশমিক ৭২ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন মহসিন। স্মার্ট সিস্টেমে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির জন্য ঢাকার ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজ, সরকারি কবি নজরুল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ফেনী সরকারি কলেজ এবং ঢাকার মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজকে পছন্দের তালিকায় রাখে। কিন্তু ভর্তির জন্য প্রকাশিত তালিকায় তাকে মনোনীত করা হয়েছে ভোলার বোরহান উদ্দিন উপজেলার আব্দুল জব্বার ডিগ্রি কলেজে। অথচ সে এই কলেজে আবেদনই করেনি।
নীরব, এহসানের ছোটভাই কিংবা মহসিনের মতো লাখ লাখ শিক্ষার্থী এখন এই ভোগান্তিতে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। মাধ্যমিকে সর্বোচ্চ ফলাফল করেও এখন তারা হতাশা আর দুশ্চিন্তায় দিনাতিপাত করছে। সৃষ্ট সমস্যার কোন সমাধানও জানতে পারছে না তারা। অথচ ফল পাওয়ার পর তাদের মুখে যে হাসি দেখা দিয়েছিল তা আরও উজ্জ্বল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজড করতে গিয়ে স্মার্ট সিস্টেম চালুর নামে যে ভোগান্তি নিয়ে এসেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা বোর্ডের কর্তাব্যক্তিরা তাতে এখন নাভিশ্বাস হয়ে পড়েছে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের। অনলাইনে ভর্তির আবেদনের পর থেকে ফল প্রকাশ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়।
পাঁচ দফা পিছিয়ে প্রকাশ করা হয় সেই ফল। আর তালিকা প্রকাশের পর এই জটিলতা পায় নতুন মাত্রা। বরং আংশিক এই তালিকা দীর্ঘ মেয়াদি দুশ্চিন্তায় ফেলেছে অনেক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবককেই। ওই তালিকা অনুযায়ী ভর্তি হতে গিয়ে নানাবিধ জটিলতায় পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। মেধা তালিকা অনুযায়ী ভর্তির জন্য মনোনীত কলেজে ছাত্রীদের কলেজে দেয়া হয়েছে ছাত্র আর ছাত্রদের কলেজে দেয়া হয়েছে ছাত্রীকে মনোনয়ন। আবার বিশেষায়িত বিজ্ঞান কলেজে ভর্তির জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে মানবিক বিভাগের শিক্ষর্থীদের। গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস পেয়েও ভর্তি হতে পারেনি কোন কলেজে আবার জিপিএ-৫ না পেয়েও মনোনীত হয়েছে ভর্তির জন্য।
এ ধরনের বহু সমস্যা নিয়ে এখন প্রতিদিনই দৌড়ঝাঁপ করছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। এদিকে লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে বিড়ম্বনা ও হয়রানির মধ্যে রেখেই গতকাল কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে কৃতিত্ব দেখাতে ক্লাস শুরু হয়েছে। যদিও এটি এখনো সিদ্ধান্তের পর্যায়ে আছে। অধিকাংশ কলেজে এখনো ভর্তি কার্যক্রম শুরুই করতে পারেনি। রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন কলেজে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এখনও ভর্তি প্রক্রিয়াই শেষ করতে পারেনি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীরা বলছে, অনেকে এখনও হাতে পায়নি তাদের ট্রান্সক্রিপ্ট। পাশাপাশি, গতকাল (বুধবার) ব্যাংক বন্ধ থাকায়; ভর্তির টাকা জমা দিতে পারেননি অনেকেই।
তাই ভর্তির সময় বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা। যদিও বিলম্ব ফি ছাড়া ভর্তি হওয়া যাবে আজ পর্যন্ত।ভর্তিতে বিড়ম্বনায় পড়া শিক্ষার্থীরা জানায়, বিলম্ব ফিসহ আজ প্রথম তালিকায় ভর্তির জন্য মনোনীতদের ভর্তির শেষদিন। কিন্তু আমাদের যে সমস্যা তার কোন সমাধান বোর্ড করে দিতে পারছে না। বোর্ড বলছে, দ্বিতীয় মেধাতালিকায় সমস্যা সমাধান করে দেবে। ভর্তিচ্ছুরা জানান, প্রথম তালিকায় প্রায় সাড়ে ১০ লাখ শিক্ষার্থীকে মনোনীত করা হয়েছে। ফলে দ্বিতীয় তালিকায় ভাল কলেজগুলোতে আর আসন ফাঁকা থাকবে না। যারা জিপিএ-৫ কিংবা এর কাছাকাছি রেজাল্ট করেছে প্রথম সারির কলেজ তো দূরে থাক তৃতীয় বা চতুর্থ সারির কলেজে স্থান হবে না। তবে এ অভিযোগ মানতে রাজী নন ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, প্রত্যেক শিক্ষার্থী তার যথাযথ যোগ্যতার কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, ভর্তিচ্ছুরা যেসব অভিযোগ নিয়ে আসছে এর বেশির ভাগই নিজেদের ভুলের কারণে। তারপর আমরা বলছি ওদের সমস্যার সমাধান করে দেবো। একই কথা বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেছেন, কোনো শিক্ষার্থী ভর্তির বাইরে থাকবে না। সবার সমস্যার সমাধান করা হবে।ভোগান্তির নেপথ্যে যারা : বোর্ড ভর্তির বিষয়টি তদন্ত করে দেখে, দেশের কয়েকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। এজন্য ২৩টির বেশি কলেজকে শোকজ দেয়া হয়। এ ছাড়া টেলিটকে টাকা পাঠানো, সার্ভারে প্রবেশ করতে না পারা ইত্যাদি সমস্যার কারণে আবেদনের সময় ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ জুন পর্যন্ত করা হয়। এরপর ফল প্রকাশ করতে গিয়ে চরম বিপত্তিতে পড়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
৫ দফায় সময় বাড়িয়ে ২১ জুনের পরিবর্তে ফল প্রকাশ করা হয় ২৮ জুন গভীর রাতে। ফল প্রকাশের পর ভুল-ত্রুটিসহ নানা ধরনের অভিযোগ আসতে থাকে। এ ছাড়া ট্রান্সক্রিপ্টে বড় ধরনের ভুল হওয়ার কারণে ট্রান্সক্রিপ্ট বিতরণ সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে ঢাকা বোর্ড। এ নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে ভর্তিচ্ছুদের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব ভোগান্তির পুরোটার জন্য দায়ী দু’জন ব্যক্তি। একজন মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী আমলা। অন্যজন ঢাকা বোর্ডের সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট মঞ্জুরুল কবির। তাদের একগুঁয়েমির কারণে আজকের এ ভোগান্তি।
মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সব কলেজে নতুন এ পদ্ধতি চালুর ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী ও সচিবের মধ্যে ছিল ব্যাপক মতানৈক্য। বিষয়টি এখন এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে দু’জনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ চেয়েছিলেন সর্বনিম্ন ৩০০ শিক্ষার্থী পড়ায় এমন কলেজকে অনলাইনের অধীনে আনতে। একাধিক বৈঠকে এ ধরনের সিদ্ধান্তই বহাল ছিল। কিন্তু শিক্ষা সচিব হঠাৎ করে সারা দেশে ৮ হাজার ৮৮১টি কলেজকে নতুন এ পদ্ধতির অধীনে আনেন। মন্ত্রীর অসম্মতির পরও শিক্ষা সচিব এ কাজ করেছেন। সচিবের গোয়ার্তুমির কারণেই আজ লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা জানান, এছাড়া ট্রান্সক্রিপ্টসহ বোর্ডের অধিকাংশ বিড়ম্বনার পেছনে বোর্ডের সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট মঞ্জুরুল কবির জড়িত।
তার নিজস্ব আইটি ফার্ম দিয়ে কাজ করানোর জন্য জেএসসি ফরম পূরণে বারবার ঝামেলায় পড়তে হয়েছে বোর্ডকে। সর্বশেষ ট্রান্সক্রিপ্ট বিতরণে কম্পিউটার শাখার প্রোগ্রামিংয়ের কারণে বিতরণ করার পর প্রায় ২ লাখ ট্রান্সক্রিপ্টে মহাভুল ধরা পড়ে। বাকি প্রায় দেড় লাখ ট্রান্সক্রিপ্টে একই ধরনের ভুল ছিল বলে জানা গেছে। তবে ভর্তির সার্বিক ভুলের দায়-দায়িত্ব শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তিনি সোমবার সাংবাদিকদের জানান, “ভর্তি নিয়ে সৃষ্ট সব সমস্যার দায়-দায়িত্ব আমার নিজের। আমার পরিকল্পনাতেই অনলাইনে ভর্তির প্রক্রিয়াটি হচ্ছে। ভুল-ভ্রান্তি যা আছে এর সব দায় আমার উপর বর্তাবে। আর মন্ত্রীর সাথে মতানৈক্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একক নয়, বরং সবার মতামত নিয়ে এই পদ্ধতি চালু করা হয়েছে।’ এদিকে ভর্তি নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে জটিলতা সৃষ্টি হলেও বিষয়টিতে এড়িয়ে গেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তবে গতকাল তিনি বলেছেন, ‘একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির বিষয়ে আমি কোনো কথা বলবো না। যা হচ্ছে যা ঘটছে, সবই তোমরা দেখছো। তবে আমি বলতে চাই, কোনো শিক্ষার্থী ভর্তির বাইরে থাকবে না। সবার সমস্যার সমাধান করা হবে।’ গতকাল (বুধবার) দুপুরে পাঠ্যপুস্তক ভবনে একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন বইয়ের উদ্বোধন শেষে তিনি এ কথা বলেন।
সূত্র-ইনকিলাব
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৫:৫৬